বুধবার, ০৭ ডিসেম্বর, ২০১৬, ০৯:৫৬:২৫

সালমান শাহের মায়ের বিশ্বাস সন্তানহত্যার বিচার পাবেন!

সালমান শাহের মায়ের বিশ্বাস সন্তানহত্যার বিচার পাবেন!

আখতারুজ্জামান আজাদ : আমার জন্মের পরে মারা গেছেন, অথচ দেখা করতে পারিনি বলে আফসোস জাগে— হাতে গোনা এমন কয়েকজনের তালিকায় সালমান শাহর স্থান শীর্ষে। যখনই সিলেটে যাই, শাহ জালালের দরগায় সালমানের কবরটা আর দারিয়াপাড়ায় তার শৈশবের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটা দেখে দুধের সেই সাধ অবশ্য ঘোলে মেটাই। সালমান মরে গেছেন কুড়ি বছর আগে, তখন আমার বয়স ছিল আট। তাকে চর্মচক্ষে দেখার কারো উপায় নেই আর।

গত সেপ্টেম্বরে সালমানকে নিয়ে দীর্ঘ একটি কলাম লিখেছিলাম, যেটি পড়ে বিলেত থেকে ফোন করেছিলেন সালমান-জননী নীলা চৌধুরী এবং কথা দিয়েছিলেন দেশে ফিরে আমাকে তিনি সময় দেবেন। নীলা কথা রেখেছেন, তার আমন্ত্রণে আজ গিয়েছিলাম ধানমন্ডিতে সালমানের খালার বাড়িতে। জাদুঘর-সদৃশ বাড়িটিতে ঢুকেই 'সালমান এই বাড়িতে মাঝে-মাঝে আসতেন' ভেবেই গা ছমছম করছিল, ইচ্ছে করছিল বাড়িটিকে পকেটে পুরে নিয়ে আসি নিজ ঘরে।

নিরাভরণ অনাড়ম্বর নীলা চৌধুরী অন্দরমহল থেকে বেরোলেন; আমার আপাদমস্তক বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হলো, আমি অপলক চেয়ে রইলাম ছেষট্টি বছরের এই রূপবতীর দিকে। চৌধুরী মোহাম্মদ সালমান শাহরিয়ারকে যিনি গর্ভে ধরেছেন, তিনি যে এমন রূপসী হবেন; সেটিই অবশ্য স্বাভাবিক। আমি বরাবরই সেলফি-বিরোধী, বলা যায় সেলফি-বিদ্বেষীও। ছবি তুলে দেওয়ার মতো কাউকে না পেলে অবশ্য সেলফি তোলা ছাড়া উপায় থাকে না বিধায় কয়েক বছর পর আজ সেলফি তুলতে বাধ্য হলাম।

দীর্ঘ কথোপথনের বিরাট অংশ জুড়েই ছিল সালমান হত্যামামলা। মামলার বেহাল দশা সম্পর্কে যা নীলা জানালেন, তাতে আমি নিজেই ভারাক্রান্ত। মা হয়ে কী করে তিনি দুই দশক ধরে তদন্তসংস্থার তালেবরি, বিচারকদের বাহানা, আইনজীবীদের আহাম্মকি তিনি সয়ে যাচ্ছেন; তা যথেষ্ট বিস্ময়-জাগানিয়া। সাংবাদিক বা অনুসন্ধানী প্রতিবেদক নই বলে মামলাটা নিয়ে আদ্যোপান্ত লেখার ধৈর্য নেই। তবে, সাংবাদিকদের প্রতি অনুরোধ থাকবে বিনোদন পাতায় না ছেপে সালমান হত্যামামলা নিয়ে প্রথম পাতায় অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ছেপে বিচারপ্রক্রিয়াকে বেগবান করতে।

নীলা চৌধুরীর কাছে জানতে চেয়েছিলাম এত অল্পবয়সেই সালমান কী করে এত ফ্যাশনদুরস্ত হয়ে উঠেছিলেন, কোথা থেকে শিখেছিলেন এত-এত অনন্য সাজসজ্জা। যা জানলাম— সালমানের ফ্যাশনের উৎস তার নানা। সালমানের নানা ছিলেন এলাকার তৎকালীন ফ্যাশন আইকন, সেই ধারা পেয়েছিলেন কন্যা নীলা। নানা জাপান থেকে প্রচুর বাহারি স্কার্ফ আনতেন কন্যাদের জন্য। নীলা শিশু সালমানের মাথায় সেই স্কার্ফ বেঁধে দিতেন, বড় হয়েও সালমান স্কার্ফ পরে চলচ্চিত্র অঙ্গনে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। টি-শার্টের সম্মুখ অংশ ইন করে সালমান যে পশ্চাৎ অংশ খোলা রাখতেন, সেটির ইতিবৃত্তও জানা গেল আজ। পুরোটা ইন করে পরলে শৈশবে ডানপিটে সালমানের টি-শার্ট পেছন থেকে খুলে পড়ত বলে মা তাকে টি-শার্ট পরিয়ে ইন করে দেওয়ার সময়েই পেছন থেকে আলগা করে দিতেন, পরবর্তীকালে সেটিই হয়ে ওঠে তারুণ্যের ফ্যাশন।

মাত্র আড়াই-তিন বছরে সাতাশটি চলচ্চিত্রে অভিনয়ের পাশাপাশি সালমান একইসাথে মডেলিং করেছেন, প্লেব্যাক করেছেন, টেলিভিশনে খণ্ডনাটক করেছেন, অভিনয় করেছেন ধারাবাহিক নাটকেও। মাত্র পঁচিশ বছরের জীবনে কোথা থেকে কী করে এত প্রাণশক্তি পেয়েছিলেন সালমান— এই প্রশ্নে 'এই আমারই এনার্জি দ্যাখো' বলে জবাব দিলেন নীলা। তিনি জানালেন একইসাথে তিনি (নীলা) সংস্কৃতিচর্চা করেছেন, মা মারা যাওয়ার পর সংসারের হাল ধরেছেন, বিয়ের পর সংসার-সন্তান সামলেছেন, ছাত্ররাজনীতি করেছেন, সিলেট সরকারি মহিলা কলেজ ছাত্রলিগের সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন, এরশাদের আমলে সংরক্ষিত মহিলা আসনে সাংসদও হয়েছেন। এমন কর্মমুখর এক মায়ের সন্তানও যে মায়েরই মতো কর্মবীর হবেন, সেটিই বরং স্বাভাবিক।

সাধারণত সব বাবা-মায়েরই ইচ্ছে থাকে সন্তান ডাক্তার-ইনজিনিয়ার জজ-ব্যারিস্টার হবে, নীলা চৌধুরীরও এমন ইচ্ছে ছিল কি না, চলচ্চিত্রে আসতে সালমানকে তিনি বাধা দিয়েছিলেন কি না— প্রশ্নের জবাবে জানা গেল নীলা নিজেই বড় ছেলেকে রুপালি জগতে নিয়ে এসেছিলেন। সন্তান নিজের চেয়েও বিখ্যাত হয়ে গেলে কেমন লাগে, জানতে চাইলে নীলা বললেন— নিজের চেয়ে সন্তানের বেশি বিখ্যাত হওয়ার চেয়ে বড় আনন্দ জগতে আর নেই এবং এ নিয়ে তার অহংকারও নিরন্তর।

সালমানের মৃত্যুর পর শাকিল খান, রিয়াজরা নীলা চৌধুরীর কাছে গিয়েছিলেন দোয়া চাইতে। নীলা তাদেরকে বলেছিলেন স্বকীয়তা বজায় রাখতে, কাউকে অনুকরণ না করতে। রিয়াজ স্বকীয়তা বজায় রাখার চেষ্টা করলেও শাকিল বরাবরই থেকেছেন সালমানের ছায়া হয়ে এবং ঝরেও পড়েছেন অনিবার্যভাবে।

বিশ বছরে ফিকে হয়ে গেছে সালমানের স্মৃতি, তার এককালের ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা এখন যে যার জায়গায় প্রতিষ্ঠিত; তেমন কেউ এখন আর খোঁজ রাখেন না সালমান-পরিবারের। সন্তানহত্যা আর স্বামীবিয়োগের বিষাদ নিয়ে সত্তরের দিকে ক্রমশ এগোচ্ছেন নীলা চৌধুরী। এখনও তার দৃঢ় সংকল্প সন্তানের হন্তারকদের তিনি শেষ দেখে ছাড়বেন, এখনও তার বদ্ধমূল বিশ্বাস তিনি সন্তানহত্যার বিচার পাবেন।

বাংলাদেশের যে নায়ককে সবচেয়ে পছন্দ করি; সেই সালমান শাহর মা দাঁড়িয়ে থেকে স্বহস্তে বেড়ে আমাকে খাওয়ালেন, ফেরার পথে নিজে লিফট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেলেন, লিফটের বাটন বারংবার টিপে ধরে একঝাঁক ব্যক্তিগত উপদেশ দিলেন— ব্যাপারটা এখনও আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। মায়েরা বোধহয় এমনই। পুত্রবৎ কাউকে পেলেই বোধহয় তাদের মাতৃত্ব জেগে ওঠে। বয়সে আমি তার নাতি সমতুল্য হলে মৃত্যুকালে সালমানের বয়স তো আমার বর্তমান বয়সেরই কাছাকাছি ছিল। আগে তাকে আন্টি ডাকতাম, আজ থেকে তাকে দাদি ডাকার ব্যাপারে তার এনওসি (অনাপত্তিপত্র) নিয়ে এলাম।

নীলা চৌধুরী সালমান শাহর মা। একজন মা তার পুত্রহত্যার বিচার চেয়ে দু দশক ধরে দ্বারে-দ্বারে ঘুরছেন। সাবেক সাংসদ হয়েও যে দেশে একজন মা পুত্রহত্যার বিচার পান না, সে দেশে সাধারণ জনতার দশা সহজেই অনুমেয়। নীলা চৌধুরী অপেক্ষা করছেন; আমরা, সালমানের ভক্তরাও শামিল হয়ে আছি তার অপেক্ষার মিছিলে। তিনি একা নন, আমি-আমরা তার সঙ্গে আছি।

- কবির ফেসবুক থেকে..

৭ ডিসেম্বর,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে