মঙ্গলবার, ১৩ অক্টোবর, ২০১৫, ০৩:১৬:৩৭

রাজনীতির নতুন হাওয়া বইছে তৃণমূলে

রাজনীতির নতুন হাওয়া বইছে তৃণমূলে

বিশেষ প্রতিনিধি : স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে এতদিন ছিল ঢাকঢাক গুড়গুড়। জেনেও না জানার ভান। মনোনয়ন দিচ্ছে দল। মন্ত্রী, নেতাকর্মী ও রাজনৈতিক নেতারা নিজেদের প্রার্থীদের পক্ষে মাঠ-ময়দান চষে বেড়াচ্ছেন। বলা হতো, এ কোনো দলীয় নির্বাচন নয়। অবশেষে অপ্রয়োজনীয় পর্দাটি উঠে যাচ্ছে। আগামীতে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হবে দলীয় ভিত্তিতে। দল প্রার্থী মনোনয়ন দেবে। দলীয় নেতাকর্মীরা নিজেদের প্রার্থীর পক্ষে কাজ করবেন। প্রতীকও থাকবে দলের। অর্থাৎ স্থানীয় নির্বাচনে লাগছে দলীয় নির্বাচনের হাওয়া।

প্রধানমন্ত্রী অনেক আগেই স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় ভিত্তিতে হওয়ার পক্ষে মত প্রকাশ করেছিলেন। ভারত, ব্রিটেনসহ বহু দেশেই স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় ভিত্তিতে হয়ে থাকে। অতিসম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গে 'পুর নির্বাচন' হলো স্ব স্ব দলের প্রতীকে। যদিও এই নির্বাচন ঘিরে বড় ধরনের সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে সেখানে। বাংলাদেশে স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয়ভাবে অনুষ্ঠানের ব্যাপারে মতদ্বৈধতা রয়েছে। বিএনপি অবশ্য এর মধ্যে 'দুরভিসন্ধি' খুঁজে পেয়ে এই উদ্যোগের বিরোধিতা করেছে।

গতকাল সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে সচিবালয়ে মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, উপজেলা পরিষদ, সিটি করপোরেশনের নির্বাচন আইন সংশোধনের খসড়ায় নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়। বৈঠক শেষে এ ব্যাপারে সাংবাদিকদের বিশদভাবে অবহিত করেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা।

তিনি জানান, ডিসেম্বরের মধ্যে পৌরসভা নির্বাচন করার বাধ্যবাধকতা থাকায় 'স্থানীয় সরকার নির্বাচন (পৌরসভা) (সংশোধন) আইন-২০১৫' অধ্যাদেশ আকারে জারি হবে। এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট আইনে কয়েকটি সংশোধনীও আনতে হবে।

স্থানীয় সরকার নির্বাচন কার্যত দলীয়ভাবে হলেও একে 'নির্দলীয়' নির্বাচন হিসেবে প্রচার অনেকটা আত্মপ্রবঞ্চনামূলক বলে মনে করেন অনেকেই। ২০০৮ সালে ৪ সিটি নির্বাচন একসঙ্গে অনুষ্ঠানের অভিজ্ঞতার পর তদানীন্তন নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছিলেন, 'নির্দলীয় স্থানীয় সরকার নির্বাচন শুধু কাগজে-কলমে। প্রকৃত অর্থে তো নির্বাচন হচ্ছে দলীয়ভাবে। স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয়ভাবে হলে যে কোনো সমস্যার জন্য রাজনৈতিক দলগুলো দায়ী থাকে। এতে কাজে অনেক সুবিধা হয়।'

প্রতিক্রিয়া: আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ প্রতিবেদককে বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন নির্দলীয় বলা হলেও একপর্যায়ে এসে তা দলীয় রূপ নিত। এতে মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হতো। তাই দলীয়ভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হওয়া সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে জনগণের প্রত্যাশারই প্রতিফলন হয়েছে। এখন যেসব স্থানীয় প্রতিনিধি নির্বাচিত হবেন, তাদের রাজনৈতিক পরিচয় থাকবে, যা নির্বাচনী এলাকার মানুষের জন্য বেশি পরিমাণে উন্নয়নমূলক কাজ করতে সহায়তা করবে।

মহাজোটের শরিক দল জাসদ এবং ওয়ার্কার্স পার্টির পক্ষ থেকেও দলীয় প্রতীকে স্থানীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে আইনের সংশোধনকে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অপর শরিক দল জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে গতকাল কেউই এ ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেননি।

সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এই প্রতিবেদককে বলেন, বাংলাদেশে নির্বাচনের অর্থ বড় দুই রাজনৈতিক দলের কালো টাকার ছাড়াছড়ি, পেশিশক্তির ব্যবহার, মনোনয়নবাণিজ্য। আগে সংসদ নির্বাচনে এসব হতো, এখন স্থানীয় নির্বাচনেও তা ছড়িয়ে দেওয়া হলো। সরকার সব পর্যায়ে দলীয়করণ ছড়িয়ে দিচ্ছে। স্থানীয় সরকারের ক্ষেত্রে দলীয়করণ প্রকট করার জন্যই এ সিদ্ধান্ত।

বিশেষজ্ঞরা যা বলেন: স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. তোফায়েল আহমেদ প্রতিবেদককে বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন এতদিন অনানুষ্ঠানিকভাবে দলীয় ভিত্তিতেই হয়েছে। এখন সেটা আনুষ্ঠানিকভাবে হবে। এ নিয়ে দীর্ঘদিন থেকেই নানা আলোচনা, বিতর্ক চলে আসছিল। তিনি বলেন, দলীয় ভিত্তিতে স্থানীয় নির্বাচন পৃথিবীর অনেক দেশেই হয়। এটার ইতিবাচক দিক হচ্ছে, এর ফলে রাজনৈতিক দলগুলোকে স্থানীয় পর্যায়ে নিজেদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার দিকে নজর দিতে হবে। এমনকি ক্ষমতাসীন দলকেও ক্ষমতার মেয়াদের মধ্যে স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনে জনপ্রিয়তার পরীক্ষা দিতে হবে।

এর ফলে স্থানীয় পর্যায়ে নেতৃত্ব সুসংগঠিত হবে এবং তৃণমূল থেকে জাতীয় পর্যায়ের নেতৃত্ব তৈরি হওয়ারও সুযোগ সৃষ্টি হবে। এর বিপরীত দিকটাও আছে। তিনি বলেন, বিপরীত দিক হচ্ছে, দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতন্ত্রের চর্চা এবং স্বচ্ছতা অনুপস্থিত। বরং হানাহানি, হিংসা, নির্বাচন ঘিরে মনোনয়নবাণিজ্য রয়েছে। যদি রাজনৈতিকগুলো দায়িত্বশীল না হয়, তাহলে রাজনীতির এই নেতিবাচক দিকগুলো একেবারে স্থানীয় পর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত হবে, যেটা গণতন্ত্রের জন্য খুবই খারাপ ফল বয়ে নিয়ে আসবে। আইনের সংশোধন ঠিকই আছে, কিন্তু এই সংশোধন কতটা সুফল দেবে তা নির্ভর করবে রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্বশীল আচরণের ওপর।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার এই প্রতিবেদককে বলেন, বর্তমান সরকারের অনেক খারাপ সিদ্ধান্তের মধ্যে এ সিদ্ধান্ত একটি। কারণ, জাতীয় পর্যায়ের মনোনয়নবাণিজ্য স্থানীয় পর্যায়ে ছড়িয়ে দেওয়ার আয়োজন হলো। পাশাপাশি স্থানীয় নির্বাচনে প্রশাসনকে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে ব্যবহার, পেশিশক্তির প্রয়োগের মাধ্যমে প্রহসনের নির্বাচনের আয়োজনটাও পাকাপোক্ত করা হলো। যেমনটা বিগত ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দেখা গেছে। তিনি বলেন, এর ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলো ইউনিয়ন পরিষদ। আগে ইউনিয়ন পরিষদে অন্তত অনেক ভালো লোক নির্বাচিত হতেন। এখন আর সে সুযোগ থাকবে না।

সংবিধান ও নির্বাচন আইন বিশেষজ্ঞ ড. শাহ্দীন মালিক বলেন, এখন স্থানীয় সরকার নির্বাচন ব্যবস্থা এবং আইন বাস্তবমুখী হলো। বহুদলীয় গণতন্ত্রে যেমন রাজনৈতিক দলের মধ্যে নির্বাচন হয়ে সরকার-সংসদ গঠন করা হয়, স্থানীয় সরকার নির্বাচনও তেমনি হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবতার উল্টো পিঠ রয়েছে। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলো গণতান্ত্রিক নয়।

দলের ভেতরে গণতন্ত্রের চর্চা, নেতৃত্ব বিকশিত হওয়ার ব্যবস্থা নেই। এর বদলে ক্ষমতার অপব্যবহার, ব্যক্তি নিয়ন্ত্রণে সবকিছু কুক্ষিগত করা, কালো টাকার মালিক হওয়া- এসবের প্রতিযোগিতা রয়েছে। আশঙ্কাটা সেখানেই, স্থানীয় পর্যায়েও সেই অশুভ প্রতিযোগিতা ব্যাপক মাত্রায় ছড়িয়ে না পড়ে।

তিনি আরও বলেন, সংবিধানে বলা হয়েছে, স্থানীয় সরকারের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি থাকবে। কিন্তু সংশোধিত আইনে মেয়াদ শেষে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির পরিবর্তে প্রশাসক নিয়োগের কথা বলা হয়েছে, যেটি সংবিধানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।-সমকাল
১৩ অক্টোবর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এস.এ.সুমন/একে

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে