শনিবার, ১৫ অক্টোবর, ২০১৬, ০৮:৪৪:৫৪

এই কৌশলগত অংশীদারিত্ব আসলে কী?

এই কৌশলগত অংশীদারিত্ব আসলে কী?

নুরুল ইসলাম হাসিব : চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের ‘ঐতিহাসিক’ ঢাকা সফরে যৌথ ঘোষণায় ‘সর্বাত্মক অংশীদারিত্ব ও সহযোগিতা’র সম্পর্ককে ‘কৌশলগত অংশীদারিত্ব ও সহযোগিতার’ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার ঘোষণা এসেছে, যা নিয়ে তৈরি হয়েছে আগ্রহ।

শুক্রবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে শেখ হাসিনা ও শি জিনপিংয়ের নেতৃত্বে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর এই যৌথ বিবৃতি আসে।

সেখানে বলা হয়, বিপুল জনসংখ‌্যার আবাসস্থল উন্নয়নশীল এ দুই দেশ যৌথভাবে নিজেদের জনগণকে উন্নয়ন ও মঙ্গলজনক সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিতে সম্মত হয়েছে।

উজ্জ্বল ভবিষ‌্যৎ গড়ার যে সাধারণ আকাঙ্ক্ষা তার ভিত্তিতে দুই দেশ তাদের সম্পর্ককে ‘কৌশলগত অংশীদারিত্ব ও সহযোগিতার’ পর্যায়ে উন্নীত করতে ঐকমত‌্যে পৌঁছেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে বিবৃতিতে।    

কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ‘কৌশলগত অংশীদারিত্ব ও সহযোগিতা’ বলতে কী বোঝায়? দুটি দেশের সাধারণ কূটনৈতিক সম্পর্কের সঙ্গে এর পার্থক‌্য কোথায়?

সাধারণভাবে দুই রাষ্ট্রের কৌশলগত অংশীদারিত্বের কথা উঠলেই নিরাপত্তা ও সামরিক যোগাযোগের আলোচনা চলে আসে। তবে সাবেক কূটনীতিবিদরা বলছেন, স্বাস্থ‌্য, শিক্ষা, যোগাযোগ, অবকাঠামো বা অর্থনৈতিক সহযোগিতার মত বিষয়গুলোও কৌশলগত অংশীদারিত্বের বাইরে নয়।

বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে চীনের সঙ্গে এই কৌশলগত অংশীদারিত্বের কোনো ব‌্যাখ‌্যা দেওয়া হয়নি, যদিও দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে উঠে আসা বিষয়গুলোর ‘রাজনৈতিক দিক রয়েছে’ বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক।

আর বিশ্ব অর্থনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রকে চ‌্যালেঞ্জ জানানো চীনের রাষ্ট্রপ্রধানের এই সফরের দিকে ওয়াশিংটনের পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ার প্রভাবশালী দেশ ভারতও নজর রেখেছে বলে বিশ্লেষকদের বিশ্বাস।

মানচিত্রের তিন দিক ঘিরে থাকা ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদীর সময়ে অনন‌্য উচ্চতায় পৌঁছেছে বলে দুই দেশের দাবি। জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে দুই প্রতিবেশী একসঙ্গে লড়াইও করছে। তবে ভারতের সঙ্গেও ‘কৌশলগত’ অংশীদারিত্ব থাকার কথা সরকারি পর্যায়ে কখনও বলা হয়নি।  

চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত আশফাকুর রহমান চীনের সঙ্গে এই ‘কৌশলগত’ অংশীদারিত্বের ঘোষণাকে দেখছেন অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে।

তিনি বলেন, “এটা সহযোগিতার কৌশল, সামরিক নয়। আমি মনে করি, চীন যেহেতু বাংলাদেশে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগের পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে, ওই ঘোষণায় অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বের কথাই বোঝানো হয়েছে। আমি এ ঘোষণাকে স্বাগত জানাই।”

আশফাকুর রহমান মনে করেন, অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব বিনিয়োগের সঠিক ক্ষেত্র বাছাই করতে সহায়ক হবে। কিন্তু বিষয়টি সামরিক হলে সৃষ্টি হবে জটিলতা।     

সহযোগিতা এগিয়ে নিতে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর দুই দেশের সরকারের মধ্যে ১৫টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক এবং ১২টি ঋণ ও দ্বিপক্ষীয় চুক্তি হয়েছে। ছয়টি বড় প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তরও উন্মোচন করেছেন প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।      

প্রথমে বক্তৃতা দিতে এসে চীনা প্রেসিডেন্ট দুই দেশের সম্পর্ককে কৌশলগত অংশীদারিত্বে উন্নীত করার মতৈক্যের কথা জানান এবং ‘উচ্চ পর্যায়ের মত বিনিময় ও কৌশলগত যোগাযোগে’ সম্মত হওয়ার কথা বলেন।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ ও চীন ভালো প্রতিবেশী ও বন্ধু; ২০১৭ সাল হবে চীন ও বাংলাদেশের বন্ধুত্বের বছর।

আর এর মধ‌্য দিয়ে সহযোগিতার ‘একটি উচ্চতর ভিত্তি’ তৈরি হল মন্তব‌্য করে শেখ হাসিনা বলেন, বাণিজ‌্য ও বিনিয়োগ, অবকাঠামো, শিল্প, বিদ‌্যুৎ ও জ্বালানি, তথ‌্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি এবং কৃষির মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোতে সহযোগিতা জোরদারে একমত হয়েছেন তারা।

পরে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিষয়ে সাংবাদিকদের জানাতে এসে পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক বলেন, শি জিনপিংয়ের এই সফরের মধ্য দিয়ে চীন ও বাংলাদেশের সহযোগিতামূলক সম্পর্ক ‘কৌশলগত সম্পর্কে’র রূপ পেয়েছে।

বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের এই সফর তার আন্তঃযোগাযোগের ‘ওয়ান-বেল্ট, ওয়ান রোড’ নীতিকে এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ‌্যে। আর নিম্ন মধ‌্যম আয়ের কাতার থেকে সমৃদ্ধ দেশ হয়ে ওঠার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে বাংলাদেশের চাই ব‌্যাপক শিল্পায়ন, বিপুল বিনিয়োগ।

বেইজিংয়ের ‘এক চীন নীতি’তে সমর্থন দিয়ে যাওয়া বাংলাদেশ এখন চীনের হাত ধরে অবকাঠামো খাতে সেই ব‌্যাপক উন্নয়ন ঘটাতে চায়।

বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের ভাইস প্রেসিডেন্ট সাবেক রাষ্ট্রদূত মো. হুমায়ুন কবিরও মনে করছেন, দুই দেশের এই কৌশলগত অংশীদারিত্বের মূলে রয়েছে বিনিয়োগের সম্ভাবনা।

এই অংশীদারিত্বের মধ‌্যে প্রতিবেশী দেশগুলোর জন‌্য উদ্বেগজনক কিছু আছে বলে তিনি মনে করেন না।

তিনি বলেন, “আমি মনে করি, নতুন এই অংশীদারিত্বের মধ‌্য দিয়ে আমরা আসলে বড় প্রেক্ষাপটে পরিস্থিতির বিচার করতে যাচ্ছি, যেখানে দুই পক্ষ দীর্ঘমেয়াদী সুফল পাওয়ার জন‌্য পরস্পরের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করবে।”

আর এই দীর্ঘমেয়াদী লাভের মধ‌্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও যোগাযোগ যেমন থাকতে পারে, সামরিক সম্পর্কের বিষয়ও সেখানে আসতে পারে বলে হুমায়ুন কবির মনে করেন।           

“তবে আমি বলব, বাংলাদেশের জন‌্য এটা হবে নতুন মাত্রার এক সম্পর্ক, যেখানে অর্থনৈতিক সম্পর্কের বিষয়টিই গুরুত্ব পাবে।”

হুমায়ুন কবিরের যুক্তি, চীন বড় বিনিয়োগ করতে প্রস্তুত, আর বাংলাদেশেরও বিপুল বিনিয়োগ প্রয়োজন। সুতরাং দুই পক্ষই পরষ্পরের চাহিদা মেটাতে পারে।

“জ্বালানি ও বিনিয়োগে বাংলাদেশের সহযোগিতা প্রয়োজন। চীন সে দিক দিয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে পারে। আমরা পরস্পরের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন‌্য কাজ করছি।”

তবে সব ধরনের কৌশলজনক সহযোগিতার ক্ষেত্রেই স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও জনগণের অংশগ্রহণের ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, কেবল সেক্ষেত্রেই সেই সম্পর্ক টেকসই, ফলপ্রসূ এবং দীর্ঘমেয়াদে লাভজনক হতে পারে।    

চীনের প্রেসিডেন্টও তার বিবৃতিতে বলেছেন, বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বড় প্রকল্পগুলোতে আর্থিক, কারিগরি ও জনশক্তি দিয়ে সর্বোচ্চ সহযোগিতা অব‌্যাহত রাখবে তার দেশ। -বিডিনিউজ।
১৫ অক্টোবর, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সৈকত/এমএম

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে