কাজী সিরাজ : সন্দেহ নেই যে, জনসমর্থনের দিক থেকে বিএনপি দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল। এখন খুবই খারাপ সময় অতিক্রম করছে দলটি। জেল-জুলুম, মামলা-মোকদ্দমায় একেবারে জর্জরিত। দলের লোকেরা যাতে মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে সে জন্য শোভন-অশোভন সব কর্মকৌশলই লীগ সরকার প্রয়োগ করছে। এ ব্যাপারে সরকারের কৃতিত্ব হচ্ছে, রাষ্ট্রশক্তিকে তারা তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবহার করতে পারছে। সরকার এখন পর্যন্ত ষোলআনাই সফল বলা চলে।
সত্যিই দলটি মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছে না। সরকারি দল, তাদের পরগাছা জাসদ (ইনু) এবং তাদের চিহ্নিত দলদাসরা টিটকিরি মেরে বলছে, আহ, দেশে কোনো বিরোধী দলই থাকল না। বিএনপি কি কি করলে প্রাণে বাঁচবে তেমন বুদ্ধি-পরামর্শও 'খয়রাত' দিচ্ছেন তারা। এরা ভুলে যান যে, ছেষট্টি সালে ছয় দফা কর্মসূচি ঘোষণার পর আওয়ামী লীগের ওপরও এক ধরনের 'ক্র্যাকডাউন' নেমে এসেছিল। শেখ হাসিনার লীগ সরকার বিএনপির ওপর যেভাবে 'চড়াও' হয়েছে, পঞ্চাশ বছর আগে আইউব খানের লীগ সরকারও একইভাবে 'চড়াও' হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এএইচএম কামরুজ্জামান, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, মিজানুর রহমান চৌধুরীসহ দলের সব নেতাকেই ডিফেন্স অব পাকিস্তান রুলস ডিপিআর নামক আইনের অপপ্রয়োগ করে কারারুদ্ধ করা হয়। একমাত্র আমেনা বেগম আওয়ামী লীগ অফিসে বাতি জ্বালিয়ে রেখেছিলেন। সেই সময়টি ছিল আওয়ামী লীগের দুঃসময়। তখনো মুসলিম লীগের পাণ্ডারা বলত, 'আওয়ামী লীগ শেষ। বাতি জ্বালিয়েও আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।' কিন্তু বেশি দিন লাগল না, আওয়ামী লীগ আবার জনগণের শক্তিতে বলীয়ান হয়ে জেগে উঠল এবং চিরতরে হারিয়ে গেল মুসলিম লীগ।
আওয়ামী লীগের যারা 'বিএনপি শেষ, আহ্, দেশে একটা বিরোধী দল নেই বলে কৌতুক করছেন, অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছেন, তাদের অতীতের দিকে ফিরে তাকাতে বলি। সর্বগ্রাসী সরকারি হানার মুখে 'বঙ্গশার্দুল'খ্যাত যে শেখ মুজিবও কাবু হয়ে পড়েছিলেন, দু-তিন বছরের ব্যবধানে দ্রোহী জনতার ভালোবাসার ফুলমালা পরে তিনিই হয়ে গেলেন বঙ্গবন্ধু। পঞ্চাশ নিম্নবয়সী আওয়ামী লীগারদের দেশি-বিদেশি এমন সব রাজনৈতিক উত্থান-পতনের কাহিনী জানা থাকলে বিএনপি নিয়ে তাদের হাসি-তামাশা থেমে যেত।
বিএনপিরও শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত আওয়ামী লীগের কাছ থেকে। দুঃসময়েও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে কীভাবে জেগে উঠতে হয়, কীভাবে জাগাতে হয় মানুষকে, অতীতের আওয়ামী লীগ নিশ্চয়ই এর উদাহরণ। বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী আমলে আওয়ামী লীগ ছিল সম্পূর্ণই কেরিয়ার রাজনীতিবিদ-নির্ভর একটি রাজনৈতিক দল। ছাত্রলীগ ছিল মূল দলের লাইফব্লাড- যদিও ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগের অঙ্গদল ছিল না।
আওয়ামী লীগে, ছাত্রলীগে তখন যারা নেতা ছিলেন, নেতা হয়েছেন, দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক-সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড ও ধারাবাহিক একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই তারা পাদপ্রদীপের আলোয় এসেছেন, তারা নেতা হয়েছেন, এখনকার মতো কেউ তাদের নেতা বানিয়ে দেননি। অঙ্গদল না হলেও আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের মধ্যকার সম্পর্ক সবারই জানা। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ছাত্রলীগের প্রেসিডেন্ট-সেক্রেটারি কে হবে বলে দিয়েছেন এমন কোনো রেকর্ড নেই। সেই ধারা এখন অবশ্য আর চালু নেই।
সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ, ভিন্ন আলোচনা। তবে একটা কথা প্রাসঙ্গিকভাবে বলা যায় যে, রাজনীতির মাঠ থেকে নানা চড়াই-উতরাইয়ের মাধ্যমে উঠে আসা পোড় খাওয়া রাজনৈতিক কর্মী-সংগঠক নেতারা রাজনীতিতে, গণতান্ত্রিক সংগ্রামে যে সাহসী ও বিচক্ষণ ভূমিকা পালন করতে পারেন, সুপারইম্পোজড চাকর-বাকর মার্কা 'হাইব্রিড'রা সে ভূমিকা পালন করতে পারেন না।
বিএনপির লোকজনকে তাদের বার বার ব্যর্থতা, কারও কারও নিষ্ক্রিয়তা প্রসঙ্গে প্রশ্ন করলেই জবাব আসে, কী করব ভাই, কথা বললে, মাঠে নামলেই লাঠি, গুলি, টিয়ারগ্যাস, মামলা-মোকদ্দমা, জেল, রিমান্ড। তাদের এ ধরনের কথাবার্তা শুনলে তো মনে হয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরক্ত হয়ে ক্ষমতা ছেড়ে না দিলে তারা আর কিছু করতে পারবেন না। এই জায়গাতেই বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ থেকে শিক্ষা নেওয়ার কথা আসে। স্বৈরাচার এরশাদ আমলে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে আন্দোলন-সংগ্রামের কথাও স্মরণ করতে পারে বিএনপির তরুণ তুর্কিরা। অবশ্য এরশাদের স্বৈরাচারী শাসন বর্তমান 'গণতান্ত্রিক' শাসনের কাছে লজ্জা পাচ্ছে।
বিএনপি সংসদে নেই বলে প্রকৃত বিরোধী দল হিসেবে কার্যকর কোনো ভূমিকা পালন করতে পারছে না। এটাই একমাত্র বিষয় নয়। বিএনপির কাছ থেকে দেশ ও জনগণের প্রত্যাশা অনেক। দলটি গঠনের পেছনে যে ঐতিহাসিক কার্যকারণ ছিল তা ছিল তখন দেশ ও জনগণের চাহিদা ও আকাঙ্ক্ষাপ্রসূত। সময়টা আমাদের একটু খেয়াল করতে হবে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড এবং একদলীয় বাকশালী শাসনের অবসানের পর থেকে ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বিএনপি গঠনের আগ পর্যন্ত ওই ক'বছর দেশে প্রকাশ্য কোনো রাজনৈতিক দল ছিল না। সংবিধানে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে পঁচাত্তরের ২৫ জানুয়ারি সব রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করে একটি মাত্র জাতীয় দল বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ-বাকশাল গঠনের সিদ্ধান্ত হয়।
জিয়াউর রহমানের আমলে পঞ্চম সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে দেশের একদলীয় বাকশালী প্রথা বাতিল করে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। এই সাংবিধানিক সিদ্ধান্তেই বাকশালের গর্ত থেকে আবার আওয়ামী লীগের পুনর্জন্ম হয় এবং কমিউনিস্ট পার্টি, জামায়াতে ইসলামী, ন্যাপসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল আবার বৈধ রাজনৈতিক দল হিসেবে কর্মকাণ্ড পরিচালনার অধিকারপ্রাপ্ত হয়। বিএনপিরও জন্ম হয় সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী-পরবর্তী গণতন্ত্রের উত্তরণকালে।
চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বাকশাল প্রতিষ্ঠার আগেও দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ সুখকর ছিল না। মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাপ ছিল প্রচণ্ড চাপের মুখে। বাম-প্রগতিশীলরা চরম নিগ্রহ ভোগ করে। বাহাত্তর সালে আওয়ামী লীগের ভ্রূণ থেকেই সাহসী তরুণদের নিয়ে গঠিত হয় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ। দুনিয়া তখন ইন্দো-মার্কিন এবং রুশ-ভারত অক্ষশক্তিতে বিভক্ত। বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনরা ছিল রুশ-ভারত দলভুক্ত। বাংলাদেশে রুশপন্থি কমিউনিস্ট পার্টি (সে দলের অনেক প্রভাবশালী নেতা এখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগেরও প্রভাবশালী নেতা ও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী), মুজাফফর ন্যাপ বাকশাল গঠনের আগে থেকেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে একাট্টা ছিল। তারা তিন দল মিলে প্রথম গড়েছিল ত্রিদলীয় ঐক্যজোট এবং পরে গণঐক্যজোট।
সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী এবং বিএনপি গঠনের পর সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদবিরোধী দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী শক্তি ও জনগণের সামনে রাজনীতি করার নতুন দুয়ার অবারিত হয় এবং আবার বহুদলীয় গণতন্ত্রের চর্চা ও অনুশীলনের সুযোগ ঘটে। বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও জনগণের জন্য দুটি বিষয়ই ছিল জরুরি। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ঐন্দ্রজালিক নেতৃত্বে বিএনপি দেশ ও জাতির (সামগ্রিক অর্থে) সে চাহিদা পূরণ করেছে। সে চাহিদা ও গণআকাঙ্ক্ষা এখনো বর্তমান। কিন্তু বিএনপি কি দেশ জাতির সে চাহিদা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারছে? এক অক্ষরে জবাব- না।
কেন পারছে না বিএনপি? স্পষ্ট করে বলতে গেলে বলতে হবে আদর্শচ্যুতির কথা। প্রেসিডেন্ট জিয়ার চিন্তা, বিশ্বাস ও দর্শনের সুস্পষ্ট প্রকাশ আছে বিএনপির ঘোষণাপত্রের শুরুতেই। ঘোষণাপত্রের শুরুটা এখনো ঠিক এভাবেই আছে- 'ঐতিহাসিক মুক্তি সংগ্রামের সোনালি ফসল বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব আমাদের পবিত্র আমানত এবং অলঙ্ঘনীয় অধিকার। প্রাণের চেয়ে প্রিয় মাতৃভূমির এই স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে সুদৃঢ় ও সুরক্ষিত করে রাখাই হচ্ছে আমাদের কালের প্রথম ও প্রধান দাবি। বিবর্তনশীল ইতিহাস এবং সাম্প্রতিক জীবনলব্ধ অভিজ্ঞতা আমাদের এই শিক্ষাই দেয় যে, ঐক্যবদ্ধ ও সুসংহত গণপ্রচেষ্টা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের কালজয়ী রক্ষাকবচ।
স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের অতন্দ্রপ্রহরী হচ্ছে যথাক্রমে :
(১) বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে অনুপ্রাণিত ও সংহত ইস্পাতকঠিন গণঐক্য।
(২) জনগণভিত্তিক গণতন্ত্র ও রাজনীতি।
(৩) ঐক্যবদ্ধ ও সুসংগঠিত জনগণের অক্লান্ত প্রয়াসের ফলে লব্ধ জাতীয় অর্থনৈতিক মুক্তি, আত্দনির্ভরশীলতা ও প্রগতি।' জিয়া তার জীবদ্দশায় দলের কর্মধারা পরিচালনা করেছিলেন এই ঘোষণা অনুযায়ী। তিনি ১৯ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন দল গঠনের আগে। লক্ষ্যে অবিচল জিয়া পরে ১৯ দফাকে তার দলের কর্মসূচি হিসেবেও গ্রহণ করেন। বিএনপির ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত এখন ক'জন নেতা আছেন যারা জিজ্ঞাসা করলে এসব সম্পর্কে বলতে পারবেন? দল কি স্থির আছে জিয়ার নির্দেশিত লক্ষ্যে ও পথে? নেই। নেই বলেই পদে পদে বিপদে পড়ছে বিএনপি।
জিয়াউর রহমান দল এবং সরকারকে আলাদা করে রেখেছিলেন। দলে খুব প্রয়োজন না হলে যারা সরকারে ছিলেন তাদের দলের নেতৃত্বে রাখেননি। সব এমপি থানা কমিটি দখল করে রাখেননি। ঢাকায় বসে বরিশালের কমিটি করার সুযোগ ছিল না। কমিটি বেচা-কেনার চিন্তাও করা যায়নি। ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচন হয় তারই আমলে। ক'জন প্রার্থীর কাছে মনোনয়ন বিক্রি করা হয়েছিল? বেগম খালেদা জিয়া তো দূরের কথা, তার পরিবারের ঘনিষ্ঠ এমনকি দূরাত্দীয় কাউকে কি তিনি দলে বা সরকারে ঠাঁই দিয়েছিলেন? কিন্তু এখন? কোনো একটা ব্যাপারেই জিয়ার বিএনপির সঙ্গে বর্তমান বিএনপিকে মেলানো যায় না। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা দ্ব্যর্থহীন ভাষায়ই বলেন, বিএনপি এখন আদর্শচ্যুত, লক্ষ্যচ্যুত একটি রাজনৈতিক দল।
দলটি গঠনে এবং গড়ে ওঠার পেছনে যে শর্তগুলো কাজ করেছে, সে শর্তগুলো এখনো বিদ্যমান থাকায় জনগণের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ একটি অংশ এখনো এ দলকে সমর্থন করে। জিয়া জনগণের সমর্থনকে কাজে লাগিয়েছেন দলের কাজে, চূড়ান্তভাবে দেশের কাজে। তার রাজনৈতিক বিরোধিতা করেন প্রতিপক্ষ, কিন্তু তার ব্যক্তিগত সততা, কর্তব্যনিষ্ঠা এবং দেশপ্রেম নিয়ে শত্রুরাও প্রশ্ন তোলে না। অথচ বর্তমান বিএনপি নেতৃত্ব নিয়ে এমন কোনো নেতিবাচক বিষয় নেই যা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে না, সমালোচনা হয় না। এটা বহুল আলোচিত যে, বিএনপি নামক রাজনৈতিক দলটি এখন রাজনীতিবিদদের নিয়ন্ত্রণে নেই।
দলে স্থায়ী কমিটি, ভাইস চেয়ারম্যানবৃন্দ, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টামণ্ডলী (ভাইস চেয়ারম্যান পদমর্যাদাসম্পন্ন) সম্পাদকমণ্ডলী, নির্বাহী কমিটিসহ বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন আছে অনেক। কিন্তু সবই ঠুঁটো জগন্নাথ। দল নিয়ন্ত্রণ করেন বেগম খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানের নিযুক্ত 'রাজকর্মচারীরা'। এরা দলের সিনিয়র নেতাদের চেয়েও শক্তিশালী। সপ্তাহখানেক আগে দৈনিক প্রথম আলো খবর ছেপেছে যে, বিএনপির অনেক সিদ্ধান্ত নেয় গুলশান অফিসের কর্মচারীরা। বিএনপির এই বাস্তবতার কথা রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলে আসছেন অনেক দিন ধরেই। কোনো পরিবর্তন নেই। সরকারি নির্যাতন-নিপীড়নের অভিযোগ সর্বাংশে সত্য বলে ধরে নিলেও বিএনপির মতো একটি বিপুল গণসমর্থিত দল বেঁচে আছে না মরে গেছে তা বোঝা যাবে না কেন?
আসলে বিএনপি এখন কি করবে, কি করা উচিত, কীভাবে করা উচিত, তাই বোধহয় ঠিক করতে পারছে না। এসব ঠিক করার জন্য উপযুক্ত রাজনৈতিক নেতৃত্ব লাগে, রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনা-পরামর্শ করা লাগে। কিন্তু এসবের কোনো বালাই নেই এই দলে। কারও কোনো মূল্যই তো নেই পছন্দের ফুট-ফরমাশ খাটা কর্মচারীরা ছাড়া। শোনা যায়, গুরুত্বপূর্ণ অনেক সিদ্ধান্ত গুলশান অফিসের পিওনরাও জানে স্থায়ী কমিটির সদস্য ও বড় বড় পদধারী ব্যক্তিদের আগে। এভাবে চলতে এবং চালাতে গিয়েই দলের 'বারটা' বাজার দশা।
বিএনপি এখন আগাম একটা সংসদ নির্বাচন চায়। এ চাওয়ার পেছনে ন্যায্যতা মানেন দেশ-বিদেশের অনেকে। কিন্তু চাইলেই তা পাওয়া যাবে, না কি জাতিসংঘ বা বিদেশ বন্ধুরা সে ব্যবস্থা করে দেবে? পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, এ জন্য বিএনপির ক্ষমতার প্রমাণটাও জরুরি। কিছুদিন আগে বিএনপি চেয়ারপারসন গণদাবির ভিত্তিতে গণসংশ্লিষ্ট কর্মসূচি দেওয়ার কথা বলেছিলেন। আরেকটি কথা বলেছিলেন যে, কোথাও দলের পকেট কমিটি করা যাবে না।
দুটি বক্তব্যের বিশ্লেষণ করলে তো তাই দাঁড়ায় যে:-
(১) ইতিপূর্বে গৃহীত কর্মসূচিসমূহ গণদাবিভিত্তিক গণসংশ্লিষ্ট কর্মসূচি ছিল না। এ বছরের জানুয়ারি-মার্চ তিন মাসের হিংসাশ্রয়ী আন্দোলনের প্রতিই তিনি হয়তো ইঙ্গিত করে থাকবেন। তার এই উপলব্ধি যথার্থ।
(২) বিএনপি এতদিন যে পকেট কমিটি হয়েছে, পদ-পদবি বেচা-কেনা হয়েছে তাও স্পষ্ট হয়েছে পকেট কমিটি করার বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি থেকে। তার আন্দোলনের ডাক বার বার ব্যর্থ হওয়ার কারণ যে অফিসের দারোয়ান, পিওন, আয়া-বুয়া দিয়ে কমিটি করা এবং সৎ ও ত্যাগী নেতা-কর্মীদের বঞ্চিত করা, তাও স্পষ্ট হয়েছে। আগাম বা মধ্যবর্তী নির্বাচনের লক্ষ্যে বিএনপির সামনে দুটো কাজ।
এক. দ্রুত নির্বাচনের জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা।
দুই. নির্বাচনে কাঙ্ক্ষিত ফল লাভ করা। সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য সারা দেশে গণযোগাযোগ এবং জনগণকে সংশ্লিষ্ট করার মতো কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামতে হবে। এ জন্য সর্বাগ্রে গুলশান অফিস নিষ্ক্রিয় করে দিতে হবে।
এরপর অসৎ, দুর্নীতিবাজ, অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের নেতৃত্ব কাঠামো থেকে বাদ দিয়ে মাঠকর্মীদের মতামতের ভিত্তিতে তরুণ, সাহসী, লড়াকু নেতা-কর্মী-সংগঠকদের যথাযথ মূল্যায়ন করতে হবে। মামলা, হামলার কথা বলে যারা পালিয়ে থাকে, কখনো কখনো তলে তলে আক্ষেপ করে তাদের হিসাবের খাতা থেকে বাদ দিতে হবে। অহিংস গণমুখী কর্মসূচি নিয়ে বেগম জিয়াকেই আবার সভা-সমাবেশ, লংমার্চ-রোডমার্চ ইত্যাদি জনপ্রিয় কর্মসূচির কথা ভাবতে হবে।
শোনা যাচ্ছে সরকারও জাতীয়-আন্তর্জাতিক নানা বাস্তবতায় আগাম নির্বাচনের কথা ভাবছে। সে ক্ষেত্রে বিএনপি কি তার 'পুরনো চালান' নিয়ে বাজিমাৎ করার স্বপ্ন দেখছে? সে স্বপ্ন কিন্তু দুঃস্বপ্ন হবে। মনোনয়ন কেনা-বেচার সর্বনাশা পথ পরিহার করতে হবে। শোনা যায়, গুলশান অফিসের বড় বাবুরা ইতিমধ্যেই নাকি অনেককে ক্লিয়ারেন্স দিয়ে রেখেছেন। ওই সব ক্লিয়ারেন্স বাতিল না করলে এবার দলের প্রার্থী দলের লোকদের দ্বারাই বাধাগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। কিছুদিন ধরে বেগম খালেদা জিয়া লন্ডন যাচ্ছেন লন্ডন যাচ্ছেন শোনা যাচ্ছে। আবার বারবারই শিডিউল পেছানো হচ্ছে।
যদিও চোখের চিকিৎসার জন্য এবং পুত্র, পুত্রবধূ ও নাতনিকে অনেক দিন পর দেখার জন্য তিনি লন্ডন যাবেন বলে বলা হয়েছে, পর্যবেক্ষকরা মনে করেন মূল উদ্দেশ্য তা নয়। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দল পুনর্গঠন, আগামী নির্বাচনে দলের প্রার্থী বাছাই ইত্যাদি নিয়ে আলোচনাই সম্ভাব্য সফরের মুখ্য উদ্দেশ্য এবং সফরের ব্যাপারে বেগম খালেদা জিয়ার চেয়ে তারেক রহমানের আগ্রহই নাকি বেশি। দুটি কারণে বেগম জিয়া তার এই সফর বার বার পেছাচ্ছেন বলে পর্যবেক্ষকরা ধারণা করছেন।
(এক) সরকার বেগম জিয়াকে নির্বাচনের বাইরে রাখতে চাইতে পারে। লন্ডন গেলে কোনো একটি ছুতোয় সরকার তার দেশে ফেরার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে বলে হয়তো তিনি ধারণা করছেন। দেশে ফেরার বিষয় নিশ্চিত না হয়ে তিনি যেতে চাইছেন না।
(দুই) দলের ব্যাপারে লন্ডন থেকে তারেক রহমানের হস্তক্ষেপ দলের ক্ষতি করতে পারে বলে হয়তো ভাবছেন তিনি। তা ছাড়া দেশে তারেক রহমানের ভাবমূর্তির সংকট তৈরি হয়েছে। বেগম জিয়া তার সঙ্গে সলাপরামর্শ করে সব ঠিক করছেন এমন ধারণা মানুষের মধ্যে নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি করতে পারে। তারেক রহমানের পরামর্শ নিতে বেগম জিয়া লন্ডন যাচ্ছেন, তাতে দলের নেতা কে- বেগম জিয়া? না তারেক রহমান? জনমনে এমন প্রশ্ন বেগম জিয়ার জন্য একটা বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে, যা তিনি চান না; বার বার সফর পেছানোর এটাও একটা কারণ হতে পারে। আরও একটা বিষয় প্রচার আছে যে, লন্ডন থেকে বেগম খালেদা জিয়া ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন এবং ব্যক্তিগত ও দলীয় সম্পর্কোন্নয়নের উদ্যোগ নিতে চান। বিষয়টি নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তার লন্ডন সফর হয়তো আরও বিলম্বিত হবে।-বিডিপ্রতিদিন
লেখক : সাংবাদিক কলামিস্ট
১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এস.এ.সুমন/একে