শিশির মোড়ল : নতুন বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে মস্তিষ্কের রক্তনালির রোগে (সেরিব্রোভাসকুলার ডিজিজ)। ২০১৫ সালে সবচেয়ে বেশি, ১৬ শতাংশ মৃত্যু ঘটে এই রোগে। মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ হৃৎপিণ্ডের রক্তনালির রোগ (ইসকিমিক হার্ট ডিজিজ)। গত বছর ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ মৃত্যু হয় এই রোগে।
যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটলে অবস্থিত ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট ফর হেলথ ম্যাট্রিকস অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশন, বিশ্বব্যাংক ও ল্যানসেট-এর যৌথ বিশ্লেষণে মৃত্যুর প্রধান পাঁচটি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। মৃত্যুর অন্য তিনটি প্রধান কারণ হচ্ছে দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসতন্ত্রের রোগ (সিওপিডি), ডায়াবেটিস ও শ্বাসতন্ত্রের নিচের অংশের সংক্রমণ (লোয়ার রেসপিরেটরি ইনফেকশন)।
১৯৯০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ১৯৫টি দেশ ও ভৌগোলিক অঞ্চলের ৩০০ রোগ ও আঘাতের তথ্য নিয়ে এই বিশ্লেষণ করা হয়েছে। বিশ্লেষণের সঙ্গে সম্পৃক্ত গবেষকেরা বলছেন, উন্নত পয়োব্যবস্থা, টিকা কর্মসূচি, ঘরের অভ্যন্তরীণ বায়ুর মান এবং পুষ্টির উন্নতি দরিদ্র দেশগুলোর শিশুদের দীর্ঘদিন বাঁচার সুযোগ করে দিয়েছে। পাশাপাশি স্থূলতা, রক্তে উচ্চমাত্রায় শর্করার উপস্থিতি, মদ্যপান ও মাদকের অপব্যবহার বিশ্বব্যাপী বড় ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করেছে।
পাঁচ রোগ
ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট ফর হেলথ ম্যাট্রিকস অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশন, বিশ্বব্যাংক ও ল্যানসেট-এর যৌথ বিশ্লেষণ ১. মস্তিষ্কের রক্তনালির রোগ ২. হৃৎপিণ্ডের রক্তনালির রোগ ৩. দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসতন্ত্রের রোগ ৪. ডায়াবেটিস ৫. শ্বাসতন্ত্রের নিচের অংশের সংক্রমণ
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কয়েক বছর ধরে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, জেলা হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ ও বিশেষায়িত হাসপাতালে কোন কারণে মৃত্যু ঘটছে, তার তথ্য সংগ্রহ করছে। নতুন বিশ্লেষণ সম্পর্কে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘বৈশ্বিক বিশ্লেষণে বাংলাদেশে মৃত্যুর প্রধান যে পাঁচটি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে, তা ঠিকই আছে। আমরাও গত কয়েক বছরে এই প্রবণতা লক্ষ করেছি।’
ইনস্টিটিউট ফর হেলথ ম্যাট্রিকস অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ১২০টি দেশের ১ হাজার ৮০০-এর বেশি বিজ্ঞানী ও গবেষক এই বিশ্লেষণে অংশ নিয়েছেন। বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর কারণ, মাতৃমৃত্যু, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যু, সার্বিকভাবে রোগের প্রকোপ, প্রতিবন্ধিতা নিয়ে বসবাস এবং ঝুঁকির কারণ নিয়ে ছয়টি নিবন্ধ তৈরি হয়েছে। ৮ অক্টোবর এসব নিবন্ধ প্রভাবশালী জনস্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সাময়িকী ল্যানসেটে ছাপা হয়েছে।
কত মৃত্যু: জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান (নিপোর্ট) বলছে, ২০১৫ সালে বিভিন্ন রোগে দেশে ৮ লাখ ২১ হাজারের কিছু বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে ১৬ শতাংশ বা ১ লাখ ৩১ হাজার ৩৬০ জনের মৃত্যু হয় মস্তিষ্কের রক্তনালির রোগে। এ ব্যাপারে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হাসপাতালের যুগ্ম পরিচালক অধ্যাপক বদরুল আলম বলেন, ‘এই তথ্য আমাদের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। আগে ভাবা হতো, হৃদ্রোগে বেশি মানুষের মৃত্যু হয়।’
এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, দেশের মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মস্তিষ্কের রক্তনালির রোগ বাড়ছে। বয়স ৬০ বছর পার হলেই এই রোগ বেশি হয়। আঘাত ব্যতীত মস্তিষ্কের রক্তনালির যেকোনো রোগই (স্ট্রোক, ডিমেনশিয়া ইত্যাদি) মস্তিষ্কের রক্তনালির রোগ বা সেরিব্রোভাসকুলার ডিজিজ।
এরপর বেশি মানুষ মারা যায় হৃৎপিণ্ডের রক্তনালির রোগে। এই সংখ্যা হলো ১ লাখ ১৭ হাজার ৪০৩ জন বা ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ। বৈশ্বিক বিশ্লেষণ বলছে, মৃত্যুর তৃতীয় প্রধান কারণ দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসতন্ত্রের রোগ (সিওপিডি)। গত বছর ৮ দশমিক ২ শতাংশ বা ৬৭ হাজার ৩৩২ জনের মৃত্যু হয় এই রোগে। চতুর্থ স্থানে আছে ডায়াবেটিস। এই রোগে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ বা ৪৪ হাজার ৩৩৪ জনের মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পঞ্চম প্রধান কারণ শ্বাসতন্ত্রের নিচের অংশের সংক্রমণ। এই রোগে ৩ দশমিক ৯ শতাংশ বা ৩২ হাজার ১৯ জনের মৃত্যু হয়।
রোগ-ব্যাধির বৈশ্বিক বিস্তার, ধরন ও প্রবণতা বিষয়ে ২০১০ সালের ল্যানসেট-এর গবেষণায় যুক্ত ছিলেন আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) নন-কমিউনিকেবল ডিজিজ ইনিশিয়েটিভ শাখার প্রধান ড. আলিয়া নাহিদ। বর্তমান বিশ্লেষণ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘মৃত্যুর প্রথম চারটি কারণই হচ্ছে অসংক্রামক ব্যাধি বা নন-কমিউনিকেবল ডিজিজ। স্বাস্থ্যসম্পন্ন জীবনযাপনে অভ্যস্ত না হলে এসব রোগ হয়। সরকার ও নীতিনির্ধারকদের উচিত হবে নতুন এই তথ্যের ওপর ভিত্তি করে কর্মকৌশল নির্ধারণ করা।’
অগ্রগতি: গত ২৫ বছরে বাংলাদেশে মাতৃ ও শিশুমৃত্যু এবং গড় আয়ু বৃদ্ধির ক্ষেত্রে অগ্রগতি হয়েছে। ১৯৯০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত দেশে মাতৃমৃত্যু বছরে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ হারে কমেছে। ২০১৫ সালে দেশে ৭ হাজার ৬৬৩টি মাতৃমৃত্যুর ঘটনা ঘটে (গর্ভধারণ ও প্রসবজনিত জটিলতায় মায়ের মৃত্যু)। ১৯৯০ সালে প্রতি ১ লাখ শিশুর জন্মে ৫৮১ জন মায়ের মৃত্যু হতো। ২০১৫ সালে তা কমে ২৪৪-এ দাঁড়ায়।
সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যে (এমডিজি) শিশুমৃত্যু বছরে ৪ দশমিক ৪ শতাংশ হারে কমানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। ১৯৯০-২০১৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশে বছরে ৫ শতাংশ হারে শিশুমৃত্যু কমেছে। এই বৈশ্বিক বিশ্লেষণ বলছে, ২০১৫ সালে পাঁচ বছরের কম বয়সী ১ লাখ ২২ হাজার ৬৫০টি শিশুর মৃত্যু হয়।
বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০০৫ সালে দেশের নারীদের গড় আয়ু ছিল ৬৯ বছর। ২০১৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭৩ বছরে। অন্যদিকে ২০০৫ সালে পুরুষের গড় আয়ু ছিল ৬৬ বছর। ২০১৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৬৯ বছরে।
করণীয়: প্রতিবেদনে বাংলাদেশের জন্য প্রধান পাঁচটি স্বাস্থ্যঝুঁকির উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে আছে উচ্চ রক্তচাপ, ধূমপান, ঘরের অভ্যন্তরে বায়ুদূষণ, ঘরের বাইরের বাতাসে ভাসমান সূক্ষ্ম বস্তুকণা এবং রক্তে অতিরিক্ত শর্করা।
অধ্যাপক বদরুল আলম বলেন, সেরিব্রোভাসকুলার ডিজিজে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে, এমন সুনির্দিষ্ট তথ্য আগে ছিল না। এখন এ বিষয়ে মানুষকে সচেতন করতে হবে। পাশাপাশি চিকিৎসার আয়োজন বিস্তৃত করতে হবে। তিনি বলেন, সেরিব্রোভাসকুলার ডিজিজের অন্যতম প্রধান কারণ ধূমপান। ধূমপান নিয়ন্ত্রণে সরকারকে আরও কঠোর হতে হবে।
এদিকে আলিয়া নাহিদ বলেন, মৃত্যুর পেছনে প্রধান যেসব রোগ চিহ্নিত করা হয়েছে, দীর্ঘস্থায়ী এসব রোগে আক্রান্ত হলে খরচও খুব বেশি। সুতরাং এসব রোগ প্রতিরোধের ওপর জোর দিতে হবে। মানুষকে সচেতন করার কর্মকৌশলে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
চিকিৎসাব্যবস্থা সন্তোষজনক নয়
দেশে সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হচ্ছে মস্তিষ্কের রক্তনালির রোগে (যেমন স্ট্রোক, ডিমেনশিয়া ইত্যাদি)। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হসপিটালের যুগ্ম পরিচালক অধ্যাপক বদরুল আলম বলেন, রোগের বোঝা অনেক বড়। সেই তুলনায় চিকিৎসার আয়োজনকে পর্যাপ্ত বলা যাবে না। তিনি বলেন, এই রোগ চিকিৎসার জন্য কমপক্ষে ৫০০ জন চিকিৎসক দরকার, দেশে চিকিৎসক আছেন ১৫০ জন। প্রশিক্ষিত নার্সের অভাব আছে। এই রোগ শনাক্ত করার জন্য সিটি স্ক্যান ও এমআরআই যন্ত্র খুবই দরকার। কিন্তু উপজেলায় এমনকি অনেক জেলায় এই যন্ত্র নেই। তবে সরকারি সব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এই রোগের সেবা আছে।
হৃৎপিণ্ডের রক্তনালির রোগ মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারি ও বেসরকারি সব হাসপাতাল মিলে বছরে এক লাখের কিছু বেশি রোগীর সেবা দেওয়া যায়। কিন্তু দেশে এই রোগে আরও অনেক বেশি রোগী আক্রান্ত হয়।
এ ব্যাপারে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক আবু আজম বলেন, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে বছরে প্রায় ৬০ হাজার রোগীর চিকিৎসা দেওয়া হয়। বেশ কয়েকটি পুরোনো সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং নতুনের মধ্যে কুমিল্লা ও ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার উন্নত ব্যবস্থা আছে। এ ছাড়া দেশে বেসরকারি খাতে কয়েকটি ভালো হাসপাতাল আছে। তিনি বলেন, ‘ভারতের সঙ্গে তুলনা করলে আমরা হয়তো কিছুটা পিছিয়ে, কিন্তু পাকিস্তানের চেয়ে অনেক এগিয়ে।’ আগামী কয়েক বছরের মধ্যে পরিস্থিতির আরও উন্নতি হবে বলে তিনি আশা করেন।
দেশে দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসতন্ত্রের রোগের (সিওপিডি) প্রকোপ অনেক বেশি। জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক শাহেদুর রহমান খান বলেন, ২০০৬ সালের এক জরিপে দেশে সিওপিডি আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ৬০ লাখ। এখন সংখ্যা আরও বেড়েছে। তিনি বলেন, জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতালসহ দেশের সব সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও পুরোনো যক্ষ্মা হাসপাতালে এই রোগের চিকিৎসা হচ্ছে। তবে উপজেলা পর্যায়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেওয়া সরকারের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
দেশে প্রায় ৮০ লাখ মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। তবে এই রোগ শনাক্ত ও চিকিৎসার বড় অংশটি বাংলাদেশ ডায়াবেটিস সমিতি করে আসছে। সমিতির যোগাযোগ শাখা থেকে জানানো হয়েছে, সমিতির বারডেম হাসপাতাল ছাড়াও ৬১টি জেলায় রোগ শনাক্ত ও চিকিৎসাকেন্দ্র বা হাসপাতাল আছে। এ ছাড়া সারা দেশে সমিতি স্বীকৃত ৩০০টি কেন্দ্রে রোগ শনাক্ত ও চিকিৎসা হয়। সরকারি পর্যায়ে প্রায় সব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে, জেলা ও সদর হাসপাতালে এই রোগ শনাক্ত করার ব্যবস্থা আছে। উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালেও এই রোগ শনাক্ত করা হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, ওপরের চারটি রোগ মূলত বয়স্কদের। শ্বাসতন্ত্রের নিচের অংশের সংক্রমণ বা লোয়ার রেসপিরেটরি ইনফেকশন (যেমন নিউমোনিয়া) সব বয়সী মানুষের হতে পারে, তবে শিশু ও বৃদ্ধদের এতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের সাবেক প্রধান অধ্যাপক আবিদ হোসেন মোল্লা বলেন, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুর প্রধান কারণ নিউমোনিয়া। তবে নিউমোনিয়া শনাক্ত করা কিছুটা জটিল। এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, টিকা ব্যবহারের কারণে নিউমোনিয়ার প্রকোপ অনেক কমেছে। তা ছাড়া উপজেলা পর্যায়ে এর চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে। -প্রথম আলো।
১৭, অক্টোবর ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সৈকত/এমএস