মানসুরা হোসাইন: ১৬টি দেশের ২০টি সংগঠনের প্রায় এক লাখ কৃষকের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বাংলাদেশের কৃষক ও কৃষকনেতা সাজেদা বেগম। চলতি বছরের আগস্ট মাসে দিনাজপুরের এই কৃষক এশিয়ান ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। এ পদে দায়িত্ব পালন করবেন দুই বছর। তারপর আবার এই অ্যাসোসিয়েশনেরই প্রেসিডেন্ট হিসেবে আরও দুই বছর দায়িত্ব পালন করবেন।
সাজেদা বেগম এখন ঢাকায়। আজ মঙ্গলবার সিরডাপ মিলনায়তনে দ্বিতীয়বারের মতো আয়োজিত কৃষক নারী সম্মেলনের অনুষ্ঠানে সভাপতির দায়িত্ব পালন করবেন তিনি। গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় প্রথম আলো কার্যালয়ে আসেন তিনি। কথা হয় তাঁর সঙ্গে। এশিয়ান ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশনে ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে এই প্রথমবার কোনো নারী দায়িত্ব পালন করছেন। আর তিনি হলেন সাজেদা বেগম।
সাজেদা বেগমকে ১৬টি দেশের নেতৃত্ব দেওয়ার আগে গ্রাম, ইউনিয়ন, উপজেলা ও কেন্দ্রীয় কৃষকসংগঠনে নেতৃত্বে দক্ষতা দেখাতে হয়েছে। সততা, নিষ্ঠা, দায়িত্ববোধ সবকিছু বিবেচনাতেই তিনি এশিয়ার নেতৃত্ব পেয়েছেন। সাজেদা দেশের ২২ হাজার কৃষক পরিবারের সদস্যদের নিয়ে গঠিত কেন্দ্রীয় কৃষক মৈত্রীর প্রেসিডেন্ট হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। এ পদের জন্য অন্য কৃষকসংগঠনের প্রতিনিধিদের কাছ থেকে ভোট পেতে হয়েছে। কেন্দ্রীয় এ কৃষকসংগঠনেও সাজেদা বেগমই প্রথম নারী, যিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
সাজেদা বেগমের বাবা, মা ও ভাই কৃষিকাজ করেন। বিয়ের আগে থেকেই তিনি নিজেও কৃষির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অষ্টম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় কৃষক মতিয়ার রহমানের সঙ্গে সাজেদার বিয়ে হয়। স্বামী ততটা পড়াশোনা করেননি। তবে স্ত্রীকে সার্বিকভাবে সহায়তা করছেন বলে জানালেন সাজেদা। বর্তমানে সাজেদা এক ছেলে ও এক মেয়ের মা। মেয়ে এইচএসসি এবং ছেলে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ছে। এ পর্যন্ত সাজেদা ফিলিপাইন, মিয়ানমার, ব্যাংকক, ভিয়েতনাম ও নেপাল সফর করেছেন।
সাজেদা বেগমকে আজকের অবস্থানে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে অ্যাকশন এইড বাংলাদেশ নানাভাবে সহায়তা করেছে বলে জানালেন সাজেদা। দেশে-বিদেশে নেতৃত্ব দেওয়ার পাশাপাশি নিজেদের প্রায় এক একর জমিতে ফসল বোনা, সবজি রোপণ, পাইকারের কাছে বিভিন্ন ফসল বিক্রি করাসহ কৃষিকাজ, বাড়ির রান্নাবান্নাসহ অন্যান্য দায়িত্বও সাজেদাকে পালন করতে হচ্ছে। হেসে বললেন, ‘আমি বাইরে বাইরে বেশি থাকি। তাই টাকা-পয়সার হিসাব রাখেন স্বামী।’
কৃষকনেতা হিসেবে কী কী দায়িত্ব পালন করেন জানতে চাইলে সাজেদা জানালেন, ফসল উৎপাদন, কীটনাশকের ব্যবহার, বীজ ব্যবস্থাপনা, বীজের গুণগত মান ঠিক রাখা, কৃষকদের অধিকার আদায় নিয়ে আলোচনাসহ সংগঠন পরিচালনার সার্বিক দায়িত্ব পালন করতে হয়। কৃষকেরা যে খাদ্য উৎপাদন করছেন, তা সঠিক উপায়ে হচ্ছে কি না, তাও দেখতে হচ্ছে।
সাজেদা জানালেন, বিয়ের পরপর সরকার পরিচালিত কৃষক মাঠ স্কুলের সদস্য হিসেবে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ পান। ২০১২ সালে অ্যাকশন এইডের দিনাজপুরে খাদ্য নিরাপত্তার জন্য দায়িত্বশীল কৃষি প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত হন। সেখান থেকে নারী নেতৃত্ব বিকাশ, ব্যবসাসংক্রান্ত নানান প্রশিক্ষণ পান। ফিলিপাইনে ‘ইয়ুথ ফার্মার’ হিসেবে পারিবারিক কৃষি নিয়ে প্রশিক্ষণ নেওয়ার সুযোগ পান। প্রথম দিকে অ্যাকশন এইড কেন্দ্রীয় কৃষক মৈত্রী গঠনে সহায়তা করে। তবে বর্তমানে নিজস্ব ব্যয়েই স্বাধীনভাবে এ সংগঠনটি পরিচালিত হচ্ছে। বীজের ব্যবসাসহ নানান ব্যবসা পরিচালনা করছে এ সংগঠন। ঢাকায় আজ যে সম্মেলন, তার আয়োজনটি যৌথভাবে করছে অ্যাকশন এইড বাংলাদেশ, কেন্দ্রীয় কৃষক মৈত্রী ও খাদ্য নিরাপত্তা নেটওয়ার্ক।
সাজেদা বেগমের নেতৃত্বে বিভিন্ন কৃষকসংগঠনের প্রতিনিধিরা বর্তমানে সরকার যাতে নারীদের কৃষক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, সে আন্দোলন করছেন। সাজেদা বেগমের চোখে–মুখে খুশির ঝিলিক। জানালেন, এলাকার বেশির ভাগ কৃষক বাড়িতে শাকসবজি লাগানো, হাঁস-মুরগি পালনসহ নানান কাজে ব্যস্ত। নিজেদের খাওয়ার পর তারা তা বাজারে বিক্রি করছেন। কৃষিকাজে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ার ফলে কৃষকদের কায়িক পরিশ্রম অনেকটা কমেছে।
সাজেদা স্বপ্ন দেখেন, একসময় বাংলাদেশে এমন কৃষকনেতা তৈরি হবে, যিনি শুধু ১৬টি দেশ নয়, সারা বিশ্বের নেতৃত্ব দেবেন। সাজেদা হাসিমুখেই বললেন, ‘এখন আমরা অনেক বিষয়ে সচেতন, তবে আগে এত সচেতন ছিলাম না।’-প্রথম আলো
১৮ অক্টোবর,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এআর