মঙ্গলবার, ১৩ অক্টোবর, ২০১৫, ০৫:০২:৫৪

বিশ্বস্ততাই অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠানের মূলধন

বিশ্বস্ততাই অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠানের মূলধন

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম : আজ চার-পাঁচ দিন কুঁড়ির জ্বর। সেদিন ঢাকায় এসেছিলাম। আজ ২৫৯ দিন বাড়ি যাই না। ছোট বোন শাহানার বাসায় উঠেছি। সেই '৭০-'৭১-এ দুলাল যে যত্ন করত, এখনো তেমনি করে। কিন্তু মেয়েটার শিয়রে বসে মাথায় হাত বুলাতে পারি না, সে জন্য বুকটা কেমন আনচান করে। মেয়েটাও আমারই মতো জ্বরে পাগল হয়ে যায়। কুশি ছোট্ট মানুষ। বোনের মাথার কাছে বসে থাকে, টিপেটুপে দেয়। কিন্তু তা আর কতক্ষণ! তাই নির্বাচন নিয়ে ছোটাছুটি করায় মেয়েটার জন্য কিছুই করতে পারছি না। কেন যে ওর এমন জ্বর এলো! আল্লাহ যেন ওকে দয়া করেন, তাড়াতাড়ি সুস্থ করে দেন কায়মনে এ প্রার্থনাই করি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর জনাব আতিউর রহমান এশিয়ার শ্রেষ্ঠ গভর্নরের সম্মান পেয়েছেন। খবরটা আমাদের জন্য এক পরম আনন্দের। মাত্র কদিন আগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা দেশের জন্য বয়ে এনেছেন 'চ্যাম্পিয়নস অব দি আর্থ'। আমরা একসময় এমন সম্মানেরই যোগ্য ছিলাম। ক্ষয়িষ্ণু সমাজে অস্থিরতার কারণে অনেক ক্ষেত্রে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। তার পরও দৃঢ়তা ও বিশ্বস্ততার সঙ্গে চেষ্টা করলে আমরা যে এখনো শ্রেষ্ঠ- এসব তো তারই প্রমাণ।

রাজনৈতিক অবিশ্বাস ও একজন আরেকজনকে ছোট করার প্রবণতা ত্যাগ করতে পারলে এখনো আমাদের অবস্থান হিমালয়ের উচ্চ শৃঙ্গ কাঞ্চনঝঙ্ঘার কাছাকাছি। বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন সফল গভর্নর আতিউর রহমান এশিয়ার সেরা গভর্নর হওয়ায় আমি তাকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাচ্ছি। জনাব আতিউর রহমানকে নিয়েই যখন লেখার সূচনা তখন ব্যাংক নিয়ে দু-চার কথা বলি। ব্যাংক এমন একটি অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠান যার নিজের কানাকড়ি সম্পদ থাকে না।

আগের দিনের 'ফুটো পয়সা' এখন অনেকেই হয়তো বুঝবেন না। মাঝখানে ছিদ্র। পৃথিবীর কোনো ব্যাংক সেই ফুটো পয়সার মালিকও নয়। ব্যাংক সব সময় পরের ধনে পোদ্দারি করে। একটা ঘর ভাড়া নিয়ে ধোপদুরস্ত টাই পরা কিছু মানুষ, কয়েকটি টেবিল-চেয়ার, কাগজ-কলম নিয়ে বসে পড়ে। তাদের কাজ পোস্ট অফিসের মতো। বিশ্বস্ততার কারণে লোকজন টাকা-পয়সা তাদের কাছে জমা রাখে। একজনের টাকা আরেকজনকে দিয়ে যারা সুন্দর ব্যবস্থাপনা করতে পারে তারাই সফল। ভারতে থাকার সময় ব্যাংক অব বরদার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে বেশ কয়েকবার ব্যাংকিং নিয়ে প্রচুর আলোচনা হয়েছে। তা ছাড়া জনাব শেখ শহীদের শ্বশুর মুশফিক সালেহীন ছিলেন আমার ব্যাংক সম্পর্কে জ্ঞানদাতা। এ ছাড়া একসময় অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জামালপুরের মোস্তফা আমিনুর রশিদ, নাসির উদ্দিন বখতিয়ারের কাছ থেকেও অনেক জ্ঞান অর্জন করেছি। ব্যাংক নাকি ১০ টাকা ৯ বার ঋণ দেয়।

সময়মতো আদান-প্রদানই ব্যাংকের সফলতা। ঘর-দুয়ার, টেবিল-চেয়ার, কাগজ-কলম প্রায় সবই সংগ্রহ করে কর্জ করে। যাদের কাজ কর্জ দেওয়া-নেওয়া, তাদের শুরু কর্জ করে, ঋণ অথবা ভাড়া নিয়ে। ব্যাংকের সব থেকে বড় সম্পদ তার বিশ্বস্ততা। কোনো ব্যাংক যদি তার বিশ্বস্ততা হারিয়ে ফেলে লক্ষ হাজার কোটি টাকা থাকলেও তাদের ব্যবসা থাকে না। আর এখন ব্যাংকিং শুধু জাতীয় নয়, তাকে আন্তর্জাতিক আদান-প্রদান আইন-কানুনের বাধ্যবাধকতা মানতে হয়। বিশ্বস্ততা না থাকলে বিদেশ তাদের লেটার অব ক্রেডিট গ্রহণ করবে কেন?

একসময় ব্যাংক সম্পর্কে আমার কোনো জ্ঞান ছিল না। এমনকি ট্যাক্স সম্পর্কেও তেমন ধারণা ছিল না। স্বাধীনতার পর তখনকার প্রয়োজনে শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে সোনার বাংলা প্রকৌশলিক সংস্থা (প্রা.) লি. নামে একটি নির্মাণ প্রতিষ্ঠান গড়ে না উঠলে আয়কর সম্পর্কে হয়তো তেমন কোনো ধারণাই থাকত না। '৭৫-এ বঙ্গবন্ধু নির্মমভাবে নিহত হলে সোনার বাংলা প্রকৌশলিক সংস্থা (প্রা.) লি.-এর কপালে প্রথম আঘাত আসে।

প্রায় ১ কোটি কয়েক লাখ টাকার সমাপ্ত কাজের অর্থ থেকে সংস্থা বঞ্চিত হয়। '৯০-এ দেশে ফিরলে দেখা যায় উত্তরা ব্যাংক আমাদের নামে অর্থ ঋণ আদালতে ৭২ লাখ টাকার মামলা করেছে। তখন সিএসপি আনিসুজ্জামান ছিলেন উত্তরা ব্যাংকের চেয়ারম্যান। '৭৫-এ তার সঙ্গে আমি জেলা গভর্নর হয়েছিলাম। বড় পরোপকারী সাত্তি্বক মানুষ। হঠাৎই একদিন সস্ত্রীক ধনবান হৃদয়বান জহুরুল ইসলাম আমার মোহাম্মদপুরের বাড়ি এসেছিলেন।

বহুদিন পর তার সঙ্গে দেখা। খাওয়া-দাওয়া শেষে বলেছিলেন, 'ব্যাংকের পাওনা যে কয়েক লাখ বা কোটি হোক ও নিয়ে ভাববেন না। আপনি দেশ স্বাধীন করেছেন। না হলে আমাদের বিপুল বিত্ত হতো না। ওটা আমি দেব।' টাকা তো তিনি দেবেন, কিন্তু একটা সমাধান না হলে কোনো ব্যবসা-বাণিজ্য করা যায় না, ব্যাংক লোন পাওয়া যায় না। আমরা ততদিনে অগ্রণী ব্যাংকে একটা হিসাব খুলেছিলাম। টাকা জমা দিই, সেই টাকা উঠাই। হঠাৎই একসময় চরফ্যাশনের অধ্যাপক নজরুল মারা যায়। সেখানে উপনির্বাচনে প্রার্থী হয় মাছ ব্যবসায়ী জাফর উল্যাহ।

বিএনপি তখন ক্ষমতায়। তাদের ক্যান্ডিডেট শহীদ মালতা। জননেত্রী একদিন বললেন, 'বজ, চল যাই চরফ্যাশনে নির্বাচনী প্রচার করে আসি।' তোফায়েল আহমেদ ও আরও কাকে কাকে নিয়ে নেত্রী গিয়েছিলেন। জনাব অধ্যাপক নজরুলের ছেলে জ্যাকব এখন মন্ত্রী। ওদের বাড়িতেও খাবার খেয়েছিলাম। লালমোহন থেকে শুরু করে বোরহানউদ্দিন, চরফ্যাশন, মনপুরা কোনো জায়গা ছিল না, যেখানে ঘোরাফেরা করিনি। চার-পাঁচ দিন থেকে জননেত্রী ফিরে এসেছিলেন। আমি ছিলাম ১৪-১৫ দিন। মানুষ অভাবনীয় সম্মান করত। বিএনপির লোকেরাও করত, দলকানা আওয়ামী লীগ ছাড়া এখনো করে। হঠাৎই একদিন দুপুরে ফোন পেলাম, সোনার বাংলা একটা টেন্ডার দেবে। ৪৮ হাজার টাকার জামানত দরকার। জামানতের টাকা কোথায় পাওয়া যায়। কে একজন হৃদয়বান জামানতের ৫০ হাজার টাকা দেয়। চরফ্যাশনের সেই নির্বাচনে আমরা জিতেছিলাম।

সেকান্দার হাওলদারের 'সাগর' লঞ্চে ফেরার পথে শুনলাম ৬০ লাখ টাকার একটা কাজ সোনার বাংলা পেয়েছে। সেই শুরু অগ্রণী ব্যাংকের সঙ্গে আমাদের আদান-প্রদান। হঠাৎ একদিন অগ্রণী ব্যাংকের এমডি মোস্তফা আমিনুর রশিদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম ২৫ লাখ টাকা ঋণ চাইতে। অনেক ঘোরাফেরা করে সবকিছু যখন ঠিক তখন দেখা গেল কোম্পানির নামে উত্তরা ব্যাংকে ঋণ থাকায় মঞ্জুর করতে পারছেন না। আবার গেলাম আনিসুজ্জামানের কাছে। মানুষ কত সজ্জন হতে পারে আনিসুজ্জামানকে না দেখলে বোঝার উপায় নেই।

তিনি একজন জিএমসহ এমডিকে ডাকলেন। আমাদের খাতাপত্র নিয়ে তার টেবিলে এক ঘণ্টা কাজ করলেন। স্থির হলো ব্যাংকের পাওনা ১৮ লাখ ৫০ হাজার। সঙ্গে সঙ্গে চিঠি করে দিলেন উত্তরা ব্যাংকের পাওনা ১৮ লাখ ৫০ হাজার। অন্য কোনো ব্যাংক আর্থিক সুবিধা দিলে কোনো আপত্তি নেই। অগ্রণী ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া হলো ২০ লাখ। চলল বছরখানেক। এর মাঝে দু-তিন দিন উত্তরা ব্যাংকে আনিসুজ্জামানের কাছে গেছি। একদিন তিনি বললেন, 'ভাই, আপনার ফাইল পড়েছি। ব্যাংকে আপনাদের ৮ লাখ টাকা ফিঙ্ড ছিল। ঋণ ছিল ১০ লাখ ৫০ হাজার। সে হিসেবে ব্যাংকের পাওনা থাকার কথা আড়াই লাখ।

আপনি এটা নিষ্পত্তি চেয়ে চিঠি দেন। দিলাম চিঠি। বোর্ড রুমে লম্বা টেবিলে বসলাম পাঁচ-ছয় বার। আনিস ভাই পয়েন্টগুলো বের করে দিলেন। বাবা ছিলেন মোক্তার। কোর্টে কত কিছু দেখেছি, শুনেছি। আমাদের মাখন মামার বাবাও ছিলেন মোক্তার। মাখন মামা কেবলই মোক্তার হয়েছেন। কোর্টে কী এক মামলায় বাপ-বেটা দুই পক্ষ হাকিমকে বোঝাচ্ছেন। বাপ অভিজ্ঞ মানুষ, ছেলে পেরে উঠছিলেন না।

হঠাৎই একসময় রেগেমেগে মাখন মামা বললেন, আপনি কিসব বলছেন? আপনি আইনের কী জানেন? আপনি একজন গ্রামের সাধারণ মানুষের ছেলে মোক্তার। আর আমি মোক্তারের ছেলে মোক্তার। বাপের কোলে বসে যা শিখেছি তার কানাকড়িও আপনি সারা জীবনে শিখতে পারবেন না। আমার সঙ্গে আপনি আইনের তর্ক করেন? এটা আপনার শোভা পায়?' সারা কোর্ট হাসিতে ফেটে পড়েছিল। ম্যাজিস্ট্রেট সত্যিই বাপকে নয়, ছেলেকে সেদিন জিতিয়ে দিয়েছিলেন।

সে রকমই আমিও কিছু শিখবার চেষ্টা করেছিলাম। উত্তরা ব্যাংকের বোর্ড একসময় সিদ্ধান্তে আসে আমাদের কাছে তারা ১০ লাখ ৫০ হাজার পাবে এবং তা এক বছরে চার কিস্তিতে শোধ করতে হবে। বোর্ডের সিদ্ধান্ত শোনার পর জহুরুল ইসলামের চাচাতো ভাই পাকুন্দার জামান এক সপ্তাহের মধ্যে দুই কিস্তির টাকা দিয়ে দিয়েছিলেন। এরপর সময়মতো বাকি টাকাও শোধ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু নিহত হলে তার প্রতিবাদে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে কোনো কিছু না পেয়ে উত্তরা ব্যাংকের টাকা নিয়ে আমার নামে যে মামলা করেছিল সে সময় ব্যাংকের চিঠি পেয়েছিলাম, ব্যাংকের সঙ্গে আমাদের কোনো পাওনা-দাওনা নেই। সব চুকেবুকে গেছে।

'৯৪ সালে ২০ লাখ টাকা নিয়ে অগ্রণী ব্যাংকের সঙ্গে আদান-প্রদান শুরু হয়েছিল। আস্তে আস্তে সেই মঞ্জুরি ঋণ ২০০৭ সাল পর্যন্ত ৪ কোটি ৫০ লাখে উন্নীত হয়। ব্যাংক শুধু কাগজে অনুমোদনই দিয়েছে, তেমন টাকা-পয়সা দেয়নি। ইন্টারেস্ট মূলধনের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে ঋণ মঞ্জুর দেখিয়েছে। হিসাব করে দেখা গেছে আমরা ব্যাংককে সুদ এবং বিভিন্ন চার্জ দিয়েছি ২ কোটি ৪৭ লাখের ওপরে। তারপর এ পর্যন্ত যা শোধ করেছি আমাদেরটাও যদি আসল ধরা হয় তাহলে আমরাই বরং ব্যাংকের কাছে ৩, সাড়ে ৩ কোটি টাকা পেতে পারি। আগে দেখিনি, বুঝিনি।

একসময় ব্যাংককে চিঠি দিয়েছিলাম, সব সময় এত মুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযোদ্ধা করেন, এত সম্মান দেখান, ব্যাংকের আসল আর আমরা যা দিয়েছি তা আসল ধরে হিসাব করে যা পান নিয়ে নিন। আর আমরা পেলে ফিরিয়ে দিন। ব্যাংককে সব সময়ই আমার আন্তরিক মনে হয়েছে। তারা তেমন একটা হিসাব করেও ছিল। তাদের হিসাবেই পাওনা খুব বেশি নয়। ওসব কথা বলতে গেলে এক মহাভারত হয়ে যাবে। যদিও আমি যখন থাকব না, তখন ইচ্ছা করলে পাঠক এর সবকিছু জানতে পারবেন। ভারতে থাকতে মহাত্দা গান্ধীর জীবনী পড়ে উপলব্ধিটা আমার বদ্ধমূল হয়েছে, আমাদের মতো মানুষের সবকিছু জনসাধারণের জানা থাকা উচিত।

গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে আমাদের দল অংশ নেয়নি। নির্বাচনের আগে অনেকবার মন্ত্রীর মর্যাদায় উপদেষ্টা বানিয়ে যে ক'সিট প্রয়োজন তার প্রস্তাব এসেছিল। মন সায় দেয়নি, তাই অংশ নিইনি। নির্বাচনের ১৫ দিনের মধ্যে ২০ জানুয়ারি শওকত মোমেন শাজাহান মারা যান। সিটটা খালি হয়। চারদিক থেকে অনুরোধ আসে উপনির্বাচনে অংশ নিতে। এক পর্যায়ে রাজিও হই। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার আগে আমার মোটেও জানা ছিল না, ব্যাংক নিয়ে এত জালিয়াতি করা যায়। কয়েক লাখ টাকা জমা দিয়ে আবেদন করেছিলাম।

ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও জনাব আবদুল হামিদ চিঠি দিয়েছিলেন, 'আবেদনটি বোর্ড মিটিংয়ে আলোচিত হয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে আবেদনের দিন থেকে সংস্থাটি আমাদের ব্যাংকের নিয়মিত গ্রাহক হিসেবে বিবেচিত হবে।' তার পরও আমার মনোনয়ন বাতিল করা হয়েছিল। ইলেকশন কমিশনে গিয়েছিলাম, প্রতিকার পাওয়া যায়নি। হাইকোর্টে প্রতিকার মেলেনি। তখনকার ডেপুটি অ্যাটর্নি আমি আওয়ামী লীগে থাকতে সামনে বসতেন না, তার মুখ থেকে কত ধরনের কথা শুনেছিলাম। কিন্তু আমার সেই মামলার পর ছয় মাসও যায়নি তার পদ চলে গেছে। অন্যায় করলে এমনই হয়।

ব্যাংকিং আইনের যা যা নিয়ম-কানুন, পদ্ধতি সবকিছু প্রতিপালন করে অগ্রণী ব্যাংকের সর্বোচ্চ পরিষদ সোনার বাংলা প্রকৌশলিক সংস্থা (প্রা.) লি.-এর ঋণ ১০ বছরের জন্য পুনঃ তফসিল করে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিয়ে সোনার বাংলাকে চিঠি দিয়েছে। তার পরও কদিন থেকে শুনছি তফসিলের সিদ্ধান্ত ব্যাংক নাকি বাতিল করবে। তা ভালো কথা! সব যদি মর্জিমাফিক চলে অগ্রণী ব্যাংক পিছে পড়ে থাকবে কেন? কিন্তু আইন-কানুন, নিয়ম-পদ্ধতি তো অনুসরণ করতে হবে, আইন-আদালতের দিকেও তো চোখ রাখতে হবে। সেদিন একজন বিখ্যাত লোক আমায় ফোন করে ধন্যবাদ দিলেন। বললেন, কালিহাতী ভোট চুরিতে নাম জড়িয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যাতে তার সম্মান ক্ষুণ্ন না করেন আমার এ আহ্বান তার নাকি খুবই ভালো লেগেছে।

সমস্যা হলো চোরেরা চুরি করে মাননীয় নেত্রীর নাম দেয়। তাই ভালো লাগে না। মাসাধিকাল কালিহাতীর সর্বত্র ঘুরছি, সব জায়গায় এক কথা, 'ভোট তো দেব, চুরি করে নিয়ে যাবে না তো?' আবার আজ চার-পাঁচ দিন থেকে বাতাস ভোটে দাঁড়াতে দেবে না, মনোনয়নপত্র বাতিল করবে। যে দেশের স্বাধীনতার জন্য রক্ত দিয়েছি সে দেশে ভোটে দাঁড়ালে যদি কারও অসুবিধা হয় দাঁড়াব না। আমার চাওয়া তো শুধু মানুষ যাতে ভোট দিতে পারে। ভোট ছাড়া নির্বাচন যাতে না হয়। আওয়ামী লীগ এবং আমার বোনের সেটা দেখবার এ এক উত্তম সুযোগ। তারা যদি তা দেখাতে ব্যর্থ হন আমার কী করার আছে?

সেদিন কে যেন বলল ড. রাজ্জাকের জন্য অগ্রণী ব্যাংকের পুনঃ তফসিল বাতিল নিয়ে কথা উঠেছে। উঠতেই পারে। কিন্তু ড. রাজ্জাক আমার সাথী মুক্তিযোদ্ধা। তাকে যা জানি সে অমন করার মতো মানুষ নয়। আমার প্রিয় বোন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যদি চান একজন মুক্তিযোদ্ধার নির্বাচনে ব্যাঘাত সৃষ্টি করবেন তাহলে এক আল্লাহ ছাড়া আর কে ফেরাবে? কিন্তু ছোট বোন রেহানা যা বলেন তাতে বড় বোন শেখ হাসিনা কোনো অন্যায় করবেন তা ভাবতেও পারি না।

তিনি আমাকে যতটা ভালোবাসেন তাতে অমন নিচু কাজ তিনি কখনো করবেন না। কোনো ষড়যন্ত্রকারী তার নাম ভাঙালে সেটা ভিন্ন কথা। আর তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন, কারও প্রতি অনুরাগ বিরাগের বশবর্তী হয়ে কিছু করবেন না। তাহলে আমার প্রতি বিরাগ হবেন কেন? বাংলাদেশে কতজনের হাজার হাজার কোটি টাকা পুনঃ তফসিল হচ্ছে। কারও কারও তো ৫, ১০ হাজার কোটি ২৫-৩০ বছরের জন্য পুনঃ তফসিল করা হয়েছে। তাহলে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে গঠিত একটি নির্মাণ প্রতিষ্ঠান নিয়ে এত টানাহেঁচড়া কেন? ব্যাংক সোনার বাংলাকে লিখিত দিয়েছে-

'প্রিয় মহোদয়,

উপর্যুক্ত বিষয়ে আপনার গত ১২/০৮/২০১৫ ইং তারিখের আবেদনের প্রেক্ষিতে গত ২৬/০৮/২০১৫ তারিখে অনুষ্ঠিত ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদের ৪২৭তম সভায় উপস্থাপন করা হলে পরিষদ নিম্নোক্ত সিদ্ধান্ত প্রদান করেন :

... ... ... ...

উল্লেখ্য, ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক মওকুফ অবশিষ্ট দায় পরিশোধের জন্য ১০ বছর সময় প্রদানে অনাপত্তি প্রদান করা হয়েছে, ফলে আপনাদের প্রতিষ্ঠানের নামীয় বর্ণিত ঋণ হিসাব পরিচালনা পরিষদের সিদ্ধান্তের সময় অর্থাৎ ২৬/০৮/২০১৫ ইং তারিখ হতেই অশ্রেণিকৃত বলে বিবেচিত হবে।

এমতাবস্থায়, পরিচালনা পরিষদের সিদ্ধান্ত আপনাকে সদয় অবহিত করা হলো।'

এ রকম একটি চিঠির পরও কোনো অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠান নয়ছয় করতে পারে এটা ভাবা যায়? আমার মনোনয়নপত্র বাতিলের জন্য ব্যাংক নাকি এমনতর নয়ছয়ই করবে। তা তারা করে করুক। দেখি মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের সময় কে কী করেন। দেশ আছে, মানুষ আছে, আছে ভবিষ্যৎ। শুধু আজকেরটাই সত্য নয়। গায়ের জোরে রাজ্য জয় ক্ষণস্থায়ী, সত্য চিরস্থায়ী। চারদিকে ঘোর অন্ধকার দেখে আজ আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে বড় ইচ্ছা করে, হে দয়াময় প্রভু, তুমি আমায় দয়া কর।

যেমনি দয়া করেছিলে ইউনুস নবী (আ.)-কে। যেমনি আগুন থেকে বাঁচিয়েছিলে ইবরাহিম (আ.)-কে। দয়া কর প্রভু। যেমনি '৭১-এ দয়া করে হানাদারদের বিরুদ্ধে আমায় বিজয় দিয়েছিলে, বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ-প্রতিরোধে কপর্দকহীন এক কাপড়ে ঘর ছেড়েছিলাম। তুমিই আমায় বাঁচিয়ে রেখেছিলে। আজ আমার মা নেই, বাবা নেই। চোখে অন্ধকার দেখতাম, ঝলমলে আকাশ মনে হতো অন্ধকার। তখন তুমি আমার হৃদয়ের গুমোটবাঁধা অন্ধকার দূরীভূত করে কুশিমণিকে বুকে তুলে দিয়েছিলে।

আজ সে আমার জীবনে অমানিশার অন্ধকারে চাঁদের স্নিগ্ধ আলো। আমার বুকের ধন কলিজার টুকরা কুশিমণিকে লালন-পালন করত আয়েশা। তার গলায় ক্যান্সার হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে অপারেশন শেষে কেমো দিতে ঢাকা মেডিকেলে গিয়েছিলাম, বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বলেছিলেন কেমো না দিলে ৪০ দিন, দিলে হয়তো ২০ দিন বাঁচবে। অধ্যাপকের কথা শুনে আমার সব অন্তরাত্দা নাড়া দিয়ে উঠেছিল। চোখের পানিতে বুক ভেসে গিয়েছিল। হে প্রভু!

তোমার কাছে প্রার্থনা করেছিলাম সব জগতের সব প্রাণিকুলকে তুলে নিলে তোমার কোনো লাভ নেই, আর সবাইকে ছেড়ে দিলেও তোমার কোনো ক্ষতি নেই। তুমি দয়া করে আমার কথা শুনেছিলে। আয়েশাকে ৪০ দিনের জায়গায় চার বছরের হায়াত দিয়েছিলে। তাই প্রভু তুমি আমায় দয়া কর। এ দুনিয়ায় ফকির-মিসকিন এক বাড়িতে ভিক্ষা না পেলে আরেক বাড়িতে যায়। সে দ্বারে দ্বারে ঘুরে তার আহার জোটায়। আমি মুসলমান। তুমি বিনে আমার আর কোনো দরজা নেই। তোমার কাছে বঞ্চিত হলে আমি কোথায় গিয়ে দাঁড়াব। চারদিকে ষড়যন্ত্রের বেড়াজালে আষ্টেপৃষ্ঠে আবদ্ধ হয়ে কিছু দেখতে না পেয়ে তোমায় স্মরণ করছি প্রভু। তুমি আমায় পথ দেখাও, যে পথ তোমার পছন্দের সেই পথ।-বিডিপ্রতিদিন

লেখক : রাজনীতিক
১৩ অক্টোবর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এস.এ.সুমন/একে

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে