নিউজ ডেস্ক : আর মাত্র ২ দিন বাদেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জাতীয় ত্রিবার্ষিক সম্মেলন। এ সম্মেলনকে ঘিরে নতুন নেতৃত্ব বেরিয়ে আসবে এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন দলের নীতিনির্ধারকরা। এদিকে, শেষবেলায় নতুন নেতৃত্বে বেশ কিছু চমকও থাকতে পারে।
আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে সেই চমক নিয়ে চলছে নানা হিসাব-নিকাশ। কারা আসছেন আর কারা বাদ পড়ছেন- এ নিয়ে আলোচনা এখন দলের ভেতরে-বাইরে।
এরই মধ্যে দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে আওয়ামী লীগের ৫ নেতাকে নিয়ে। ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইসমত কাদের গামা, আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের (আইপিইউ) সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী, নারায়ণগঞ্জের সংসদ সদস্য শামীম ওসমান, ছাত্রলীগের সাবেক নেতা মুকুল বোস এবং বগুড়ার এমপি আব্দুল মান্নান।
এদিকে, আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলন মানেই দলের নেতৃত্বে নতুন মুখ আসা। আগামী ২২ ও ২৩ অক্টোবরের জাতীয় সম্মেলনকে ঘিরে তাই পদপ্রত্যাশীরা আশাবাদী হয়ে উঠেছেন, করছেন দেন দরবার। এদের একজন ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইসমত কাদের গামা।
কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটিতে নতুন যারা স্থান পান তারা বরাবর ছাত্রলীগ, যুবলীগ বা আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের সাবেক নেতা। এই বিবেচনায় গামাও বিবেচনায় আছেন বলে জানা যায় আওয়ামী লীগের নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্রে।
স্বাধীনতার পর ছাত্রলীগ থেকে বের হয়ে সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজের নেতৃত্বে গঠিত হয় জাসদ ছাত্রলীগ। এসময় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান গামা। দায়িত্ব পেয়ে সংগঠন গোছানোর কাজ সফলতার সঙ্গেই করেন এই মুক্তিযোদ্ধা।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে খুনিদের বিচারের দাবিতে আন্দোলন সংগ্রামেও অগ্রসৈনিক ছিলেন গামা। কিন্তু পরে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে অনেকটাই পিছিয়ে পড়েন তিনি। তবে দলে পদ না পেলেও রাজনীতিতে বরাবরই সক্রিয় ছিলেন গামা।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির পদে না থাকলেও মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন ইসমত কাদের। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি জোরাল করার আন্দোলনেও সক্রিয় ছিলেন তিনি।
অপরদিকে, প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার আস্থাভাজন হিসেবেই পরিচিত ছিলেন সাবের হোসেন চৌধুরী। কিন্তু ২০০৭ সালে এক এগারোর পট পরিবর্তনের পরের নানা ঘটনাপ্রবাহে সেই আস্থায় সাময়িক চিড় ধরেছিল দলের নেত্রীর। আর এর ফলে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলেও সরকারে কোনো পদ পাননি সাবের চৌধুরী।
ভদ্র রাজনীতিক হিসেবে একটি স্বচ্ছ ভাবমূর্তি আছে তার। ক্রীড়া সংগঠক হিসেবেও বেশ জনপ্রিয় তিনি। এক পর্যায়ে কাছাকাছি আসেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বিরোধীদলীয় নেতা থাকাকালে শেখ হাসিনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কই ছিল সাবের হোসেনের। দলীয় সভাপতিও তাকে যে দায়িত্ব দিয়েছেন তা সাফল্যের সঙ্গেই পালন করেছিলেন তিনি। আর নেত্রীর আস্থার ফলস্বরূপ তিনি তখন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকও মনোনীত হন।
সাংগঠনিক সম্পাদক পদেও নিজের দক্ষতার প্রমাণ দেন সাবের চৌধুরী। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ যখন বিরোধী দলে ছিল তখন আন্দোলনেও সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল তার।
তবে এক এগারোর পর তার ওপর রাখা আস্থার প্রতিদান দিতে পারেননি সাবের। ফলশ্রুতিতে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের ১৮তম জাতীয় সম্মেলনের পর বাদ পড়েন সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ থেকে। ২০১২ সালের ২৯ ডিসেম্বরের সম্মেলনেও তাকে কোনো পদে রাখা হয়নি।
এদিকে, আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা বলছেন, টানা দুই সম্মেলনে দলের পদে না থাকলেও এবারের সম্মেলনে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আসতে পারেন সাবের চৌধুরী।
উল্লেখ্য, ১৯৯৬ সালে ঢাকা-৬ নির্বাচনি আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন সাবের হোসেন চৌধুরী। তৎকালীন মন্ত্রিসভার সর্বকনিষ্ঠ সদস্য ছিলেন তিনি। ওই সময় তাকে দেওয়া হয় নৌপরিবহন উপমন্ত্রীর। দায়িত্ব পালনে সফলতার পরিচয় দেওয়ায় পরে তাকে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়।
শুধু রাজনীতিতে নয়, তিনি অবদান রেখেছিলেন খেলাধুলার উন্নয়নেও। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি ছিলেন তিনি। তার দূরদর্শী নেতৃত্বে ২০০০ সালের জুন মাসে আইসিসির পূর্ণ সদস্য পদ এবং টেস্ট স্ট্যাটাস প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেট পৌঁছে ছিল অনন্য উচ্চতায়।
২০১৪ সালে ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের (আইপিইউ) সভাপতি নির্বাচিত হন সাবের চৌধুরী। তিন বছর তিনি এ ফোরামের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। সাবের চৌধুরী অস্ট্রেলীয় পার্লামেন্টের স্পিকার ব্রডউইন বিশপকে ১৭৫-৬৫ ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে আইপিইউর সভাপতি নির্বাচিত হলেন। ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের গত ২৭ বছরের ইতিহাসে এটি সর্বোচ্চ ভোটের ব্যবধানে বিজয়। সাবের হোসেন চৌধুরী হলেন আইপিইউর ২৮তম সভাপতি।
তবে হঠাৎ করেই আলোচনায় চলে এসেছেন নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের নাম। তার রাজনৈতিক অনুসারী-অনুগামীরা ধরে নিয়েছিলেন, নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হতে যাচ্ছেন তিনি। কিন্তু গত রোববার জেলার আংশিক কমিটি অনুমোদনের পর তাকে জেলা কমিটির কোথাও না রাখায় অনেকে মনে করেছেন- দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে আসতে পারেন তিনি।
নারায়ণগঞ্জের প্রভাবশালী ওসমান পরিবারের উত্তরসূরি নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য শামীম ওসমান জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ছিলেন শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকও। ১৯৯৬ সালে নৌকা প্রতীকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০০১ সালে বিএনপি জোট ক্ষমতায় আসার পর দেশ ছাড়তে হয়েছিল তাকে।
আগামী ২২-২৩ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় সম্মেলন। সম্মেলনকে কেন্দ্র করে শামীম ওসমানকে ঘিরে প্রত্যাশাও বাড়ছে। তার ঘনিষ্ঠ একাধিক ব্যক্তি বলেন, নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের শামীম ওসমান দাপুটে একজন রাজনীতিকের নাম। জেলার গুরুত্বপূর্ণ পদে না থাকলেও রাজনীতিতে তার সক্রিয় প্রভাব থাকবে আগের মতোই। তবে তারা আশাবাদী কেন্দ্রে পদ পাবেন এই নেতা।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, ৯৬ থেকে ২০০১ মেয়াদে নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে শামীম ওসমান অনেকটা রাতারাতি পলিটিক্যাল হিরো বনে যান। এর পটভূমি ছিল মানবতাবিরোধী অপরাধী গোলাম আযমকে নারায়ণগঞ্জের মাটিতে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা। এর পরপরই তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার লংমার্চ নারায়ণগঞ্জে আটকে দেওয়ার মতো বড় রাজনৈতিক ক্ষমতার শো-ডাউন দেখান শামীম ওসমান। খালেদা জিয়ার লংমার্চ থামিয়ে দিতে শত শত ক্যাডার নিয়ে মাঠে নেমে পড়েন নিজেই। প্রায় দুই দশক ধরে নারায়ণগঞ্জের রাজনীতিতে এক অপ্রতিরোধ্য দাপুটে রাজনীতিক হিসেবে পরিচিতি পান শামীম ওসমান, যা এখনো বহাল আছে।
২০০৭ সালে ওয়ান-ইলেভেন পরিস্থিতিতে তথাকথিত সংস্কারপন্থীর অভিযোগে দলে বাদ পড়া একসময়ের ডার্ক সাইটের নেতারা দলীয় কর্মীদের আলোচনায় উঠে আসছেন। কর্মীদের মতে, সংস্কারপন্থীর অভিযোগে বাদ পড়া দলীয় নেতাদের অনেকেই ছিলেন দলের দুর্দিনের কাণ্ডারি। এবারের কাউন্সিলে শেখ হাসিনা যে জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছেন, সেখানে স্থান পেতে পারেন কয়েকজন। তাদের মধ্যে মুকুল বোস এবং বগুড়ার আব্দুল মান্নান।
মুকুল বোস। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে বিমর্ষভাবে হত্যাকাণ্ডের পর দলের দুঃসময়ে কী না করেছেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সংগঠন ছাত্রলীগকে তিলে তিলে সংগঠিত করতে কতবার শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন দলের এক সময়ের ত্যাগী এই নেতা- তার হিসেব নেই। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক হওয়ার অপরাধে কতবার কারাগারে যেতে হয়েছে মুকুল বোসকে। কঠিন নির্যাতনের মুখেও দমন করা যায়নি তাকে। এমনকি বঙ্গবন্ধুর প্রশ্নে আপসহীন ভূমিকার কারণেই সাবেক এই ছাত্রলীগ নেতাকে বস্তায় বন্দি করে নির্যাতন করা হয়। তারপরও বঙ্গবন্ধু ও আদর্শের প্রশ্নে মুকুল বোস আপস করেননি কোনো অপশক্তির কাছে। সেই নেতা কী আজ শুধুই সংস্কারের অভিযোগে দলের বাইরে থাকবেন এমনটা মনে করছেন না অনেকে। তারা মনে করেছেন, দলীয় সভানেত্রী এবার মুকুল বোসকে গুরুত্বপূর্ণ পদ দিতে পারেন।
অপরদিকে, বগুড়ার সংসদ সদস্য আব্দুল মান্নানও আলোচনায় রয়েছেন। তৃণমূল রাজনীতিতে বেশ ভালো করার পাশাপাশি জাতীয় রাজনীতিতেও ভালো ভূমিকা রাখতে পারবেন এমন ভাবনা থেকে এই নেতার পদ পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। পূর্ব-পশ্চিম
২০ অক্টোবর ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি