বৃহস্পতিবার, ০৮ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১১:২৮:১৫

যুক্তরাষ্ট্রকে আমার নানার খুনিকে ফিরিয়ে দিতেই হবে: জয়

যুক্তরাষ্ট্রকে আমার নানার খুনিকে ফিরিয়ে দিতেই হবে: জয়

নিউজ ডেস্ক : যুক্তরাষ্ট্রকে বঙ্গবন্ধু হত্যার দায়ে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত রাশেদ চৌধুরীকে অবশ্যই বাংলাদেশে ফিরিয়ে দিতে হবে- লিখেছেন প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়। বঙ্গবন্ধুর নাতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী দৈনিক নিউ ইয়র্ক টাইমসে মতামত কলামে এ বিষয়ে একটি লেখা লিখেছেন। লেখাটি এমটিনিউজ২৪.কমের পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ভোরে  বাংলাদেশে সামরিক অভ্যুত্থানে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করা হয়। সৈন্যরা আমার নানা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের বাসায় প্রবেশ করে তাকেসহ পরিবারের ১৮ জন সদস্যকে হত্যা করে। এদের মধ্যে ছিলেন আমার নানি, তিন মামা (এদের একজন তখন ছিলেন কেবল ১০ বছর বয়সী) এবং আমার সন্তানসম্ভাবা মামি।

বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী আমার মা শেখ হাসিনা তার বোনসহ জার্মানিতে থাকার কারণে সে সময় বেঁচে যান।

৪০ বছর পর আমার পরিবারের অন্যতম খুনি রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে স্বাধীনভাবে বসবাস করছে। খুন ও ষড়যন্ত্রের অভিযোগে একটি নিরপেক্ষ বিচারে তাকে দোষী সাব্যস্ত করেছে ঢাকার আদালত। সাবেক লেফটেন্যান্ট কর্নেল হলেও তাকে সামরিক আদালতে বিচার করা হয়নি।

১৯৯৬ সাল থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন রাশের চৌধুরী। তিনি তার অপরাধের জন্য সাজা পাননি। ২০০০ সালেই বাংলাদেশ তাকে ফিরিয়ে দিতে অনুরোধ জানিয়েছে। তাবে বিচারের মুখোমুখি করতে এরপরও প্রায় দেড় দশক ধরে অপেক্ষা করে চলছে বাংলাদেশ।

আমার নানাকে যখন হত্যা করা হয়, তখন আমার বয়স ছিল চার। তবে তাকে হারানো আমার নিজের ও পরিবারের জন্য ছিল এক বিরাট ক্ষতি। আমাদের পুরো জাতিই এতে শোকাহত হয়।

শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বাংলাদেশে জাতির জনক এবং দেশটির প্রথম রাষ্ট্রপতি। তিনি বাংলাদেশে সে সময় এমনকি এখনও বঙ্গবন্ধু নামে পরিচিত। বাংলায় এর অর্থ বাংলাদেশের বন্ধু। তিনি ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের দখল থেকে পূর্ববাংলাকে স্বাধীনতার সংগ্রামে নেতৃত্ব দেন। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সে বছরেই আমার জন্ম নয়। সেই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে মাত্র ১১ মাসে ৩০ লাখ বাঙালিকে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তার সহযোগীরা।

এই যুদ্ধের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছিলেন আমার নানা। পাকিস্তানের নির্মম ও স্বৈরতান্ত্রিক শাসনপদ্ধতির বদলে তিনি একটি গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ গড়ে তুলেছিলেন।

আমার নানাকে হত্যার পর তৈরি হয় রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা, নেমে আসে সামরিক শাসনে। জান্তা সরকার খুনিদের রক্ষা করে। এই হত্যায় সুবিধাভোগী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানই তাদেরকে আশ্রয় দেয়ার ব্যবস্থা করেন। তিনি কেবল তাদেরকে বিচার থেকে রক্ষাই করেননি, বাংলাদেশ সরকার ও কূটনৈতিক পদে তিনি তাদেরকে গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি দিয়ে পুরষ্কৃতও করেন। এদের একজন আবার রাষ্ট্রপতি পদে প্রতদ্বন্দ্বিতাও করেন।

১৯৯৬ সালে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে আমার মা ক্ষমতায় ফেরার পর আবার পরিবারের খুনিদের বিচার শুরু হয়। তখন দ্রুত বিচারের দাবি জোরদার ছিল। কিন্তু আমার মা জানতেন, বিচার কেবল নিরপেক্ষ হলেই চলবে না, একে অন্যরাও যেন নিরপেক্ষ ভাবে সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। আইনের শাসন রক্ষা এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে তিনি সাংবিধানিক সীমানার মধ্যে কাজ করা বেসামরিক আদালতে বিচারের সিদ্ধান্ত নেন।

১৯৯৮ সালে ১৫ সাবেক সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এই হত্যা মামলায় রায় ঘোষণা করা হয়। এরপর আপিল ও অন্যান্য প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ২০০৯ সালে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট তাদের রায় ঘোষণা করে। এই রায়ের পরই বিচারের জন্য দীর্ঘকাল ধরে অপেক্ষা করার পর পাঁচ জনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। তবে ঘটনার শেষ হয়নি এখনও।

১৯৯৬ সালে বিচার শুরুর আগে আগেই আরও অনেক কুচক্রীর সঙ্গে রাশেদ চৌধুরী বাংলাদেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। তিনি সান ফ্রান্সিসকোতে রাজনৈতিক আশ্রয় চান। তবে বর্তমানে তিনি কীভাবে সেখানে আছেন, সেটা নিশ্চিত নয়। যুক্তরাষ্ট্রে আসার আগে তিনি লস অ্যাঞ্জেলস এবং শিকাগোতে বসবাস করে আসছিলেন। বাংলাদেশ সরকারের অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও জনাব চৌধুরী নিজেকে লুকিয়ে রেখেছেন। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের তাকে আশ্রয় দেয়া বন্ধ করা উচিত।

জনাব চৌধুরীকে (রাশেদ চৌধুরী) বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হলে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো বাংলাদেশেও রাষ্ট্রদ্রোহ, সন্ত্রাসবাদ এবং খুনের জন্য অপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।

আমার নানার খুনিদের মধ্যে কেবল রাশেদ চৌধুরী নয়, লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দিন আমদের নামে আরও একজন যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় চেয়েছিলেন। কিন্তু ২০০৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের একটি আদালত তার স্থায়ীভাবে থাকার আবেদন প্রত্যাখ্যান করার পর তাকে বাংলাদেশের হাতে তুলে দেয়া হয়। তাকে ২০১০ সালে অন্য চারজনের সঙ্গে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়।

আমরা যতটুকু জানি, রাশেদ চৌধুরীকে এখনও শরণার্থীর স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। ফলে তাকে প্রত্যার্পণ করাই যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে বিলম্বের কোনো যুক্তিই থাকতে পারে না। ন্যয়বিচারের স্বার্থে এই বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে বাংলাদেশের বারংবার অনুরোধের প্রেক্ষিতে ব্যবস্থা নিতেই হবে।
০৮ ডিসেম্বর, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সৈকত/এমএম

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে