মো. শামীম রিজভী : যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখ তাই, পাইলেও পাইতে পার অমূল্য রতন’ বহুল প্রচলিত এই পঙ্ক্তিটি অনেকে সন্দেহের চোখে দেখলেও একেবারে যে মিথ্যে নয়; তার প্রমাণ কিন্তু আছে। যাচাই করতে চাইলে যে কেউ যেতে পারেন পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজারে। এখানে মিলবে নানা বয়সী অনেক মানুষ, যারা নর্দমার ময়লা পানি ছেঁকে তুলে আনেন পরিত্যক্ত সোনা। আর যারা এ কাজে যুক্ত স্থানীয় ভাষায় তাদের বলা হয় ‘নেহারওয়ালা’।
ময়লা, নোংরা পানি থেকে নেহারওয়ালারা স্বর্ণ ও রূপার মতো মূল্যবান ধাতু খুঁজে বের করেন। বিশেষ করে নর্দমা, ড্রেনের পাশে রাখা ময়লা, রাস্তার ধূলাবালি থেকে তারা এ সকল মূল্যবান বস্তু খুঁজে বের করেন।
রাজধানীর মধ্যে সাধারণত পুরান ঢাকার তাঁতীবাজার এলাকার ড্রেন অথবা নর্দমার আশপাশে নেহারওয়ালাদের দেখা মেলে। প্রতিদিনই তারা তাঁতীবাজারের জুয়েলারি দোকানগুলোর আশপাশের নর্দমা, ড্রেনের পাশে রাখা ময়লা, রাস্তার ধূলাবালি থেকে খুঁজে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বর্ণ-রূপা সংগ্রহ করেন।
টানা ৩৫ বছর তাঁতীবাজারে নর্দমা থেকে স্বর্ণ খুঁজে বের করেন নেহারওয়ালা মো. সালাহউদ্দিন।
তিনি জানান, পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করে বাপ-দাদার থেকে পাওয়া এ পেশাটিতে তিনি দীর্ঘ ৩৫ বছর পার করেছেন। বর্তমানে স্ত্রী রহিমা খাতুন, দুই ছেলে মো. সোহাগ ও মো. সিফাতকে নিয়ে তার সংসার। সোহাগ নবাবপুরে একটি হার্ডওয়্যারের দোকানে কাজ করে এবং সিফাত নারিন্দা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এবার এসএসসি পরীক্ষা দেবে। এ ছাড়াও দুই মেয়ে রয়েছে, যাদের বিয়ে হয়েছে। বাপ-দাদার পেশা বেছে নিলেও চান না ছেলেদের এ পেশায় আনতে।
তবে সালাহউদ্দিনের পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে চার ভাই মো. আলাউদ্দিন, মো. হেলালউদ্দিন ও মো. সোরাবউদ্দিন এ পেশায় জড়িত।
সালাহউদ্দিন বলেন, ‘কষ্ট কইরা নোংরা-ময়লায় হাত দিয়া আমরা মূল্যবান জিনিস বাইর করি। আয় হয় মাসে ১৫-২০ হাজার টাকা। কিন্তু কেউ আমাগোরে ঠিক নজরে দেখে না। সবাই ছোট কইরা দেখে।’
তাদের কাজ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা গুঁড়া স্বর্ণটা খুঁইজা বাইর করি। পরে ধুইয়া ধুইয়া আবার রিফাইন করি। রিফাইন কইরা স্বর্ণটা গালায়া বিক্রি করি। এদিকের দোকানদাররাই কিনে। আমরা রাত্রেই কাজ বেশি করি। রাতে কোনো সমস্যা হয় না। আইডিয়ার উপরে ধুইয়া রাইখা দেই। সকালে স্বর্ণ আর রূপা রিফাইন কইরা গালায়া বিক্রি করি।’
তবে নেহারওয়ালাদের অনেকে চুক্তিতে বা বিভিন্ন মার্কেট পরিষ্কার করার কাজ করেন। তারা পুরো মার্কেট ঝাড়ু দিয়ে ও ময়লা উঠিয়ে পরিষ্কার করে স্বর্ণ-রূপা খুঁজে বের করেন। তারা সাধারণত বছর হিসেবে চুক্তিতে কাজ করেন। কারখানা ও দোকানগুলোও পরিষ্কার করে দেন। সেখানে ময়লা ফেলার স্থানের অথবা কার্পেটের ময়লা সংগ্রহ করে একত্র করেন। ময়লায় যদি স্বর্ণ-রূপার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র টুকরা পান সেগুলো সংগ্রহ করে গলিয়ে বিক্রি করেন।
নর্দমায় স্বর্ণের টুকরা কীভাবে আসে— এমন প্রশ্নের জবাবে নেহারওয়ালা আলাউদ্দিন বলেন, ‘সোনা-রূপার বড় মার্কেট এইডা। কারিগররা যহন কাজ করে তহন বাতাসে সোনা-রূপার ছোট কণা রাস্তায় আইসা পড়ে। কখনও আবার কারো পকেট থাইকা সোনা-রূপা পইড়া যায়, দোকাই থিকা বাইর হওনের সময় পায়ের লগে রাস্তায় আহে। দোকান ঝাড় দাওনের সময়ও সোনা-রূপা রাস্তায় আইয়া পড়ে।’
পুরান ঢাকার পান্নিটোলা ও ধলপুর এলাকায় নেহারওয়ালাদের বিচরণ। শুধু তাঁতীবাজারে ৬০ জনের মতো নেহারওয়ালা কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। এরা শুধু যে রাজধানীর মধ্যে কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রেখেছেন তা নয়, বাইরেও যান মাঝেমধ্যে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া, বরিশাল, নরসিংদী ও ময়মনসিংহসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় যেখানে জুয়েলারির দোকান বেশি সেখানেও তারা কাজ করতে যান।
১৫-২০ বছর ধরে এ কাজ করছেন মো. শাহাবুদ্দিন। পরিবারে তিনি একাই। নেই স্ত্রী-সন্তান। তাই কোনো চিন্তাও নেই। সারাদিন নর্দমায় ময়লা খুঁজেন, আর ওগুলো বিক্রি করে নিজের মতো ‘রাজারহালে’ দিন কাটান।
ময়লার মধ্যে কি খুঁজেন— জিজ্ঞেস করতেই তিনি বলেন, ময়লার মধ্যে স্বর্ণ খুঁজি, স্বর্ণ। ময়লা উঠাই, পরে এগুলা ধুইয়া দেহুম স্বর্ণ আছে কিনা। স্বর্ণ পাইলে গালাইয়া দোকানে বিক্রি করি। বাপ-দাদার আমল থিকা এ কামেই আছি।
তবে এ কাজ করে যারা করেন, তাদের আক্ষেপের শেষ নেই। কারণ মানুষ তাদের ভাল নজরে দেখে না। অনেক সময় কাজ করতে গেলে তাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে।
সালাহউদ্দিনের চাচাতো ভাই ইকবালও এ কাজ বংশানুক্রমে করে আসছেন। নর্দমা থেকে স্বর্ণ আলাদা করার বর্ণনা দেন তিনি, ময়লা কড়াইতে উঠাই। কড়াইতে উঠাইয়া পরে ধুই। ধুইয়া ছোট কইরা এসিড দেই। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কইরা চুম্বক মারব। চুম্বক মাইরা লোহার গুঁড়াগুলা ফালাইয়া দিব। পরে তামা-পিতল যদি চোখে বাজে তাইলে ওগুলাও ফালাইয়া দিব। রূপা চোখে বাজলে আলাদা রাখব। পাথর পাইলে পাথর আলাদা রাখব। এরপর হেডারে নাইট্রিক এসিড দিয়া খাওয়া দিব। খাওয়া দেওয়াইলে তামা, পিতল, চান্দি এগুলা খাইয়া ফেলায়। পরে ওইটার মধ্যে পারদ আর অল্প এসিড দিয়া ঘইসা ঘইসা মিলায় ফেলায়। পারদের সাথে মিলায় ফেলাইলে স্বর্ণ আলাদা হয়। পরে বালি আলগা হইলে ওইটা ধুইয়া ফালায়। পরে সিসা দিয়া আগুনে হিট দিয়া গালাইলে, সিসা আর পারদ দোনঠাই উপরে উইঠা যায় গা। আর সোনাডা থাইকা যায়।
তিনি আরও বলেন, স্বর্ণের ওজন যা হয় তার উপরে দাম হয়। সোনাডা একটু খারাপ হইলে দাম কম। দেহা গেছে ১৬, ১৮ ক্যারেটের স্বর্ণ হয়। ওই হিসাবেই দাম। ভাল হইলে ভালর দাম দেয়। ১৬ শ’ টাকা আনা আবার ১৮ শ’ টাকা আনা আবার ভাল হইলে ১৯ শ’ টাকা আনাও দেয়। ৬ লত্তিতে (রতি) এক আনা।
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, কাজটা খারাপ, ড্রেনে হাত দেওয়া। রাস্তাঘাটের ময়লা ধরে, পরিষ্কার করি। ওই হিসাবে সরকারের মূল্যায়ন করা উচিৎ। যে স্বর্ণটা আপনারা ফালাইয়া দেন, জীবনেও পাইবেন না। সেই স্বর্ণটা খুঁইজা বাইর কইরা মাসে একেকজন দেড় লাখ টাকার স্বর্ণ বাইর করে। জেলাভিত্তিকও অনেকে কাজ করে। কেউ টাঙ্গাইলে, কেউ বরিশালে, কেউ গাজীপুরে কাজ করে।
নেহারওয়ালারা স্বর্ণ ও রূপা তাঁতীবাজারের স্থানীয় জুয়েলারি ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে থাকেন।
তারা জানান, যারা পোদ্দার (স্বর্ণ কেনা-বেচা করে) তারাই মূলত এ স্বর্ণ ও রূপা কেনেন।
এ ব্যাপারে তাঁতীবাজারের জুয়েলারি মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক পবিত্র ঘোষ বলেন, তারা দীর্ঘদিন ধরে তাঁতীবাজারে এ কাজ করছে। তাদের স্বর্ণ অনেক ব্যবসায়ী কেনে। তবে আমরা কিনি না। তাদের কাজে আমাদের পক্ষ থেকে কোনো বাধাও দেওয়া হয় না।-দ্য রিপোর্ট
১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এস.এ.সুমন/একে