গাফফার খান চৌধুরী ॥ সিলেটে ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ হত্যা রহস্য উদঘাটিত হয়েছে। পবিত্র ইসলাম ধর্মের অনুভূতিতে আঘাত দেয়ায় বিজয়কে হত্যা করা হয়। হত্যার পরিকল্পনা হয় দেড় মাস আগে। বাড়িতে ও ব্যাংকে একাধিকবার হত্যার চেষ্টা হয়। কিন্তু সেসব চেষ্টা ব্যর্থ হয়। শেষ পর্যন্ত বাসার সামনেই হত্যা করা হয় বিজয়কে। হত্যাকাণ্ডে ৫ জন অংশ নেয়।
এদের মধ্যে মূলত ২ জন গ্রেফতার হয়েছে। যদিও সবিমিলিয়ে এখন পর্যন্ত ৪ জন গ্রেফতারকৃত অবস্থায় রয়েছে। আরও কয়েকজনকে বিজয় হত্যায় শ্যোন এরেস্ট দেখানোর আবেদন করা হয়েছে, বৃহস্পতিবার র্যাব রাজধানীর ফকিরাপুল থেকে ৩ জনকে গ্রেফতার করেছে। এরা হচ্ছে, আবুল বাশার, জুলহাস বিশ্বাস ও জাফরান আল হাসান। এ ৩ জনও অভিজিত হত্যা মামলার আসামি।
হত্যাকারীরা পরস্পর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও একই আদর্শে বিশ্বাসী। ২ জন কুপিয়ে বিজয়কে হত্যা করে। অপর ৩ জনের মধ্যে দুইজন ঘটনাস্থলে কেউ যাতে না আসতে পারে, সেই দায়িত্ব পালন করে। অপরজন মোবাইল ফোনে হত্যাকা-ের পুরো দৃশ্য ভিডিও করে। হত্যার পর যে দুইটি মোটরসাইকেলে তারা আসে, তাতে করেই দ্রুত চলে যায়। এর মধ্যে হত্যাকাণ্ডে জড়িত একজন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। জবানবন্দী এবং সিআইডির তদন্তে বেরিয়ে এসেছে বিজয় হত্যার পুরো রহস্য।
গত ১২ মে মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৮টায় সিলেট নগরীর সুবিদবাজার এলাকার নূরানী পুকুরপাড়ে বিজয়কে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। তিনি সুবিদবাজারের বনকলাপাড়ার নূরানী এলাকার ১২/১৩ নম্বর বাড়িতে পরিবারের সঙ্গে বসবাস করতেন। ঘটনাস্থল থেকে অনন্তর বাড়ি ৩০ থেকে ৪০ গজ দূরে।
সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করেন বিজয়। এরপর কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন পূবালী ব্যাংক লিমিটেডে। সিলেটের লাউয়াবাজারে অবস্থিত পূবালী ব্যাংক শাখায় কর্মরত ছিলেন।
প্রতিদিনের মতো ওইদিন বাসের জন্য যথারীতি হেঁটে বাসা থেকে প্রায় হাজার গজ দূরের স্টেশনে যাচ্ছিলেন। নুরানী পুকুরপাড়ে গেলে ঘটনাটি ঘটে। এ ব্যাপারে অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে পরিবারের তরফ থেকে মামলা দায়ের করা হয়। মামলাটির তদন্ত চলছে ঢাকার মালিবাগে অবস্থিত সিআইডি সদর দফতর থেকে।
সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, বিজয় হত্যায় প্রথম গ্রেফতার হয় এক ফটোসাংবাদিক ইদ্রিস আলী। তার বাড়ি সিলেটের ফতেহপুর এলাকায়। তার পিতা বিএনপি নেতা। পাশাপাশি একটি ইউনিয়ন পরিষদের ৪ বারের নির্বাচিত মেম্বার। ইদ্রিসরা দুই ভাই। ইদ্রিস বড়। তার শিক্ষাজীবন শুরু মাদ্রাসা থেকে। আলিম (উচ্চ মাধ্যমিক) পর্যন্ত পড়াশোনা করলেও পাস করতে পারেননি। তিনি ইসলামী ছাত্রসেনা নামের একটি সংগঠনের সক্রিয় কর্মী। রাজনীতির পাশাপাশি তিনি পেশা হিসেবে ফটোসাংবাদিকতাকে বেছে নিয়েছেন।
ইদ্রিস আলীর পর গত ২৭ আগস্ট সিলেট থেকে মান্নান ইয়াহিয়া (২৪) ও তার ভাই মোহাইমিন নোমানকে (২১) গ্রেফতার করে সিআইডি। দুই ভাই ইসলামী ছাত্র মজলিশের সক্রিয় সদস্য। গ্রেফতারকৃত সহোদর সিলেটের কানাইঘাটের পূর্বপালজুড় গ্রামের হাফিজ মইনউদ্দীনের ছেলে।
হত্যাকা-ের আগে মান্নান ইয়াহিয়া নাম পরিবর্তন করে মান্নান রাহী এবং হত্যাকাণ্ডের পরে ইবনে মাইউন নামে ফেসবুকে লেখালেখি করতেন। মান্নান ইয়াহিয়া সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগ থেকে অনার্স পরীক্ষা দিয়েছেন। তার ভাই মোহাইমিন নোমান সিলেটের এমসি (মুরারী চাঁদ) কলেজের ইসলামিক শিক্ষা বিভাগের ছাত্র।
সহোদরদের দেয়া তথ্যমতে, গত ২ সেপ্টেম্বর গ্রেফতার সিআইডির হাতে হয় আবুল খায়ের (২২)। তার বাড়ি সিলেটের কানাইঘাটে। তিনি সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষ সম্মান শ্রেণীর ছাত্র। তাকে দ্বিতীয় দফায় ৭ দিনের রিমান্ডে নিয়ে ঢাকার সিআইডি সদর দফতরে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তিনি সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিবিরের সক্রিয় কর্মী। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে মান্নান ইয়াহিয়া আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন।
সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, মান্নানের জবানবন্দীতে বিজয় হত্যার বিষয়টি প্রায় শতভাগ পরিষ্কার হয়ে গেছে। হত্যাকা-ের রহস্যও উদ্ঘাটিত হয়েছে। মান্নানের জবানীতে প্রকাশ পেয়েছে বিজয় হত্যার পুরো ঘটনা প্রবাহ। জবানবন্দী মতে, অনন্ত মুক্তমনা ব্লগে আগে থেকেই লেখালেখি করতেন। তার লেখালেখি বন্ধ করতে গ্রেফতারকৃত মান্নান রাহীর (প্রকৃত নাম মান্নান ইয়াহিয়া) সঙ্গে ফেসবুকে অনেক আগে থেকেই কথা হচ্ছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অনিয়মিত ছাত্র এবং ছাত্র শিবিরের সাবেক সক্রিয় কর্মী শফিউর রহমান ফারাবীর।
ফারাবী ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানীতে খুন হওয়া ব্লগার প্রকৌশলী আহমেদ রাজীব হায়দার শোভনের জানাজা আদায়কারী ইমামকে হত্যার হুমকিদাতা হিসেবে গ্রেফতার হয়ে আলোচনা আসে। বর্তমানে অভিজিত হত্যা মামলার সন্দেহভাজন আসামি হিসেবে গ্রেফতার রয়েছে।
ফারাবীর সঙ্গে মান্নান রাহী নিহত অনন্তর লেখালেখির বিষয়ে কী করা যায়, তা নিয়ে ফেসবুকে কথা হয়। এমন বিষয়ে মান্নান ইয়াহিয়া ফেসবুকে ফারাবীর কাছে অনন্তর লেখালেখি বন্ধ করতে কী করা যায়, তা জানতে চায়। উত্তরে লেখা হয়, অনন্তকে থাবা বাবার পরিণতি স্মরণ করিয়ে দিলেই হয়!
প্রসঙ্গত, ব্লগার রাজীব থাবা বাবা নামের একটি ব্লগে লেখালেখি করতেন। সেই লেখালেখির সূত্রধরেই হত্যা করা হয় ব্লগার রাজীবকে।
সিআইডি বলছে, অনন্ত হত্যা ত্বরান্বিত হয় চলতি বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক প্রকৌশলী লেখক ও মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা ড. অভিজিত রায় হত্যার পর। অভিজিতকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে রাত ৯টার দিকে ২ যুবক চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। অভিজিত হত্যার পর ব্লগে অনন্ত ব্যাপক লেখালেখি করতে থাকেন। লেখালেখি থামাতেই অনন্তকে হত্যার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়।
সিআইডি সূত্র বলছে, দেড় মাস আগে অনন্তকে হত্যার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। হত্যাকা-ে অংশ নেয় ৫ জন। যদিও এখন পর্যন্ত গ্রেফতারকৃত ৪ জনের মধ্যে সরাসরি হত্যাকা-ে জড়িত মান্নান ইয়াহিয়া ও আবুল খায়েরের জড়িত থাকার অকাট্য প্রমাণ মিলেছে। সরাসরি জড়িত দুইজনের মধ্যে মান্নান ইয়াহিয়া হত্যার দায় স্বীকার করে ইতোমধ্যে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীও দিয়েছে।
মান্নানের জবানবন্দীর বরাত দিয়ে সিআইডির এক উর্ধতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে জানান, অনন্তকে দেড় মাস ধরেই হত্যার চেষ্টা চলছিল। হত্যাকারীরা পরস্পর বন্ধু। সবার বাড়িই সিলেটে। এর মধ্যে চারজনের বাড়িই সিলেটের কানাইঘাটে। অপরজনের বাড়ি সিলেট জেলার কানাইঘাটের পাশের একটি থানায়। হত্যাকারীরা সবাই ছাত্র। এদের মধ্যে একজন সিলেট শহরে অবস্থিত একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র। বাকি চারজনই সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।
হত্যাকারীরা অনন্তকে তার বাসায় ও ব্যাংকে এবং তার আশপাশে একাধিকবার হত্যার চেষ্টা করে। কিন্তু মিশন ব্যর্থ হয়। এরপর ব্যাংকে যাওয়ার পথেই অনন্তকে নূরানী পুকুরপাড়ে হত্যার সিদ্ধান্ত হয়। পরিকল্পনা মোতাবেক ঘটনার দিন ২টি মোটরসাইকেলযোগে ৫ হত্যাকারী ঘটনাস্থলের উদ্দেশ্যে একত্রে রওনা হয়। ৫ জনের মধ্যে ৩ জনের কাছে কালো ব্যাগ ছিল। সেই ব্যাগেই ছিল হত্যাকা-ে ব্যবহৃত চাপাতি।
মোটরসাইকেল ২টি ঘটনাস্থল থেকে ১০ থেকে ১২ গজ দূরে রাখা হয়। তারা মোটরসাইকেল থেকে নেমে দাঁড়িয়ে থাকে। অনন্ত পুকুরপাড়ে পৌঁছামাত্র ৫ জন তাকে ঘিরে ফেলে। চাপাতি দিয়ে মাথায় ও ঘাড়ে কুপিয়ে দুইজনে অনন্তকে হত্যা করে। বাকি তিনজন অনন্তকে যেখানে হত্যা করা হয়, সেখান থেকে মাত্র ৫ থেকে ৬ গজ দূরে অবস্থান করতে থাকে। তারা সেখানে থাকা রাস্তার মুখে অবস্থান নেয়।
যাতে কেউ অনন্তকে যেখানে কুপানো হচ্ছে, সেখানে যেতে না পারে। দুইজন চারদিকে সতর্ক নজর রাখে। একজন অনন্তকে কুপিয়ে হত্যার দৃশ্য মোবাইল ফোনে ভিডিও করে। মাত্র কয়েক মিনিটেই কুপিয়ে অনন্তর মৃত্যু নিশ্চিত করার পর, তারা চাপাতি ব্যাগে ভরে সেই মোটরসাইকেলযোগেই দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। যে দুইজন কুপিয়ে অনন্তকে হত্যা করে, তার মধ্যে আবুল খায়ের অন্যতম।
মামলাটির তদন্তকারী সংস্থা সিআইডির সংঘবদ্ধ অপরাধ বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার মীর্জা আবদুল্লাহেল বাকী জনকণ্ঠকে বলেন, অনন্ত বিজয় হত্যায় ৫ জনের জড়িত থাকার তথ্য মিলেছে। এদের মধ্যে ২ জন সরাসরি কুপিয়ে অনন্তকে হত্যা করে। বাকি ৩ জন ঘটনাস্থলে যাতে কেউ না যেতে পারে, এ জন্য পথ আগলে সতর্ক পাহারায় ছিল। এ ৩ জনের একজন অনন্তকে হত্যার পুরো দৃশ্য মোবাইল ফোনে ভিডিও করে।
ইতোমধ্যেই মান্নান ইয়াহিয়া আদালতে ১৬৪ ধারায় হত্যার দায় স্বীকার করে জবানবন্দী দিয়েছে। জবানবন্দীতে দেয়া তথ্য যাচাইবাছাই করে দেখা হচ্ছে। তদন্তের স্বার্থে সরাসরি কুপিয়ে হত্যাকারী দুইজনের নাম প্রকাশ করা যাচ্ছে না। সহসাই হত্যাকা-ে ব্যবহৃত মোটরসাইকেল ২টি এবং ভিডিওটি উদ্ধার করা সম্ভব হবে বলে আশা করছি। ইসলাম ধর্মের অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার কারণেই অনন্তকে হত্যা করা হয়েছে বলে তদন্তে প্রায় শতভাগ নিশ্চিত হওয়া গেছে। মামলার পলাতক অন্য আসামিদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে। হত্যাকা-ের নেপথ্যে আরও কোন কারণ আছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সূত্র : জনকন্ঠ
১১ সেপ্টেম্বর ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি