মাহবুব রেজা মাহবুব রেজা : বাড়ির সামনে বেশ খোলামেলা জায়গা । অনেক গাছপালা । মা একে তাঁকে দিয়ে , কোত্থেকে কোত্থেকে খুঁজে পেতে এনে গাছ লাগিয়েছেন । পেয়ারা , আম, জাম , জাম্বুরা , কাঁঠাল , বেল , অশ্বথ ,ডালিম , বট,পাকুর , দেবদারু , মেহগিনি , হিজল , আমড়া , নিম , চালতা , তেতুল , নিশিন্দা , কামরাঙা আরও কতরকম গাছপালা যে মা বাড়ির চারদিকে লাগিয়েছেন তার কোন ইয়ত্তা নেই ।
সারাদিন গাছপালা থেকে নাম না জানা পাখপাখালির ডাকাডাকির আড়ালে বাইরের শব্দ বাড়িতে ঢুকতে পারে না । বাইর থেকে অপরিচিত কেউ এ বাড়িতে এলে প্রথমেই এতসব গাছগাছালি আর পাখপাখালির শব্দে অবাক হয়ে যাবে এই ভেবে যে কোথায় এলাম আমি ! বনের ভেতর নাতো !
একদিন খুব সকালবেলা গ্রাম থেকে এক বুড়ো এসে হাজির । দারোয়ান এসে মাকে বলল , আম্মা , গেরাম থিকা এক বুড়া আসছে । হের হাতে এক খান বিরিখ্য।
বৃক্ষ ! মা অবাকই হলেন । মা বুড়োকে ভেতরে আসতে বললেন । বুড়ো বাড়ির ভেতর এলে মা তার হাতে থাকা কাঁঠালিচাঁপা গাছের চারা দেখে খুব খুশি হয়ে গেলেন। ঢাকা শহরে অনেককেই তিনি কাঁঠালিচাঁপা গাছের চারা যোগাড় করে দিতে বলেছিলেন ।বাড়িতে অনেক রকমের গাছ আছে। কিন্তু কাঁঠালিচাঁপার গাছই নেই । এই গাছের ফুল আর ফুলের গন্ধ হাসুর বাবার খুব প্রিয় । এই গাছ থেকে যখন ফুল বের হয় তখন যে কি সুন্দর গন্ধ বের হয় ! সেই গন্ধে বুক ভরে শ্বাস নিলে যেন আপনাআপনি ঘুম চলে আসে।
হাসুর বাবা একদিন মাকে বললেন , রেনু তোমার বাড়িতে সব গাছই আছে ,নাই খালি কাঁঠালিচাঁপার গাছ । তাই তো ! এরপর মা এই গাছের অপেক্ষায় ছিলেন । অনেকের কাছেই মা এই গাছের কথা বলেছেন । সবাই শুধু মাকে বলে , আর কটা দিন অপেক্ষা করেন । গাছ পেলেই আপনাকে দিয়ে যাবো । কেউ আর যোগাড় করে দিতে পারে নি । মা শুধু অপেক্ষায়ই থেকেছেন । মার খুশি মাখা হাসি দেখে বুড়োও সেরকম একটা হাসি হেসে বলল , আপনের লাইগা কাঁঠালিচাঁপার গাছ আনলাম । বুড়োর মুখে হাসিটা লেগে থাকে ।
মা বুড়োকে বললেন,
চাচা ,আপনার অনেক কষ্ট হইছে , না ?
আম্মা যে কি কন ! আপনে একটা গাছ চাইছেন হেইডা আনতে আবার কিয়ের কষ্ট !
মা দুপুরে নিজে বসে থেকে হাতে আলু পটল ভাজি , পেপে দিয়ে বড় শিং মাছের ঝোল , লম্বা বেগুন দিয়ে রুই মাছের তরকারি আর চালতার ডাল দিয়ে বুড়োকে গরম ভাত খাওয়ালেন । বুড়ো খুব তৃপ্তির সঙ্গে খেলেন । মা বসে বসে বেড়ে বেড়ে খাবার বুড়োর প্লেটে তুলে দিচ্ছেন । বাবা সবসময় মাকে বলেন , দেশ থেকে কেউ এলে তিনি যেন তাদের পেট ভরে খেতে দেন । অবশ্য বাবা না বললেও মা সবসময়ই দেশ থেকে আসা মেহমানদের খাবার দাবারের ব্যাপারটা নিজে তদারকি করেন ।
বুড়ো খুব আয়েশ করে ভাত খেলেন। মা বুড়োর দিকে পানের বাটা বাড়িয়ে দিলেন। বুড়ো একটা বড় পান নিয়ে জর্দা ,খয়ের ,চুন , সুপারি নিয়ে মুখে পুরলেন । বুড়ো বেশ খুশি। মুখের পান এক গাল থেকে আরেক গালে চালান করতে করতে বুড়ো মাকে বললেন, অনেকদিন পর বড় স্বাদের খাওন খাইলাম । বুড়োর মুখে শিশুর সরল হাসি। বুড়ো চলে যেতে উদ্যত হলে মা বললেন , আজকের দিনটা থেকে কাল সকালে যাবেন।
বুড়ো বললেন , সন্ধ্যায় লঞ্চ ধরলে সকাল সকাল পৌঁছে যাওয়া যাবে। বলতে বলতে বুড়ো বাড়ির সামনের পথ ধরে রাস্তার দরোজার দিকে পা বাড়ানোর জন্য এগিয়ে গেল । মা তখন বলল , চাচা দাঁড়ান । মার কথা শুনে বুড়ো দাঁড়াল ।
মা বুড়োর হাতে একশ টাকার দুইটা নোট দিয়ে বললেন , এবার টুঙিপাড়া থেকে আমার জন্য ভাল জাতের কড়ই এর চারা নিয়ে আসবেন। বুড়ো মুখে সেই হাসিটা ঝুলিয়ে রেখে বলল , আইছছা আম্মা আনুম।
দুই ।।
সকালবেলা বুড়ো যখন এ বাড়িতে এসেছে তখন রাসেল মাত্র ঘুম থেকে উঠেছে । সকালবেলার নরম রোদ রাসেলের ঘরে এসে উঁকি মারছে । ঘুম থেকে ওঠার পর রাসেলের প্রথম কাজ হল গুটি গুটি পায়ে হাসু আপার ঘরে যাওয়া । হাসু আপাকে না দেখলে ওর সারাটা দিন ভাল যায় না । আজও ঘুম ভাঙ্গার পর রাসেল এ ঘরে এসে দেখ হাসু আপা পেপার পড়ছেন ।
রাসেলদের বাড়িটা বেশ খোলামেলা । দিনের আলো সারাদিন খেলা করে বাড়িতে । রাসেল ঘুম থেকে উঠে হাসুপার ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ায় । রাসেলকে অমন করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হাসুপা হাসলেন , কিরে রাসু কি হয়েছে ? কিছু বলবি ?
হাসু আপা রাসেলকে আদর করে রাসু বলে ডাকে। হাসু আপা যে রাসেল কে আদর করে রাসু বলে ডাকেন মা সেটা পছন্দ করেন না । মা হাসুকে বলেন, তোর বাবা যদি শোনে তুই রাসেলকে রাসু বলে ডাকিস তাহলে খুব রাগ করবেন কিন্তু ।
ওমা ! হাসুর ভাই তো রাসুই হবে নাকি !
আমি আমার ছোট ভাইকে আদর করে রাসু বলে ডাকবো । বাবা শুনলে দেখবে রাগ করবে না। হাসুপার কথায় মা আর কথা বাড়াননি । মা ভাবেন রাসেলের বাবা রাসু ডাকটা শুনলে কি রাগ করবেন ! না , মনে হয় রাগ করবেন না -মা মনে মনে ভাবেন । এছাড়া মা জানেন , বাড়িতে রাসেল তার কথা ছাড়া একমাত্র হাসুর কথা শোনেন । মানেন । সারাক্ষণ রাসেল খালি হাসু আপার পেছন পেছন ঘুর ঘুর করে । হাসু আপার নয়নের মনি যেন রাসেল।
রাসেল হাসুপার ঘরের দরোজার সামনে কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
রাসেল কি বলবে ! হাসু আপা দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা রাসেলের দিকে তাকিয়ে আছেন। হাসু আপা ঠোঁটের কোণে আলতো একটা হাসি ঝুলিয়ে রাসেলকে ভালো করে দেখছেন আর ভাবছেন মাত্র কয়েক বছর আগে ওর জন্ম হয়েছে এই ঘরে । একতলা বাড়ির উত্তর পূর্ব দিকের ছোট্ট একটা ঘর।
বাবা সারাদিন বাইরে বাইরে থাকেন। কখনো জেলে। কখনো পালিয়ে। জন্মের পর রাসেল বাবাকে খুব কাছে থেকে কমই দেখেছে। সারাক্ষণ হাসু পা , রেহানা আপা আর বড় দুই ভাই কামাল আর জামালকে দেখেছে। অথচ দেখতে দেখতে সেই ছোট্ট রাসেল ইউক্যালিপটাসের মত কেমন তর তর করে বড় হয়ে যাচ্ছে। এই সকালবেলার কচি রোদকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে থাকা রাসেল কে দ্যাখে হাসুপার মনে হয় , তাহলে রাসেল কি ইউক্যালিপটাস !
হাসুপা রাসেল কে দেখছেন। রাসেল কি হাসু আপাকে বলবে , একটা বুড়োমত লোক কাঁঠালিচাঁপার চারা নিয়ে সাতসকালে ওদের বাড়ি এসে হাজির হয়েছে ।
রাসেল চুপচাপ হাসুপার ঘরের দরজায় সকালবেলার রোদ আটকে দিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে হাসুপাকে দেখতে থাকে। রাসেল হাসুপাকে বলল , বাড়িতে এক বুড়ো এসেছে কাঁঠালিচাঁপার চারা নিয়ে ।
তাই নাকি !
হ্যাঁ ।
ভালো তো আমরা কাঁঠালিচাঁপার গন্ধ পাবো । জানিস এই ফুলের গন্ধ না আমার খুব ভাল লাগে । রাসেল হাসুপার বিছানায় গিয়ে বসে । সকাল বেলার রোদ হাসুপার ঘরে আলোর বন্যা তৈরি করে । সেই আলোর বন্যাতে হাসুপা রাসেলকে কবিতা শোনায়,
‘ তাল গাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে
সব গাছ ছাড়িয়ে
উঁকি মারে আকাশে ।
মনে সাধ, কালো মেঘ ফুঁড়ে যায়
একেবারে উড়ে যায় ;
কোথা পাবে পাখা সে ।’
তিন।।
দুপুরে ভাত খেয়ে বুড়ো যখন বিদায় নিয়ে চলে যাচ্ছিল তখন বাড়ির বারান্দা থেকে হাসুপা আর রাসেল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাকে দেখছিল। বুড়ো বাড়ির দরোজার কাছাকাছি গিয়ে হঠাত কি মনে করে পেছন ফিরে তাকাল। রাসেলকে দেখে বুড়োর চোখ আটকে গেল। এতো মায়াভরা চোখ সে অনেকদিন ধরে দেখে না ।অদ্ভুত মায়ার আঁধার যেন ছোট্ট রাসেল। রাসেল বুড়োর দিকে এমনভাবে তাকিয়েছিল যে বুড়ো বেশ অবাক হয়ে গেল। বুড়োর মনে হল রাসেলের দৃষ্টি যেন তার বুকের ভেতরটাকে কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছিল । বুড়ো খুব বিস্মিত হল। বুড়ো দাঁড়িয়ে পড়ল। পেছন ফিরে তাকাল।
বাড়ির বারান্দায় ফজিলাতুন্নেসা , হাসুপা আর ছোট্ট রাসেল দাঁড়িয়ে আছে । তখনো রাসেল এক দৃষ্টিতে বুড়োর দিকে তাকিয়ে আছে। ছেলেটার চাহনিতে কি যেন আছে ! কি আছে ! বুড়ো হেঁটে হেঁটে আবার বাড়ির ভেতরে ফিরে আসে। চারদিকের গাছপালা থেকে নেমে আসা একটা হিম ভাব তার শরীরকে নুইয়ে দিচ্ছিল। বুড়ো এসে দাঁড়ালেন মার সামনে ।
মা বললেন , চাচা কি কিছু বলবেন?
বুড়ো তখন রাসেলের দিকে তাকিয়ে মাকে বললেন ,আম্মা ,আপনে আমারে দিয়া খামাখা কষ্ট করায়া কাঁঠালিচাঁপার চারা আনাইছেন । বুড়োর কথা শুনে মা বেশ অবাক হয়ে বললেন , খামাখা কেন ? আপনে কি বলেন এইসব !
আপনের বাড়িতে তো এই গাছ আছেই বলে বুড়ো মুখে একটা হালকা হাসি ধরে রাখল।
আপনে যে কি কন ? আমার বাড়িতে কাঁঠালিচাঁপার গাছ থাকলে কি আমি আপনেরে দিয়া কষ্ট করায়া টুঙ্গিপাড়া থেকে গাছের চারা আনাই?
রাসেল হাসুপার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে । হাসুপা রাসেলকে নিজের শরীরের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে রাখে। রাসেলটাও হয়েছে একশভাগ বোন-নেওটা। সারাক্ষণ শুধু হাসুপার সঙ্গে লেপটে থাকবে। রাসেল বুড়োর কথা শুনে হেসে দিয়ে হাসুপাকে বলল , হাসুপা দেখেছো লোকটা কি বলে ! আমাদের বাড়িতে নাকি কাঁঠালিচাঁপার গাছ আছে বলে রাসেল মিটমিট করে হাসুপার শরীরে লেগে থাকে ।
হাইসেন না হাইসেন না খোকা বলে বুড়ো ফোকলা দাঁত বের করে হি হি করে হাসতে থাকে। আমার নাম খোকা না আমার নাম রাসেল। বোঝা গেল নাম ভুল বলায় বুড়োর ওপর রাসেল বেশ অভিমান করেছে। আপনের বাবারেও আমি হের ছোটবেলায় খোকা নামে ডাকছি – হেই অভ্যাস অহনো যায় নাই বলে বুড়ো তার হাসিটা মুখে ধরে রাখে।
বুড়োর হাসি দেখে মা ব্যাপারটা ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না। মা হাসুপার দিকে তাকান। মার দেখাদেখি রাসেলও হাসুপার দিকে তাকাল। এই বাড়িতে কাঁঠালিচাঁপার গাছ ! আমি দেখলাম না । আপনে কই থিকা দেখলেন?
আম্মা , চোখ থাকলেই দেখন যায় বলে বুড়ো রাসেলের দিকে হাত দিয়ে দেখায়। হাসুপা চোখ বড় বড় করে একবার বুড়োর দিকে তাকান , একবার রাসেলের দিকে তাকান।
আর তখন এক আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটে যায়। কোত্থেকে একটা অদ্ভুল সুন্দর গন্ধ পুরো বাড়িটাকে ছেয়ে ফেলতে থাকে। ফজিলাতুন্নেসা ,তার বড় মেয়ে হাসু আর তার দশ বছরের ছোট্ট ছেলে সেই অদ্ভুত সুন্দর গন্ধের ভেতর ডুবে যেতে থাকেন।
আর তখন তাদের সামনে দিয়ে বুড়ো হেঁটে হেঁটে দূরবর্তী হয়ে বাড়ির দরোজা অতিক্রম করে কোথায় যে হারিয়ে যান !
চার ।।
হাসুপা এখনো সেই গন্ধটা পান । কোত্থেকে একটা গন্ধ তার মাথার ভেতর ভন ভন করে ঘোরে । আর যখন সেই গন্ধটা তার ভেতরে খেলা করে তখন তিনি টের পান তার আশেপাশে কেউ একজন এসে দাঁড়িয়েছে । সেই কেউ একজনটাকে ঠিকমত দেখা যায় না। একটা ছায়ার মত ছায়ার অনুভব পান তিনি। হাসুপা ছায়াটা দেখতে পান না কিন্তু একটা আবছা অনুভূতি তাকে ছুঁয়ে যায়। আবছা অন্ধকারের ভেতর থেকে কেউ একজন ফিস ফিস করে বলে, হাসুপা তুমি ভাল আছো ? কতোদিন তোমার ঘ্রাণ পাই না ! কতোদিন তোমার আদর পাই না।
হাসুপার ঠোঁট কেঁপে কেঁপে ওঠে। চোখ ভারি হয়ে ওঠে । তিনি টের পান তার সামনে থাকা সব কিছু কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে । কেমন !-চ্যানেল আই
১৮ অক্টোবর,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এইচএস/কেএস