মাহফুজ সাদি: ভাষার শিল্পসম্মত রূপই সাহিত্য এবং সাহিত্যের একটি প্রধান ধারা হলো উপন্যাস- একথা সবার জানা। জনপ্রিয় এই ধারাই পারে সহজসাধ্য রূপে সর্বস্তরের মানুষের চাহিদা মেটাতে, মনোরঞ্জন করতে। আর উপন্যাসের কথা এলেই প্রথম যার নাম চোখের সামনে ভেসে ওঠে, তাদের মধ্যে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৪-১৯৫০) অন্যতম। তিনি বাংলা কথাসাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক। তিনি ৫৬ বছর আয়ু পেলেও লেখালেখির জীবন ছিল মাত্র আঠাশ বছরের। গভীর মমতায়, শ্রমে; নিপুণ, দক্ষ শিল্পকুশলতায় প্রকৃতি ও জনজীবনের যে ছবি তিনি এঁকেছেন। ভাষাগত মাধুর্যতা, উপস্থাপন শৈলী ও চারিত্রিক বৈচিত্রতার ব্যাপকতা তাঁর রচনার বিশেষত্ব। যা পাঠককে চুম্বকের মতো টানে এবং মুগ্ধ করে, বিস্মিত করে। তাঁর উপন্যাস পড়ার পর পাঠক এতটাই অভিভূত ও তৃপ্ত হন যে বিভূতিভূষণের বর্ণিত অপরূপ ছবি নিজের চোখে না দেখলেও তা জীবন্ত হয়ে তাদের মনের পর্দায় ভেসে থাকে। এখানেই তাঁর শিল্প সফল্য। তাঁর সাহিত্যকর্মের মধ্যে রয়েছে ১৫টি উপন্যাস, ৭টি কিশোর উপন্যাস, দুইশ’র বেশি ছোটগল্প। এসবের বাইরে অন্যান্য বিষয়েও তিনি লিখে গেছেন। তার মধ্যে রয়েছে ভ্রমণকাহিনী, ডায়েরি, প্রবন্ধ, অনুবাদও ব্যাকরণ বইও রয়েছে। পনেরোটি উপন্যাসের একটি অসমাপ্ত এবং তিনটি বয়স্কপাঠ্যের কিশোর সংস্করণ।
২
১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দের ১২ সেপ্টম্বর পশ্চিমবঙ্গের চবিবশ পরগনার মুরারিপুর গ্রামে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তাঁর পৈতৃক নিবাস ওই জেলারই ব্যারাকপুর গ্রামে। পিতা মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন সংস্কৃত পন্ডিত; পান্ডিত্য ও কথকতার জন্য তিনি ‘শাস্ত্রী’ উপাধিতে ভূষিত হন। তেইশ বছর বয়সে ছাত্র অবস্থায়ই গৌরী দেবীকে (১৯১৭-১৮) বিয়ে করেন বিভূতিভূষণ। কিন্তু বিয়ের বছরখানেক বাদে স্ত্রী নিউমোনিয়ায় মারা যান। এর কিছুদিনের মধ্যেই ছোট বোন মণির সন্তান প্রসব করতে গিয়ে মারা যায়। এই দু’টি মর্মান্তিক ঘটনায় তিনি মারাত্মক আঘাত পেলেন মনে। ফলে ওই দু’টি বিয়োগান্তক ঘটনা পরলোকে বিশ্বাস, এ বিষয়ে ব্যাপক পড়াশোনা এবং চর্চায় ব্রতী করে তাকে। প্রথমা স্ত্রীর মৃত্যুর দীর্ঘ ২২ বছর পরে রমা চট্টোপাধ্যায়কে (১৯৪০-৫০) বিয়ে করেন বিভূতিভূষণ। সেই সংশারে জন্ম নেন একমাত্র সন্তান তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনিও নিজস্ব গুণে উদ্ভাসিত।
৩
বিভূতিভূষণের ছোটবেলা কেটেছে দারিদ্র্যের মধ্যে। নিজ গ্রামের পাঠশালায় হাতে খড়ি বিভূতিভূষণের। মেধাবী ছাত্র হওয়ায় ১৯১৪ সালে স্থানীয় বনগ্রাম স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে এন্ট্রান্স পাস করেন। এরপর তিনি কলকাতা রিপন কলেজ থেকে ১৯১৬ সালে প্রথম বিভাগে আইএ এবং ১৯১৮ সালে ডিস্টিংশনে বিএ ডিগ্রি লাভ করেন। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে, একই সঙ্গে এমএ দর্শন ও আইন বিভাগে ভর্তি হন। কিন্তু পাঠ অসমাপ্ত রেখেই ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি কর্মজীবনের প্রবেশ করেন। শুরুতে হুগলির জাঙ্গিপাড়া মাইনর স্কুলে সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। এরপর তিনি সোনারপুর হরিণাভি স্কুলেও কিছু দিন শিক্ষকতা করেন। কিছুদিন তিনি ‘গো রক্ষিণী সভা’র ভ্রাম্যমাণ প্রচারক হিসেবেও চাকুরি করেন। দেশে গো সম্পদ সুরক্ষা করার বিষয়ে জনমত সৃষ্টি ছিল এই প্রচারকের লক্ষ্য। কিন্তু খুব বেশিদিন এই চাকরিতে না থাকলেও বাংলা, আসাম, ত্রিপুরা ও আরাকানের বিভিন্ন অঞ্চল ভ্রমণ করেন। তারপর তিনি পাথুরিয়াঘাটার জমিদার খেলাতচন্দ্র ঘোষ এস্টেটে সেক্রেটারি ও গৃহশিক্ষক এবং তাঁর এস্টেটের বিহারের ভাগলপুর সার্কেলের সহকারী ম্যানেজার নিযুক্ত হন। সেই সময়ে জমিদারে চেয়ারে ছিলেন তার পৌত্র সিদ্ধেশ্বর ঘোষ। পরে কলকাতার ধর্মতলাস্থ খেলাতচন্দ্র ক্যালকাটা ইনস্টিটিউশন মেমোরিয়াল বিদ্যায়তনের আবার শিক্ষকতায় নিয়োজিত হন। এদের সঙ্গে বিভিন্নভাবে ১৯২৩ থেকে ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত যুক্ত ছিলেন বিভূতিভূষণ। তারপর তিনি গোপালনগর স্কুলে যোগদান করেন এবং আমৃত্যু সেখানেই কর্মরত ছিলেন।
৪
১৯২১ সালে (১৩২৮ বঙ্গাব্দের মাঘ মাসে) প্রবাসী’তে প্রথম গল্প ‘উপেক্ষিতা’ প্রকাশের মধ্য দিয়ে বিভূতিভূষণের সাহিত্যিক জীবন শুরু হয়। ভাগলপুরে চাকরি করার সময় ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি ‘পথের পাঁচালী’ রচনা শুরু করেন এবং শেষ করেন ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে। তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্মের মধ্যে উপন্যাস হলো : অপরাজিত (প্রথম ও দ্বিতীয় খন্ড, ১৯৩১), দৃষ্টি প্রদীপ (১৯৩৫), আরণ্যক (১৯৩৯), আদর্শ হিন্দু-হোটেল (১৯৪০), দুই বাড়ী (১৯৪১), বিপিনের সংসার (১৯৪১), অনুবর্ত্তন (১৯৪২), দেবযান (১৯৪৪), কেদার রাজা (১৯৪৫), অথৈ জল (১৯৪৭), ইছামতী (১৯৫০), ও কাজল (তাঁর পুত্র তারাদাস কর্তৃক সম্পন্ন) । তাঁর মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয়- দম্পতি (১৯৫২), অশনি-সংকেত (১৯৫৯) এবং অনশ্বর (অসমাপ্ত)। শিশু-কিশোর সাতটি উপন্যাস হলো : চাঁদের পাহাড় (১৯৩৭), মরণের ডঙ্কা বাজে (১৯৪০), মিসমীদের কবচ (১৯৪২), ছোটদের পথের পাঁচালী, আম-আঁটির ভেঁপু, ছেলেদের আরণ্যক, হীরামানিক জ্বলে (১৯৪৬), সুন্দরবনে সাতবছর (১৯৫২, ভুবনমোহন রায়ের সহযোগিতায়)। ভ্রমণকাহিনী ও দিনলিপি : অভিযাত্রিক (১৯৪০), স্মৃতির রেখা (১৯৪১), তৃণাঙ্কুর (আত্মজীবনীমূলক, ১৯৪৩), ঊর্মিমুখর (১৯৪৪), বনে পাহাড়ে (১৯৪৫), উৎকর্ণ (১৯৪৬) ও হে অরণ্য কথা কও (১৯৪৮)। গ্রাফিক উপন্যাস : মুন মাউন্টেন। অনুবাদ উপন্যাস: আইভ্যানহো। গল্পগন্থ : মেঘমল্লার (১৯৩১), মৌরীফুল (১৯৩২), যাত্রাবাদল (১৯৩৪), জন্ম ও মৃত্যু (১৯৩৮), কিন্নর দল (১৯৩৮), বেণীগির ফুলবাড়ী (১৯৪১), নবাগত (১৯৪৪), তালনবমী (১৯৪৪), উপলখন্ড (১৯৪৫), বিধুমাস্টার (১৯৪৫), ক্ষণভঙ্গুর (১৯৪৫), অসাধারণ (১৯৪৬), মুখোশ ও মুখশ্রী (১৯৪৭), আচার্য কৃপালিনী কলোনি (বর্তমান নাম ‘নীলগঞ্জের ফালমন সাহেব’, ১৯৪৮), জ্যোতিরিঙ্গন (১৯৪৯), কুশল-পাহাড়ী (১৯৫০), রূপ হলুদ (১৯৫৭), অনুসন্ধান (বঙ্গাব্দ ১৩৬৬), ছায়াছবি (বঙ্গাব্দ ১৩৬৬) ও সুলোচনা (১৯৬৩)। ছোটগল্প সংকলন : বিভূতিভূষণের ছোটগল্প, ছোটদের শ্রেষ্ঠ গল্প, গল্প-পঞ্চাশত্, সুলোচনা, প্রেমের গল্প, অলৌকিক, বিভূতি-বিচিত্রা, বাক্স বদল, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কিশোর-সঞ্চয়ন, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোটদের ভালো ভালো গল্প এবং বিভূতি বীথিকা। অন্যান্য : বিচিত্র জগৎ (১৯৩৭), টমাস বাটার আত্মজীবনী (১৯৪৩), আমার লেখা (বঙ্গাব্দ ১৩৬৮), প্রবন্ধাবলী, পত্রাবলী, দিনের পরে দিন ইত্যাদি। তার গল্পের উপর ভিত্তি করে নির্মিত চলচ্চিত্র : পথের পাঁচালী (১৯৫৫), অপরাজিত (১৯৫৭), অপুর সংসার (১৯৫৯), বাক্স বদল অমর প্রেম (১৯৭২), নিমন্ত্রণ অশনি সংকেত (১৯৭৩), ফুলেস্বরী আলো (২০০৩) ও চাঁদের পাহাড় (২০১৩)।
তাঁর দিনলিপি-গ্রন্থ ‘স্মৃতির রেখা’র কিছু উদ্ধৃতির সাথে ‘আরণ্যক’ উপন্যাসের ভাবগত আশ্চর্য সাদৃশ্য পাওয়া যায়। ১৯২৮ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারি ‘স্মৃতির রেখা’তে তিনি লিখছেন, ‘...এই জঙ্গলের জীবন নিয়ে একটা কিছু লিখবো- একটা কঠিন শৌর্যপূর্ণ, গতিশীল, ব্রাত্য জীবনের ছবি। এই বন, নির্জ্জনতা, ঘোড়ায় চড়া, পথ হারানো- অন্ধকার- এই নির্জ্জনে জঙ্গলের মধ্যে খুপড়ি বেঁধে থাকা। মাঝে মাঝে, যেমন আজ গভীর বনের নির্জ্জনতা ভেদ করে যে শুঁড়িপথটা ভিটে-টোলার বাথানের দিকে চলে গিয়েছে দেখা গেল, ঐ রকম শুঁড়িপথ এক বাথান থেকে আর এক বাথানে যাচ্ছে- পথ হারানো, রাত্রের অন্ধকারে জঙ্গলের মধ্যে ঘোড়া করে ঘোরা, এদেশের লোকের দারিদ্র্য, সরলতা, ারৎরষব, ধপঃরাব ষরভব, সন্ধ্যায় অন্ধকারে ভরা গভীর বন ঝাউবনের ছবি—এই সব।’ ‘আরণ্যক’-এ উল্লিখিত গোষ্ঠবাবু মুহুরী, রামচন্দ্র আমীন, আসরফি টিন্ডেল, জয়পাল কুমার, পন্ডিত মটুকনাথ এবং রাখাল ডাক্তারের স্ত্রীর কথা ঐ দিনলিপিতেও পাওয়া যায়।
সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি বিভূতিভূষণ সম্পাদনার দায়িত্বও পালন করেন। তিনি চিত্রলেখা (১৯৩০) নামে একটি সিনেমা পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। তাছাড়া হেমন্তকুমার গুপ্তের সঙ্গে যৌথভাবে তিনি দীপক (১৯৩২) নামে একটি পত্রিকাও সম্পাদনা করেন। দিনলিপির পাশাপাশি তাঁর লেখা অসংখ্য চিঠিও ব্যক্তি, সমাজ ও সাহিত্য জীবনের বহুমাত্রিক চিত্র ফুটে উঠেছে। চিঠিপত্রও নেহয়াত কম নয়।
৫
নিভৃতচারী বিভূতিভূষণের মধুর ও কাব্যধর্মী ভাষাশৈলীর কারণে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেন। আর ছোট গল্পে গীতিকবির দৃষ্টিভঙ্গি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। তাঁর শ্রেষ্ঠতম রচনা হল ‘পথের পাঁচালী’। উপন্যাসটি এক বছরেরও বেশি সময় ধরে ধারাবাহিকভাবে মাসিক ‘বিচিত্রা’য় বেরোনোর পর প্রথম গ্রন্থ আকারে প্রকাশিত হয়। জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে লেখার কারণে পথের পাঁচালী হয়ে ওঠে জীবনের পাঁচালীও। প্রথম রচিত এই উপন্যাসের মাধ্যমেই তিনি বিপুল খ্যাতি অর্জন করেন। গ্রন্থটি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মন্তব্য করেছিলেন, ‘বইখানা দাঁড়িয়ে আছে আপন সত্যের জোরে।’ ‘অপরাজিত’ পথের পাঁচালীরই পরবর্তী অংশ। উপন্যাস দু’টিতে পথের সীমাবদ্ধতা ও অনির্দেশ্যতা যেখানে জীবনের দৃষ্টি ও সৃষ্টি-পথকে সঙ্কটাপন্ন করে, জীবন যেখানে বাস্তব অভিজ্ঞতার জগৎ অতিক্রম করে সৌন্দর্য-কল্পনার পথে ধাবিত হয়, সেখানে মানব জীবন পাঁচালীর প্রকৃত সার্থকতা। পথের পাঁচালী উপন্যাসটি ভারতীয় বিভিন্ন ভাষাসহ ইংরেজি ও ফরাসি ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
অন্যদিকে পথের পাঁচালীকে চলচ্চিত্রে রূপদানের মাধ্য দিয়ে পরিচালক জীবন শুরু করেন সত্যজিৎ রায়। এই চলচিত্রটি তাকেও প্রতিষ্ঠিত করে খ্যতিমান নির্মাতা হিসেবে। প্রথম এই ছায়াছবিটির জন্য দেশিবিদেশী বহু পুরস্কার লাভ করেন তিনি। ফলে বিশ্বনন্দিত হন সত্যজিৎ আর বহির্বিশ্বেও ছড়িয়ে পড়ে পথের পাঁচালী। বিভূতিভূষণের ‘অপরাজিত’ এবং ‘অশনি সংকেত’ উপন্যাস দুটি অবলম্বনেও অসাধারণ চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন এবং ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হন তিনি।
চরিত্রিক ব্যাপকতার জন্য পথের পাঁচালীর দুর্গা অন্যতম সেরা নারী চরিত্রের মর্যাদা লাভ করেছে। দুর্গা বাংলার চিরাচরিত চঞ্চল কিশোরী কন্যার এক উজ্জ্বল প্রতিচ্ছবি। তার চঞ্চলতা, হাস্যময়তা, ছোট্ট ভাইটির প্রতি অপরিসীম ভালোবাসা দুর্গা চরিত্রকে মোহনীয় করে তুলেছে। এই উচ্ছল চপলা বঙ্গকিশোরীর শৈশবেই নারীসুলভতা তাকে স্বকীয়তায় বিশেষিত করেছে। ট্রেনের ঝিঁক ঝিঁক শব্দে অপু আর দুর্গার দৌড় কল্পনা করলে কে না পুলকিত হবে? উপন্যাস পড়ে বা ছায়াছবি দেখে দুর্গাকে ভালোবাসেনি, দুর্গার মৃত্যুতে কাদেনি এমন লোক খুব কমই পাওয়া যাবে!
আঞ্চলিক জনজীবন নির্ভর ‘ইছামতী’ উপন্যাসটিও বিভূতিভূষণের আরেকটি সেরা রচনা। এটি নদীর নামে রচিত হলেও নদীভিত্তিক নয়। এতে নদীপাড়ের মানুষের স্নান ছাড়া আর কিছু পাওয়া যাবে না। মূলত: এ উপন্যাসে ব্রিটিশ আমলের মধ্যভাগের একটি গ্রামীণ জনসমাজ ও পারিপাশ্বর্কি ঘটনাপ্রবাহকে তুলে ধরা হয়েছে। সঙ্গে অনুষঙ্গ করা হয়েছে তিতুমীরের, ইংরেজ নীল কুঠিয়ালদের আংশিক ইতিহাস। বিভিন্ন ঘটনার মাধ্যমে সেসময়ের জনজীবনকে, জনমানসকে এবং ইতিহাসের অনিবার্য পরিণতিকে তুলে এনছেন বিভূতিভূষণ। তিনি নিজেই লিখেছেন- ‘এ সময় পল্লীগ্রামে দোতলা প্রদীপ বা সেজ ব্যবহার হতথ তলায় জল থাকত, উপরের তলায় তেল।’ উল্লেখ্য, সে তেল ছিল রেড়ির তেল অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছেলেবেলার সময়।
৬
কথাশিল্পী বিভূতিভূষনের সাহিত্যকর্মে পল্লীর সৌন্দর্য ও নৈসর্গিক রূপায়ণে বাংলার আবহমানকালের জনজীবনের সতেজ চিত্র এবং মানবজীবনের অন্তর্নিহিত সত্তার পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর রচনায় প্রকৃতি ও মানবজীবন একীভূত হয়ে অভিনব এক রসমূর্তি ধারণ করেছে। মানুষ যে প্রকৃতির সন্তান এ সত্য উপস্থাপিত হয়েছে রচনার সারা গাঁয়ে। প্রকৃতির লতাপাতা, ঘাস, পোকামাকড় সবকিছুই সমহিমায় উঠে এসেছে বিভূতিভূষণের কথাশিল্পে। তাঁর সাহিত্যে প্রকৃতির অনুপুঙ্খ বর্ণনার মধ্য দিয়ে গভীরদের পাশাপাশি নিম্ন মধ্যবিত্ত বাঙালির জীববৈচিত্র ও সমকালের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতাও উন্মোচিত হয়েছে সমান তালে। হোসেন মাহমুদ বাংলা উপন্যাসে জনপ্রিয়তার শীর্ষস্থান অধিকারকারীদের তালিকায় বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্রের পরের স্থনটিই বিভূতিভূষণের। বাংলা সাহিত্যে তাঁর রচনা মৌলিক হিসেবে বিবেচিত হয়।
৭
ইছামতী উপন্যাসের জন্য বিভূতিভূষণ মরণোত্তর ‘রবীন্দ্র-পুরস্কার’ (১৯৫১) লাভ করেন। এছাড়া তার সম্মানে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার বনগাঁ মহকুমার (লেখকের জন্মস্থান) পারমাদান বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের নামকরণ করা হয়েছে ‘বিভূতিভূষণ বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য’। ১৯৫০ সালের ১ নভেম্বর ব্যারাকপুরের ঘাটশিলায় পরলোক গমন করেন বাংলা কথাসাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক। তাঁর সমকালে আর দুজন দাপুটে ঔপন্যাসিক ছিলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯০৮-১৯৫৬) ও তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৮-১৯৭১)।
৮
‘পথের পাঁচালী’ থেকে শুরু করে ‘অশনি সঙ্কেত’ পর্যন্ত তার সাহিত্য পরিক্রমায় গ্রামজীবনের রূপকার রূপে অবর্তীর্ণ হয়েছেন বিভূতিভূষণ। ভাষাহারা প্রকৃতি যেনো তাঁর লেখনির যাদু স্পর্শে জীবন্ত ও বাঙ্ময় মূর্তি ধারণ করেছে। তার উপন্যাসের চরিত্র সমূহ প্রকৃতির সহজ-সরল সন্তান। অন্যদিকে অনেক বৈচিত্র্য ও ব্যাপ্তি, জীবনের অনেক রহস্য ও জটিলতা আবিস্কার করেছেন তিনি। মানুষের জীবনের ছোট-ছোট হাসি-কান্না, মান-অভিমান, সাফল্য-ব্যর্থতা যেভাবে জড়িয়ে থাকে তাঁর রচনায়, মনে হয় এর যেনো কোনো অন্ত নেই, কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। ১৩৮৭ বঙ্গাব্দে কলকাতার মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত বিভূতি রচনাবলী দ্বাদশ খণ্ডে ‘বিভূতিভূষণকে যেমন দেখেছি’ শিরোনামের একটি লেখা লেখেছেন অন্নদাশঙ্কর রায়। সেখানে তিনি লিখেছেন- ‘এমন প্রকৃতি-পাগল সাহিত্যিক বাংলা সাহিত্যে বিরল। প্রকৃতিকে চোখে দেখে ভালো লাগে না কার? কিন্তু তাকে ভালোবেসে তার গভীরে অবগাহন করা অন্য জিনিস। বিভূতিকে সেই জন্যে বছরে কয়েকমাস অরণ্যবাস করতে হতো। আর কয়েক মাস পল্লীর কোলে কাটাতে হতো। ইছামতী নদীর কূলে। তাঁর জীবনের যুগল মেরু ছিল অরণ্য ও দক্ষিণায়ন। শহরে থাকলেও তিনি শহুরে ছিলেন না। কোনোদিন হতে চাননি। নাগরিক সভ্যতা তাকে বশ করতে পারেনি। তার পোশাকে-আশাকে নাগরিকতার লেশ ছিল না। বৈঠকখানায় তিনি বেমানান। চিড়িয়াখানায় যেমন চিড়িয়া।’
৯
বহুমাত্রিক আলোচনা হলো, পরিশষে ঘরের অন্ধের মহলের রোমাঞ্চ কথাবার্তার দিয়ে শেষ করা যাক। ৪৬ বছরের গৌঢ় বিভূতির কাছে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে হাজির হন ১৬ বছরের রমা চট্টোপাধ্যায়। অবশ্য ৩০ বছরের ছোট হলেও হবু বরের সাহিত্য অনুরাগী ছিলেন তিনি। কিশোরী কন্যার এ প্রস্তাব শুনে বিভূতিভূষণ গায়ের জামা খুলে বুকের কাঁচাপাকা রোম দেখিয়ে বললেন, ‘দ্যাখো, আমার অনেক বয়স হয়েছে, আর ক’দিনই বা বাঁচবো?’.... জবাবে সদ্য যুবতী রমা অবলীলায় বলেন, ‘আপনি যদি আর একটা বছরও বাঁচেন, তাহলেও আমি আপনাকেই বিয়ে করবো।’
অবশেষে ১৯৪০ সালের ৩ ডিসেম্বর তাদের বিয়ে হয়। মাত্র ১০ বছরের দাম্পত্য জীবনের ইতি ঘটে ১৯৫০-এর পয়লা ডিসেম্বর। ফলে মাত্র ২৭ বছরে ভরা যৌবনে মুছে যায় সিঁথির সিদুর। তারপর শিশুপুত্র নিয়ে বিধবা জীবন কাটান রমা। অথচ তিনি নিজেরও ছিলেন সাহিত্য-প্রতিভার অধিকারী। ছোট থেকেই লিখতেন এবং হাতে লেখা পত্রিকা বের করতেন। প্রসিদ্ধ ‘দেশ’ পত্রিকার কোনো এক সংখ্যায় একই সাথে প্রকাশিত হয়েছিলো রমার ছোটগল্প ‘স্বপ্ন’ এবং বিভূতিভূষণের ‘স্বপ্ন বাসুদেব’।
স্বামীকে নিজের দেয়া নাম ‘মঙ্কু’ বলেই ডাকতেন রমা। আর বিভূতি ডাকতেন ‘কল্যাণী’, ‘তুই’ বলে। যুগলে প্রচুর বেড়াতেন দেশজুড়ে। ছাপা হয়ে বেরোনোর আগে ধরে ধরে পড়তেন সাহিত্যিক স্বামীর সমস্ত লেখা। প্রয়োজনে দিতেন পরামর্শ, জমাতেন আলোচনা-সমালোচনাও। বিভূতিভূষণের খ্যাতি বিশ্বজোড়া হলেও সামনে আসেনি তার স্ত্রী রমা চট্টোপাধ্যায়ের নাম। অথচ নিজগুণে তিনিও পারতেন শক্তিধর মহাতারকা হতে। হয়তো তিনি ভেবেছেন, পৃথিবী কোনো নিভৃত কোনের একটি মানুষও যদি বিভূতিভূষণের কথা মনে রাখে, তার সাথে জড়িয়ে থাকবে রমার নামটিও।
লেখক: কবি, সাংবাদিক ও গবেষক।
১২ সেপ্টেম্বর ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এসএম/ডিআরএ