রবিবার, ২০ নভেম্বর, ২০১৬, ০১:০০:৫৭

পুনর্গঠন ঘিরে বিএনপির তণমূলে লবিং-গ্রুপিং

পুনর্গঠন ঘিরে বিএনপির তণমূলে লবিং-গ্রুপিং

মাহমুদ আজহার : দলীয় কোন্দলে খুলনা মহানগরে পাঁচটি থানায় সম্মেলন স্থগিত বিএনপির। স্থানীয় ছয় নেতাকে অব্যাহতি দেওয়ায় খুলনা মহানগর বিএনপিতে এখন ভাঙনের সুর। সময়মতো মহানগরের কাউন্সিল করতে পারবে কিনা তা নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে। রাজশাহী মহানগরে কাউন্সিল ছাড়াই কমিটি দেওয়াকে ঘিরে টানটান উত্তেজনা বিরাজ করছে সেখানেও।

আন্দোলনে ভূমিকা না থাকলেও ময়মনসিংহ মহানগর ও দক্ষিণ জেলার নেতাদের বড় অংশই পদের জন্য ঘাম ঝরাচ্ছেন। শুধু খুলনা, রাজশাহী কিংবা ময়মনসিংহ জেলাই নয়, সারা দেশেই বিএনপির চালচিত্র প্রায় একই। তৃণমূল পুনর্গঠনকে ঘিরে বিএনপির সর্বত্রই বাড়ছে লবিং-গ্রুপিং। ডিসেম্বরের মধ্যে ৪০টি জেলা কমিটি দেওয়ার চিন্তা-ভাবনা করছে দলটি। এসব জেলায় পুরনো কোন্দল এখন নতুন রূপ পেয়েছে। দলীয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

বিএনপির সিনিয়র নেতারা বলছেন, তৃণমূলে পুনর্গঠনকে ঘিরে বিএনপির সর্বত্রই চাঙ্গাভাব চলে এসেছে। কমিটি গঠনকে ঘিরে নেতৃত্বে প্রতিযোগিতা চলছে। এটাই গণতন্ত্রের শোভা। এটাকে নেতিবাচকভাবে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তৃণমূলে বিএনপির লাখ লাখ কর্মী-সমর্থক রয়েছেন। সবাইকে তো আর কমিটিতে রাখা সম্ভব নয়। কিন্তু বিএনপিতে সবাই সমান। একজন কর্মী বা সমর্থককেও দল গুরুত্ব দেয়। পদ-পদবিই বড় কথা নয়, প্রতিকূল এই পরিস্থিতিতে নেতা-কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে কাজ করাটাই বড় কথা।

এ প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, ‘পুনর্গঠনকে ঘিরে বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে উচ্ছ্বাস বৃদ্ধি পেয়েছে। তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে চাঙ্গাভাব চলে এসেছে। নেতৃত্বে প্রতিযোগিতা রয়েছে। এটাকে কোন্দল বলা যাবে না। শিগগিরই বিএনপির সব সাংগঠনিক পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শেষ করে নতুন বছর নতুন উদ্যমে আমরা পথ চলা শুরু করব।’

জানা যায়, বিএনপির সাংগঠনিক জেলা ৭৫টি। এর মধ্যে ২০টি জেলায় পূর্ণাঙ্গ, আংশিক কিংবা আহ্বায়ক কমিটি রয়েছে। তবে ডিসেম্বরের মধ্যে ৪০টি জেলায় কমিটির টার্গেট দলটির। এর মধ্যে রয়েছে—নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ মহানগর, ময়মনসিংহ উত্তর, ময়মনসিংহ দক্ষিণ, টাঙ্গাইল, সুনামগঞ্জ, পিরোজপুর, জামালপুর, কুষ্টিয়া, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, মাগুরা, নওগাঁ, খাগড়াছড়ি, কুমিল্লা উত্তর, রাজশাহী জেলা, রাজশাহী মহানগর, শেরপুর, ঝালকাঠি, বান্দরবান, গাইবান্ধা, জয়পুরহাট, প্রভৃতি। এর মধ্যে বড় অংশই নভেম্বরের মধ্যে দেওয়ার চিন্তা-ভাবনা রয়েছে দলটির। বেশ কয়েকটি জেলার সম্মেলনের দিনক্ষণও নির্ধারণ করা হয়েছে।

সূত্রমতে, ২০১৪ সালের এপ্রিল থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত বিএনপি ঘোষিত কমিটির মধ্যে আংশিকই বেশি। আহ্বায়ক কমিটিও রয়েছে কয়েকটি জেলায়। আহ্বায়ক কমিটিগুলোও নতুন করে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে বিএনপির। তবে নতুন করে লক্ষ্য নির্ধারণ করা জেলাগুলোতেও আপাতত আংশিক কমিটি দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে তা পূর্ণাঙ্গ রূপ দেওয়া হবে। এ ছাড়া জেলায় সম্মেলন বা প্রতিনিধি সভা করে ঢাকায় কমিটি ঘোষণারও নীতিগত সিদ্ধান্ত রয়েছে দলটির। পরিবর্তিত পরিস্থিতি আর দলের ভিতরে নানা কোন্দল বিবেচনায় বিএনপির হাইকমান্ড এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

জানা যায়, রাজশাহী মহানগরে যেকোনো সময় কমিটি ঘোষণা হতে পারে। এ নিয়ে চলছে ব্যাপক লবিং-গ্রুপিং। তবে মহানগর সভাপতির দৌড়ে এগিয়ে রয়েছেন রাজশাহী সিটি করপোরেশনের বরখাস্ত হওয়া মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল। তবে তার সঙ্গে সাধারণ সম্পাদক পদে কে আসছেন  তা নিয়ে চলছে নানামুখী আলোচনা।

তবে কমিটিতে ভারসাম্য আনতে আগের কমিটির সাধারণ সম্পাদক শফিকুল হক মিলনকেই এ পদে রাখা হতে পারে বলে জানা গেছে। নগর বিএনপির বর্তমান সভাপতি মিজানুর রহমান মিনু জানান, ‘নগর কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে। আশা করছি, শিগগিরই মহানগরে নতুন কমিটি ঘোষণা করা হবে।’

তবে রাজশাহী জেলা কমিটি নিয়ে শুরু হয়েছে অন্তর্দ্বন্দ্ব। জেলা সভাপতি নাদিম মোস্তফার সঙ্গে প্রকাশ্যেই বিরোধ সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট কামরুল মনিরের। এ সুযোগে এক পক্ষ ব্যারিস্টার আমিনুল হককে জেলায় সভাপতি চান।

এ ছাড়া কামরুল মনিরকে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা করায় এ পদে আসতে চান জেলা বিএনপির সহসভাপতি তোফাজ্জল হোসেন তপু, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন উজ্জ্বল ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আবু সাঈদ চাঁদ। তপু ও উজ্জ্বল নাদিম মোস্তফার ‘ঘনিষ্ঠ’ বলে পরিচিত। আর মিনুর ঘনিষ্ঠ হলেন চাঁদ। ফলে সমন্বয় কমিটি গঠন করা হলেও সেখানে বিরোধ থেকেই যাবে বলে সংশ্লিষ্টরা বলছেন।

ময়মনসিংহ দক্ষিণ জেলা বিএনপি ও মহানগর বিএনপির কমিটি গঠনকে ঘিরেও দলীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে পুরনো কোন্দল এখন প্রকাশ্যে চলে এসেছে। দলটিতে এখন পদ-পদবিকে ঘিরেই চলছে ব্যাপক লবিং-গ্রুপিং। ২০০৯ সালে কাউন্সিলে ময়মনসিংহ দক্ষিণ জেলা বিএনপি সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন এ কে এম মোশাররফ হোসেন ও আবু ওয়াহাব আকন্দ।

এরপর এ কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ হলেও হচ্ছে, হবে করে হচ্ছে না নতুন কমিটি। আগামী ২৩ নভেম্বর জেলায় সম্মেলনের দিন নির্ধারণ করা হয়েছে। এরপর যেকোনো দিন ঘোষণা করা হবে কমিটি। এ নিয়ে নির্ঘুম রাত কাটছে ময়মনসিংহ জেলা ও মহানগরের অন্তত দেড় ডজন পদপ্রত্যাশী নেতার।

ছয় নেতাকে অব্যাহতি দেওয়ার পর খুলনা মহানগর ও জেলা বিএনপিতে টানটান উত্তেজনা বিরাজ করছে। অব্যাহতি পাওয়া নেতারা খুলনা মহানগর বিএনপির সব ধরনের কর্মকাণ্ড ও সম্মেলন প্রতিহতের ঘোষণা দিয়েছে। এর পরপই সোনাডাঙ্গা, খুলনা সদর, দৌলতপুর, খানজাহান আলী ও খালিশপুর থানার সম্মেলন স্থগিত করা হয়।  

নগর বিএনপি সভাপতিকে অবাঞ্ছিত করার ঘোষণা, কুশপুত্তলিকা পোড়ানোসহ বিক্ষোভ-সমাবেশও চলছে খালিশপুরে। নগর বিএনপির সিনিয়র সহসভাপতি সাহারুজ্জামান মোর্ত্তুজা বলেন, ‘মঞ্জু অগঠনতান্ত্রিকভাবে ১০/১২ জনকে নিয়ে সভা করে আরিফুর রহমান মিঠুসহ ৬ জনকে দল থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন। তার স্বৈরতান্ত্রিক আচরণে দলে ভাঙন তৈরি হয়েছে। দলের দুর্দিনের নেতাদের বাদ দিয়ে কোনো সম্মেলন হতে পারে না।’

বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার নিজ জেলা ফেনী বিএনপির নতুন কমিটিকে ঘিরে শুরু হয়েছে ব্যাপক লবিং-গ্রুপিং। দীর্ঘ ৭ বছর কাউন্সিল না হওয়ায় জেলাটি এখন অন্তর্কোন্দলে জর্জরিত। নতুন কমিটিকে ঘিরে ঝিমিয়ে পড়া নেতারা পদ-পদবির আশায় জোর তৎপরতা শুরু করেছেন। সভাপতি পদে বর্তমান ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অ্যাডভোকেট আবু তাহের ও বর্তমান সাধারণ সম্পাদক জিয়া উদ্দিন মিষ্টার দলের সর্বোচ্চ পর্যায়ে লবিং করছেন।

সাধারণ সম্পাদক পদে লবিং করছেন অ্যাডভোকেট মেজবাহ উদ্দিন খান, অ্যাডভোকেট সৈয়দ মিজানুর রহমান, ইয়াকুর নবী, গাজী হাবিবুল্লাহ মানিক, শেখ ফরিদ বাহার ও এম এ খালেক।  জানা যায়, জেলা কমিটিকে ঘিরে গত ১৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করার কথা ছিল। এর একদিন আগেই ঢাকায় ফেনীর সহস্রাধিক নেতা-কর্মী ঢাকায় চলে এলে সংঘাতের পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। পরে মতবিনিময় সভা স্থগিত করা হয়।

বরিশাল মহানগরে শুরু হয়েছে নতুন করে তৎপরতা। মহানগর সভাপতি মজিবর রহমান সরোয়ার বিএনপির কেন্দ্রীয় যুগ্ম-মহাসচিব হওয়ায় মহানগরের শীর্ষ পদে যেতে নানামুখী লবিং শুরু হয়েছে। আন্দোলনের সময় নেতা-কর্মীদের কাছ থেকে নিজেকে আড়াল করে রাখা সিটি মেয়র আহসান হাবিব কামালও মহানগরের দায়িত্ব পেতে তৎপরতা শুরু করেছেন। বর্তমান সিনিয়র সহসভাপতি মনিরুজ্জামান ফারুক ও মহানগরের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট আলী হায়দার বাবুলও এ পদে আগ্রহী।

ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক জিয়াউদ্দিন শিকদার ছাড়াও এ পদের জন্য তৎপর মজিবুর রহমান সরোয়ারের ছোটভাই মিজানুর রহমান অহিদ এবং মহানগর যুবদলের সাধারণ সম্পাদক আক্তরুজ্জামান শামীমও। বরিশাল দক্ষিণ জেলায় সরফুদ্দিন আহমেদ সান্টু, আক্তারুজ্জামান শামীম ও আজিম শীর্ষ পদের জন্য লড়াই করছেন। অন্যদিকে বরিশাল উত্তরে ঘাম জড়াচ্ছেন সাবেক এমপি মেসবাহ উদ্দিন ফরহাদ. আ ফ ম রশীদ দুলাল ও আবদুস সাত্তার খান।

এ প্রসঙ্গে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান জানান, ‘বিএনপির নেতা-কর্মীদের কাছে পদ-পদবিই বড় কথা নয়। বর্তমান প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ঐক্যবদ্ধ থেকে গণতন্ত্র রক্ষায় দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার হাতকে শক্তিশালী করাই বড় কথা। সাংগঠনিক পুনর্গঠন একটি চলমান প্রক্রিয়া। এটা চলছে। আশা করছি, ডিসেম্বরের মধ্যে আমরা জেলায় আশানুরূপ কমিটি দিতে পারব।’ বিডি প্রতিদিন

২০ নভেম্বর ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে