বৃহস্পতিবার, ২০ অক্টোবর, ২০১৬, ০২:২১:৩৬

উগ্রবাদী আত্মীয় ও বন্ধুই সর্বনাশের মূল কারণ

উগ্রবাদী আত্মীয় ও বন্ধুই সর্বনাশের মূল কারণ

নিউজ ডেস্ক : ঢাকা জেলার দোহারের আউলিয়াবাদ গ্রামের সন্তান শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. রোকন উদ্দিন খন্দকার। ডা. রোকন কয়েক বছর আগে নিজ গ্রামে একটি হাসপাতাল করার উদ্যোগ নেয়। হাসপাতালের সীমানা প্রাচীর ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনও করা হয়েছিল। এরপর দুই বছর সে আর গ্রামে যায়নি।

ভিত্তিপ্রস্তরের আগে সে গ্রামবাসীকে বলত এই হাসপাতালে বিনামূল্যে তাদের চিকিৎসাসেবা দেয়া হবে। তার পুরো পরিবার জঙ্গিবাদে জড়িয়ে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেটের (আইএস) নিয়ন্ত্রণাধীন সিরিয়ার রাকায় চলে যাওয়ায় হাসপাতালটি আর করা হল না।

গ্রামবাসীর দীর্ঘদিনের স্বপ্নও আর পূরণ হল না। শুধু তার পরিবারের পাঁচ সদস্যই নয়, জঙ্গিবাদে জড়িয়ে অনেক পরিবার কথিত জিহাদের নামে ঘরছাড়া হয়েছে। আজিমপুরের আস্তানা থেকে গ্রেফতার হওয়া তিন নারী তাদের সন্তানসহ নিজের স্বামীর সঙ্গে ঘর ছেড়েছে।

জঙ্গিবাদে জড়িয়ে ঘর ছেড়ে গত ফেব্রুয়ারিতে নিরুদ্দেশ হয় তিন বন্ধু নিবরাস ইসলাম, শেহজাদ রউফ ওরফে অর্ক ও তাওসিফ হোসেন। তাদের মধ্যে নিবরাস গুলশানে হলি আর্টিজানে হামলার পর কমান্ডো অভিযানে নিহত হয়। পরে কল্যাণপুরের অভিযানে শেহজাদ রউফ অর্ক ও নারায়ণগঞ্জের অভিযানে তাওসিফ হোসেন নিহত হয়।

জঙ্গি দমনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, উগ্রবাদী আত্মীয় ও বন্ধুই সর্বনাশের মূল কারণ। এই দুই সম্পর্কের মাধ্যমেই ৯০ শতাংশ জঙ্গি সংগঠনে রিক্রুট হচ্ছে।

পুলিশের জঙ্গি দমনে বিশেষায়িত বিভাগ কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারি ও কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার ঘটনা তদন্তে গোয়েন্দাদের হাতে উগ্রপন্থীদের বিষয়ে যেসব তথ্য-উপাত্ত এসেছে তা বিশ্লেষণ করে জঙ্গি নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠার বিষয়ে অনেক তথ্য পাওয়া গেছে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও এই প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। বিশেষ করে পশ্চিমা গবেষণাগুলোতে দেখা গেছে, চার ধরনের সম্পর্ক কাজে লাগিয়ে জঙ্গিরা বিভিন্ন ব্যক্তিকে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করে। এর মধ্যে আত্মীয়তা (কিনশিপ) ও বন্ধুত্বের (ফ্রেন্ডশিপ) সম্পর্ককেই বেশি কাজে লাগানো হয়। মেন্টরশিপ বা শিক্ষকের প্রভাব ও ডিসাইপলশিপ বা গুরুর মাধ্যমে অনেকে জঙ্গিবাদে জড়ায়।

কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান ও ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, পশ্চিমা দেশগুলোর বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে- বিশ্বের উগ্রবাদী সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো চার ধরনের সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে মানুষকে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করে থাকে। এর মধ্যে আত্মীয় ও বন্ধুর মাধ্যমে প্রভাবিত হয় অধিকাংশ মানুষ। বাংলাদেশের জঙ্গি সংগঠনগুলোও একই প্রক্রিয়ায় মানুষকে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করে।

জঙ্গি দমন ইউনিটের দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, বাংলাদেশে এ নিয়ে কোনো গবেষণা নেই। তবে উগ্রপন্থায় জড়ানো ব্যক্তিদের অধিকাংশই বন্ধু ও আত্মীয়ের মাধ্যমে জঙ্গিবাদে জড়িয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে উগ্রপন্থার ‘বায়াত’ নিয়ে কথিত হিজরতের নামে ঘরছাড়া অধিকাংশ তরুণ বন্ধুর মাধ্যমে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়েছে।

অনেকেই আবার আত্মীয়ের মাধ্যমে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়েছে। নিউ জেএমবির চারজন নারীর বিষয়ে তথ্য পাওয়া গেছে যারা গুলশানের হলি আর্টিজানের হামলার বিষয়ে জানত। এদের মধ্যে তিনজনকে ১০ সেপ্টেম্বর আজিমপুরের আস্তানা থেকে পুলিশ গ্রেফতার করে। তারা হল আজিমপুরে পুলিশের অভিযানের সময় নিহত জঙ্গি তানভির কাদেরি ওরফে আবদুল করিমের স্ত্রী আবেদাতুল ফাতেমা ওরফে খাদিজা, জঙ্গি বাসারুজ্জামানের স্ত্রী শায়লা আফরিন এবং গুলশান হামলার অপারেশন কমান্ডার আফরিন ওরফে প্রিয়তি। তারা সম্প্রতি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। তারা স্বীকার করেছে, স্বামীর মাধ্যমে উগ্রবাদে জড়িয়ে তারা ঘর ছেড়েছে। এখন এ নিয়ে তারা অনুতপ্ত।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশীদ বলেন, উগ্রবাদী মতাদর্শের প্রাথমিক সাক্ষাতের বিষয়ে চারটি মাধ্যম আমরা চিহ্নিত করেছি। পরিবার, বন্ধু, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক এবং কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে তারা জঙ্গিবাদের বিষয়ে প্রথম ধারণা পেয়ে থাকে। আত্মীয় ও বন্ধুদের সঙ্গে সাধারণত ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ থাকে। তাই এই দুটি মাধ্যমেই বেশি প্রভাবিত হয়।

উগ্রপন্থী আত্মীয় ও বন্ধুতেই সর্বনাশ : জঙ্গিবাদে জড়িয়ে গত আগস্টে মিরপুরের মনিপুর থেকে নিখোঁজ দুই তরুণ আহমেদ রাফিদ আল হাসান ও আয়াদ হাসান খান সম্পর্কে খালাতো ভাই। ধনাঢ্য পরিবারের এ দুই তরুণ এ-লেভেল পাস। তারা দূরসম্পর্কের মামা ও পূর্ব মনিপুরের বাসিন্দা আরেফিন ইসলামের মাধ্যমে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে এখন কোনো জঙ্গি ডেরায় অবস্থান করছে।

বারিধারার দুই ভাই ইব্রাহীম হাসান খান ও জুনায়েদ হাসান খান এক বছর আগে কথিত হিজরতের নামে ঘর ছেড়েছে। জুনায়েদ ভারতে এবং ইব্রাহীম সিরিয়ায় অবস্থান করছে। তাদের খালাতো ভাই সামিহ মোবাশ্বের গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলাকারীদের একজন।

ঢাকা শিশু হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. রোকনউদ্দিন স্ত্রী নাইমা আক্তার, দুই মেয়ে রেজওয়ানা রোকন ও রামিতা রোকন এবং রেজোয়ানার স্বামী সাদ কায়েসও রয়েছে।

স্পেনে অবস্থান করা মোহাম্মদপুরের জঙ্গি আতাউল হক সবুজ কয়েক বছর আগে গোপালগঞ্জের সায়েমা আক্তার মুক্তাকে বিয়ে করে। পরে তার ভাইয়ের সঙ্গে শ্যালিকা রাবেয়া আক্তার টুম্পাকে বিয়ে দেয়। সবুজের ভাই সাইফুল হক সুজন সিরিয়ায় নিহত হয়েছে। জঙ্গিদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে গিয়ে গ্রেফতার হয়ে সবুজের বাবা আবুল হাসনাত এখন কারাগারে।

এদিকে সম্প্রতি জঙ্গিবাদের অন্ধকারের পথ থেকে ফিরে আসা তরুণ আবদুল হাকিম তার বন্ধু খায়রুল ইসলাম পায়েলের মাধ্যমে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে ঘর ছেড়েছিল। পায়েল গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলাকারীদের একজন।

দুই মাসের ব্যবধানে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে নিহত হয় তিন বন্ধু নিবরাস ইসলাম, শেহজাদ রউফ ওরফে অর্ক ও তাওসিফ হোসেন। তারা তিনজন গত ফেব্রুয়ারিতে শাহবাগ থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে করা একটি মামলারও আসামি। নিবরাস ও তাওসিফ দু’জনই মালয়েশিয়ার মোনাস বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। দু’জনই একদিনে একই ফ্লাইটে দেশে ফেরে। তাদের আরেক বন্ধু শেহজাদ ছিল নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির ছাত্র। নিবরাস মালয়েশিয়ায় যাওয়ার আগে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির ছাত্র ছিল। তখন থেকে শেহজাদের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয়।  সূত্র : যুগান্তর

১৯ অক্টোবর ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে