দীন ইসলাম : মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী ছায়েদুল হকের সুনাম ক্ষুণ্ন করতে পরিকল্পিতভাবে সহিংস ঘটনা ঘটানো হয়েছে। নাসিরনগরের হিন্দুপাড়ায় ঘরবাড়ি ভাঙচুর ও মন্দিরে প্রবেশ করে প্রতিমা ভাঙচুরসহ ব্যাপক ক্ষতিসাধন করেছে কম বয়সী যুবকরা।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাসিরনগর উপজেলায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলা ও মন্দির ভাঙচুর প্রসঙ্গে দেশের শীর্ষ এক গোয়েন্দা সংস্থা বিশেষ প্রতিবেদনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে এমনটাই জানিয়েছে। প্রতিবেদনটি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় হয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পৌঁছেছে। নাসিরনগর ঘটনার নেপথ্যের কারণ হিসেবে বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পবিত্র কাবা শরীফের অবমাননার পোস্টটি রসুরাজ দাসের ফেসবুকে দেয়া হয়েছে। তার ফটোশপের কাজ ৫ম শ্রেণি যোগ্যতার একজন জেলে পেশার মানুষের পক্ষে কঠিন।
যুগ যুগ ধরে সম্প্রীতির সঙ্গে বসবাস করা নাসিরনগর উপজেলায় প্রায় ২ লাখ হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ রয়েছে। ইতিহাসে কখনো ওই উপজেলায় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা বা মারামারির ঘটনা নেই। ধারণা করা হচ্ছে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে শান্তিপ্রিয় নাসিরনগর তথা সারা দেশের হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা বা ভেদাভেদ সৃষ্টি করা এবং বর্তমান সরকারের সুনাম নষ্ট করাই মূল উদ্দেশ্য ছিল। গত কয়েক দিন ধরে নাসিরনগর উপজেলার জনপ্রিয় আওয়ামী লীগ নেতা, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী এবং ৫ বারের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট ছায়েদুল হকের সঙ্গে গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জেলা আওয়ামী লীগ এবং নাসিরনগর উপজেলার স্থানীয় কিছু আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। বর্তমানে তা প্রকট আকার ধারণ করেছে।
ওই ঘটনায় মন্ত্রীর সুনাম ক্ষুণ্ন করতে পরিকল্পিতভাবে তৃতীয় কোনো শক্তির দ্বারা সহিংস ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। নাসিরনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের বিভিন্ন নেতৃবৃন্দ সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। ওই ঘটনায় নাসিরনগর থানায় দুটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলা নং-২২ ও ৩০, তারিখ; ৩০-১০-২০১৬ খ্রি.।
নাসিরনগর উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশের ভূমিকা সম্পর্কে বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অনুসন্ধানে জানা যায়, পবিত্র কাবা শরীফ অবমাননার ঘটনাকে নিয়ে পুরো উপজেলায় ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়া তথা উপজেলা সদরসহ বিভিন্ন গ্রামে মাইকিং করে বিক্ষুব্ধ জনতাকে ৩০শে অক্টোবর নাসিরনগর স্টেডিয়াম মাঠে উপস্থিত হওয়ার আহ্বান জানানো হয়। এরপরও উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের টনক নড়েনি বা দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে ব্যর্থ হয়।
সম্ভাব্য সহিংসতা প্রতিরোধে কোনো প্রকার রিজার্ভ ফোর্স রাখার ব্যবস্থা করা হয়নি। অথচ পার্শ্ববর্তী উপজেলা সরাইলে অবস্থিত ১২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের সদর দপ্তর (হেড কোয়ার্টার)। নাসিরনগর থেকে দূরত্ব ১৫ কি.মি.। উত্তেজিত জনতাকে ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড থেকে নিবারণের জন্য পুলিশ কোনো প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়নি। জানা যায়, বিভিন্ন স্থানে হামলার সময় উপজেলা চেয়ারম্যান এবং ভাইস চেয়ারম্যান নাসিরনগর থানার ওসিকে একাধিকবার ফোন করলেও, তিনি তাদের ফোন ধরেননি বা কোনো প্রকার যোগাযোগ করেননি।
সম্ভাব্য সহিংস ঘটনার আঁচ করতে পেরেও ইউএনও এবং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা এবং স্থানীয় মুসলিম সমাজের নেতাদের সঙ্গে কোনো প্রকার বৈঠক করেনি। বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়, অনুসন্ধানে জানা যায়, গত ২৯শে অক্টোবর বিক্ষোভ মিছিলের পর নাসিরনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে উপজেলা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আহ্বায়ক রিয়াজুল করিম খান এবং খাঁটি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের সাংগঠনিক সম্পাদক এসএম শহীদুল হক নাসিরনগর স্টেডিয়ামে সমাবেশের জন্য মোবাইলের মাধ্যমে অনুমতি চায়।
উপজেলা প্রশাসন তাদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করার অনুমতি দেয়। এরপর নাসিরনগর উপজেলা সদরে স্থানীয় লোকজন রিকশাযোগে মাইক দিয়ে বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় হিন্দু সমাজকে লক্ষ্য করে উস্কানিমূলক স্লোগান এবং ৩০শে অক্টোবর নাসিরনগর স্টেডিয়ামে আহূত বিক্ষোভ সমাবেশে অংশগ্রহণের আহ্বান জানান।
জানা যায়, একই সময়ে উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের পাড়া-মহল্লার মসজিদের মাইক দিয়েও সমাবেশে অংশগ্রহণের আহ্বান জানানো হয়। ইতিমধ্যে নাসিরনগর উপজেলাসহ সব জেলা ও পার্শ্ববর্তী হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর উপজেলায় এ খবর ছড়িয়ে পড়ে এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্ষোভ বাড়তে থাকে। এরপর ৩০শে অক্টোবর বেলা ১১টায় নাসিরনগর স্টেডিয়াম মাঠ ও নাসিরনগর সরকারি কলেজ মাঠে ধীরে ধীরে বিভিন্ন গ্রাম থেকে মিছিল নিয়ে বিক্ষুব্ধ জনতা জমায়েত হতে শুরু করে।
বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লোকসমাগমও বাড়তে থাকে (১৫,০০০-১৬,০০০)। উপজেলার প্রায় ২৬টি গ্রাম থেকে ওই সমাবেশে লোক সমাগম হয়েছিল। উত্তেজিত জনতার মঞ্চে উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এটিএম মনিরুজ্জামান সরকার, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা চৌধুরী মোয়াজ্জেম হোসেনসহ বিভিন্ন ধর্মীয় নেতারা বক্তব্য দেন।
বক্তারা বলেন, কাবা শরীফ অবমাননার সঙ্গে দায়ী ব্যক্তির কঠোর শাস্তি হবে। তারা শান্তিপূর্ণভাবে মিছিল-সমাবেশ করতে সবার প্রতি আহ্বান জানান। সমাবেশ শেষ হতে না হতেই সমাবেশে অংশ নেয়া উল্লেখযোগ্য সংখ্যক উত্তেজিত কম বয়সী যুবক পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন হিন্দুপাড়ার ঘরবাড়ি ভাঙচুর ও মন্দিরে প্রবেশ করে প্রতিমা ভাঙচুরসহ ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে।
বিশেষ প্রতিবেদনে মন্তব্য আকারে বলা হয়েছে, নাসিরনগরে হিন্দু ধর্মাবলম্বী রসুরাজ দাস কর্তৃক ফেসবুক পেইজে পবিত্র কাবা শরীফের ওপর শিবমূর্তির ছবি পোস্ট করার বিষয়টিকে কেন্দ্র করে সংঘটিত ন্যক্কারজনক ঘটনায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা চৌধুরী মোয়াজ্জেম হোসেনসহ স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দূরদর্শিতার অভাব রয়েছে। অন্যদিকে উপজেলা প্রশাসন এবং পুলিশের অদূরদর্শিতার কারণে বর্তমান সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে।
এছাড়া, পবিত্র কাবা শরীফের অবমাননার যে পোস্টটি দেয়া হয়েছে তা ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করা একজন সাধারণ লোকের পক্ষে দেয়া সম্ভব নয়। এটি ফটোশপে পারদর্শী কোনো মহলের উদ্দেশ্যমূলক কর্মকাণ্ড। বিশেষ প্রতিবেদনে চারটি সুপারিশ উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ফেসবুক পেইজে পবিত্র কাবা শরীফের উপর শিবমূর্তির ছবি পোস্টের বিষয়টি কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তির কাজ। তাই এ প্রকৃত ঘটনা উদঘাটন করে দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া যায়।
পাশাপাশি এ ঘটনাকে পুঁজি করে কেউ যাতে দেশে অস্থিতিশীল/বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে না পারে সেজন্য সারা দেশে গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সতর্ক ও তৎপর থাকার নির্দেশনা দেয়া যায়। একই সঙ্গে নাসিরনগর উপজেলাসহ সারা দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা জোরদার করা যায়।
এতে বলা হয়, ন্যক্কারজনক ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য তদন্ত কমিটি গঠন করে ওই ঘটনার পেছনে কারা জড়িত এবং প্রশাসনের এ রকম নীরব ভূমিকার কারণ উদঘাটন করে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ও বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশনা দেয়া যায়। একই সঙ্গে সহিংস ঘটনায় জড়িতদের দ্রুত শনাক্ত করে জরুরিভিত্তিতে আইনের আওতায় আনা যেতে পারে। মানবজমিন
২২ নভেম্বর ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি