ইফতেখার মাহমুদ : ভারতীয় গরু কম আসায় আসন্ন কোরবানির ঈদে দেশি গরুই ভরসা। এবারের কোরবানির ঈদে ৫০ লাখের মতো গরু জবাই হতে পারে। প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, কোরবানির ঈদে বিক্রির মতো ৪০ লাখের মতো হৃষ্টপুষ্ট গরু ও মহিষ আছে।
এ বিষয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ বলেন, এবার ভারতীয় গরু কম আসায় তা কিছুটা ঘাটতি তৈরি হবে এটা সত্যি। কিন্তু তা দেশের গরুর খামারিদের জন্য নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেবে। ঘাটতির কারণে দেশে এবার গরুর দাম কিছুটা বাড়লেও তাতে গরু লালন-পালনকারী সাধারণ কৃষকের লাভ হবে। ফলে পরের বছর তাঁরা আরও বেশি গরু লালন বাড়িয়ে দিয়ে দেশে গরুর ঘাটতি কমিয়ে আনবেন।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় অবশ্য বলছে, এবারের কোরবানির হাটে ৪০ লাখ দেশে পালিত গরু ও মহিষ এবং ৬৯ লাখ ছাগল ও ভেড়া উঠবে। দেশের বাইরে থেকে কিছু গরু আসবে। ওই মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা বলছেন, সব মিলিয়ে গরুর কিছুটা সংকট থাকলেও তাতে খুব একটা সমস্যা হবে না।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাবে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে রেকর্ড পরিমাণে ৮৬ লাখ ২২ হাজার গরু ও মহিষ জবাই হয়েছে। যার মধ্যে কোরবানি হিসেবে জবাই হয়েছে ৪৫ লাখ। বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের হিসাবে, গত বছর কোরবানির ঈদে কমপক্ষে ৫৫ লাখ গরু জবাই হয়েছে।
কিন্তু বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহিন আহমেদ বলছেন, এবার যদি ভারত ও মিয়ানমার থেকে পাঁচ লাখ গরুও আসে, তাহলেও ১০ লাখ গরুর ঘাটতি থাকবে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, গরুর সংখ্যা বাড়ছে গড়ে বছরে মাত্র এক লাখ। ফলে চাহিদা ও জোগানের মধ্যে একটা বড় পার্থক্য থেকেই যাচ্ছে।
পাঁচ-ছয় বছরের মধ্যে বাংলাদেশ ছাগলের সংখ্যা বৃদ্ধির মাধ্যমে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। কিন্তু গরুর ক্ষেত্রে ভারত থেকে আসা গরুর ওপরেই বাজার নির্ভরশীল থেকেছে
তবে প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, সরকার আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে গরুতেও দেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক খামারিদের গরু লালন-পালনে উৎসাহিত করতে ২০০ কোটি টাকার একটি তহবিল তৈরি করেছে। এই টাকার পরিমাণ সামনের বছর আরও বাড়ানো হবে।
প্রতিমন্ত্রীর দেওয়া ওই তথ্যে আশাবাদ থাকলেও বিগত বছরগুলোতে দেশে গরুর সংখ্যা বৃদ্ধির তথ্য খুব একটা আশা জাগায় না। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাবে আট বছরে ৮ লাখ ৩৬ হাজার গরু বেড়েছে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে দেশে গরুর সংখ্যা ছিল ২ কোটি ৩৪ লাখ ৮৮ হাজার। আর ২০১৪-১৫ অর্থবছরে গরুর সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ২ কোটি ৩৬ লাখ ৩৬ হাজার। অর্থাৎ এক বছরে গরুর সংখ্যা বেড়েছে ১ লাখ ৪৮ হাজার।
দেশে গরু লালন-পালনকে তেমন উৎসাহ না দেওয়ায় এই সংকট রয়ে গেছে বলে মনে করছেন এই খাতের সঙ্গে জড়িত বিশেষজ্ঞরা। গত পাঁচ-ছয় বছরের মধ্যে বাংলাদেশ ছাগলের সংখ্যা বৃদ্ধির মাধ্যমে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। কিন্তু গরুর ক্ষেত্রে স্থানীয় জাতের উন্নয়নে তেমন গুরুত্ব না দিয়ে ভারত থেকে আসা গরুর ওপরেই বাজার নির্ভরশীল থেকেছে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানিমেল ব্রিডিং অ্যান্ড জেনেটিকস বিভাগের অধ্যাপক এ কে ফজলুল হক ভূঁইয়া এ প্রসঙ্গে বলেন, বাংলাদেশের চট্টগ্রামের লাল গরু ও মুন্সিগঞ্জের মীরকাদিমের গরুর মাংসের আন্তর্জাতিক খ্যাতি থাকলেও এর জাত সংরক্ষণ ও উন্নত করা এবং তা লালন-পালনে দেশব্যাপী কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ওই গরুর জাত দুটি এখন পর্যন্ত স্থানীয়ভাবেই লালন-পালন করা হচ্ছে। কিন্তু এই দুটি জাত দিয়েই দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি সম্ভব।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাবে, গত আট বছরে দেশে ছাগলের সংখ্যা বেড়েছে ৫৬ লাখ। অন্যদিকে গত আট বছরে দেশে ছাগলের সংখ্যা ব্যাপক বেড়েছে। ২০০৫-০৬ সালে দেশে ছাগলের সংখ্যা ছিল প্রায় দুই কোটি। ২০১৪-১৫ সালে তা বেড়ে ২ কোটি ৫৬ লাখ হয়েছে। বাংলাদেশ বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে ছাগলের মাংস রপ্তানিও করছে। বাংলাদেশের ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলকে জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থা এফএও বিশ্বসেরার স্বীকৃতি দিয়েছে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর সূত্রের এ রকম এক পরিস্থিতিতে সারা দেশে এক হাজারের বেশি কোরবানির হাট জমতে শুরু করেছে। বেশির ভাগ হাটে ইতিমধ্যে দেশি গরু আসা শুরু হয়েছে। তবে গরু ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, সরকারের আগে থেকে গরুর বিকল্প বাজার খোঁজা উচিত ছিল।
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহিন আহমেদ প্রতিবেদককে বলেন, গত বছরের ৭০০ কোটি টাকার চামড়া এখনো রয়ে গেছে। ফলে ভারতীয় গরু না এলে তা চামড়াশিল্পের ওপরে আপাতত কোনো প্রভাব পড়বে না। কিন্তু ভারতীয় গরু আসা স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে গেলে সরকারকে আগে থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে।-প্রথমআলো
১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এস.এ.সুমন/একে