নিউজ ডেস্ক : নিজ পরিবারের তিন অসুস্থ সদস্যকে হত্যার আবেদন জানিয়েছেন বাংলাদেশের এক দরিদ্র পিতা। এতে গভীর রক্ষণশীল বাংলাদেশি সমাজে অনারোগ্য ও যন্ত্রণাদায়ক রোগের ভুক্তভোগীকে তার ইচ্ছায় হত্যা করা নিয়ে এক বিরল বিতর্ক তৈরি হয়েছে। বার্তাসংস্থা এএফপির এক প্রতিবেদনে এমন মন্তব্য করা হয়েছে।
তোফাজ্জল হোসেন নামে ওই ব্যক্তি নিজের দুই সন্তান ও নাতির রোগ নিরাময়ের জন্য বছরের পর বছর ধরে লড়াই করে আসছেন। কিন্তু তিনি বলছেন, পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে চলে গেছে তিনি আর পারছেন না। তিনি বলেন, ‘আমি অনেক বছর তাদের দেখাশুনা করেছি। বাংলাদেশ ও ভারতের হাসপাতালে নিয়ে গেছি। চিকিৎসার জন্য আমি নিজের দোকান বিক্রি করে দিয়েছি। কিন্তু এখন আমি একেবারে নিঃস্ব।’ তার ভাষ্য, ‘সরকারের উচিত তাদের নিয়ে কী করা উচিৎ সিদ্ধান্ত নেয়া। তারা কষ্ট পাচ্ছে। সেরে ওঠার কোনো আশা নেই। আমি এটি আর নিতে পারছি না।’
মেহেরপুরের ফল বিক্রেতা তোফাজ্জল স্থানীয় জেলা প্রশাসনের কাছে চিঠি লিখেছেন। মাসকুলার ডিস্ট্রোফি রোগে ভুগতে থাকা তার প্রিয় দুই সন্তান ও নাতির চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করার আবেদন জানিয়েছেন তিনি। নয়তো ‘ওষুধ দিয়ে তাদের প্রাণ নেয়ার’ অনুমতি চেয়েছেন। প্রতিবেদনে বলা হয়, এশিয়ার অন্যতম দরিদ্রতম দেশের একটি বাংলাদেশ। কোনো ধরনের বিনামূল্যের স্বাস্থ্যসেবা নেই বাংলাদেশে। চিকিৎসা সেবা দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসরত লাখ লাখ মানুষের নাগালের বাইরে।
আনুমানিক ৬ লাখ বাংলাদেশি দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগছেন। কিন্তু পুরো দেশে ‘প্যালিয়াটিভ’ কেয়ার সেন্টার আছে মোটে একটি। ‘হসপাইস’ সেবা একদমই নেই। দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভোগা মানুষের জন্য বিশেষায়িত এসব সেবার অনুপস্থিতিতে তোফাজ্জলের দুই ছেলে ও নাতির জন্য বিকল্প তেমন কিছুই আর থাকে না। ডুচেনে মাসকুলার ডিস্ট্রোফি নামে বিরল এই জিনগত রোগে যারা ভুগেন তাদের পেশি ক্রমেই ক্ষয় হতে থাকে। রোগীরা ৩০ বছরের বেশি বাঁচেন খুব কম। তোফাজ্জলের দুই ছেলের বয়স যথাক্রমে ২৪ ও ১৩ বছর এবং নাতির বয়স মাত্র ৮ বছর। তিনি বলেন, তার ছেলেরা পরিস্থিতি সম্পর্কে জানে। কিন্তু তারা নিজেরা কিছুই করতে পারে না। নড়াচড়া করতে অসমর্থ ওই দুই ছেলের চলাফেরা নিজেদের বিছানাতেই সীমাবদ্ধ। তার নাতি এখনও ওয়াসরুম পর্যন্ত যেতে পারেন, কিন্তু তার পরিস্থিতি এখন ক্রমেই অবনতির দিকে।
জেলা প্রশাসনকে লেখা চিঠির ব্যাপারে তোয়াজ্জেম বলেন, আমি তাদেরকে বিষয়টি বলেছি। বলেছি তাদের মৃত্যু চেয়েছি। কিন্তু তারা বিষয়টা অত গুরুত্বের সঙ্গে নেয়নি। হয়তো পরিস্থিতির ভয়াবহতা সম্পর্কে তারা বুঝতে পারছে না। তার বড় ছেলে আবদুস সবুর বলেন, টেলিভিশন দেখে আর বাবার সঙ্গে কথা বলেই তার সময় কাটে। ‘আমি বাবাকে বলি অত চিন্তা না করতে।’ তাদের চিকিৎসা করেছেন মাহবুবুল আলম নামে একজন ডাক্তার। তিনি বলেছেন, তাদের রোগের কোনো চিকিৎসা নেই। আর তারা খুব যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে দিনতিপাত করে। তার মতে, এটি একটি মানবিক বিষয়। সবার উচিত সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসা।
তোফাজ্জলের ওই চিঠির কারণে পত্রপত্রিকায় শিরোনাম হয়েছে। এরপর একজন সরকারি কর্মকর্তা তার পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। তিনি বলেন, এই অনুরোধ ছিল এক অসহায় পিতার আবেদন। তিনি (তোফাজ্জল) তাদের জন্য স্বাস্থ্য সহায়তা চেয়েছেন, অথবা তাদেরকে হত্যার অনুমতি চেয়েছেন। কিন্তু কে হত্যার অনুমতি দেবে?
ওই কর্মকর্তা জানান, তাদের চিকিৎসার খরচ মেটাতে তোফাজ্জলকে সহায়তা করার উপায় খুঁজছে কর্তৃপক্ষ। তবে এ পরিবারের এ দুর্দশা স্বেচ্ছা মৃত্যু বা ইউথ্যানসিয়া নিয়ে বাংলাদেশে বিরল বিতর্ক তৈরি করেছে যেখানে কিনা আত্মহত্যার চেষ্টাও ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে পরিগণিত হয়।
কথিত এই ‘মারসি কিলিং’ বা কষ্ট লাঘব থেকে মুক্তি দিতে হত্যার বিষয়টি দেশের ধর্মনিরপেক্ষ আইন ও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশটির অনুসৃত ধর্মীয় রীতিনীতিরও বিরোধী। ইসলামি আলেম ও স্কলার ফরিদউদ্দিন মাসউদ বলেন, ‘এউথ্যানসিয়া ইসলামে সম্পূর্ণ অবৈধ। সরকারের দায়িত্ব প্রত্যেক নাগরিকের ভার গ্রহণ করা।’ মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নুর খান লিটন বলেন, বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ এই মার্সি কিলিং-এর শুধু বিরোধিতাই করবে না, এ নিয়ে আলোচনারও বিরোধী তারা।
তিনি বলেন, ‘তাদের মতে এটি এক ধরনের হত্যা। সরকার ও সমাজের দায়িত্ব এই রোগীদের দেখাশোনা করা।’ কিন্তু তোফাজ্জলের পরিবারের জন্য সহানুভূতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উপচে পড়ছে। অনেকেই পরিবারের প্রতি প্রার্থনা করার কথা বলছেন। সরকারের প্রতি তাদের জন্য চিকিৎসা সেবার আহ্বান জানাচ্ছেন।
রাজধানী ঢাকায় অবস্থিত বাংলাদেশের একমাত্র প্যালিয়াটিভ কেয়ার সেন্টারের প্রধান নেজামুদ্দিন আহমেদ বলেন, এই ইস্যু নিয়ে একটি সৎ আলোচনার প্রয়োজন এসেছে। পাশাপাশি দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা সেবা উন্নত করার সময় এসেছে। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি এ বিষয়টি অনুকূল মৃত্যুর বিষয়ে সুস্থ বিতর্ক তৈরি করবে। কিন্তু তার আগে সরকারের উচিত প্যালিয়াটিভ স্বাস্থ্য সেবা শক্তিশালী করা। এই অসহায় মানুষের যন্ত্রণা লাঘবে কিছু না কিছু আমরা সবাই করতে পারি।’ এমজমিন
২৫ জানুয়ারি ২০১৭/এমটিনিউজ২৪/এসবি