রবিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ১২:৫৪:৫৫

সেই রাজকীয় সব নির্দেশ, তদন্তের পাহাড়ে লতিফ

সেই রাজকীয় সব নির্দেশ, তদন্তের পাহাড়ে লতিফ

বিশেষ প্রতিনিধি : এবার দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তের পাহাড় মোকাবিলা করতে হবে সাবেক মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীকে। পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী থাকাকালে তিনি মন্ত্রণালয়ের যেসব সম্পত্তি ও স্থাপনা বিক্রি আর ইজারা দিয়েছেন সেগুলোর শর্ত, নোট ও মন্তব্য পর্যালোচনা করা হচ্ছে। এসব সরকারি সম্পত্তি বিক্রি ও ইজারায় নজিরবিহীন অনিয়ম-স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ উঠেছে সম্প্রতি জাতীয় সংসদ থেকে পদত্যাগ করা সাবেক মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে। তার বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ তদন্ত করে দেখছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ ব্যাপারে তাকে দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়া মোকাবিলা করতে হচ্ছে বলে জানা গেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আবদুল লতিফ সিদ্দিকী বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্বে থাকাবস্থায় সরকারের মূল্যবান সম্পত্তি বিনা টেন্ডারে বিক্রি, হস্তান্তর ও ইজারা দেয়ার অভিযোগগুলো সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় থেকে লতিফ সিদ্দিকীর সব অনিয়ম-দুর্নীতির নানা তথ্য-উপাত্ত দুদকের কাছে পাঠানো হয়েছে। এর বাইরে বর্তমান সরকারের আমলে তিনি ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী থাকা অবস্থায় সেখানেও তার বিরুদ্ধে যেসব দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে সেগুলো তদন্ত করা হবে।

মহাজোট সরকারের মন্ত্রী থাকাবস্থায় 'স্বেচ্ছাচারিতার মহারাজা' হিসেবে পরিচিত মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী একের পর এক অনিয়মের মাধ্যমে ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে সরকারের সম্পদ পানির দরে বিক্রি করেছেন। এসব অভিযোগ তদন্তে প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে গঠিত কমিটির তদন্তেও বের হয়ে এসেছে দুর্নীতি ও অনিয়মের বিভিন্ন খতিয়ান। ইতিমধ্যে কমিটি তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে, যাতে লতিফ সিদ্দিকীর দুর্নীতির প্রায় অর্ধশত প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে আসা ক্ষমতার অপব্যবহার ও বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানে এবার পুরোদমে মাঠে নেমেছে দুদক। ইতিমধ্যে তার দুর্নীতি অনুসন্ধানে সংশ্লিষ্ট যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করেছে সংস্থাটি। দুদক সূত্র জানায়, মসলিন কটন মিল, মোহিনী জুট মিলস, চিশতি টেঙ্টাইল মিল বিনা টেন্ডারে অবৈধ প্রক্রিয়ায় অন্যদের কাছে হস্তান্তর করার অভিযোগ-সংক্রান্ত বেসরকারিকরণ বা হস্তান্তরকরণ-সংক্রান্ত নথিপত্র দুদকের অনুসন্ধানী কর্মকর্তার হাতে এসেছে। সেই সঙ্গে চট্টগ্রাম সমিতিকে দেয়া সরকারি সম্পত্তি অবৈধ প্রক্রিয়ায় হস্তান্তরের যাবতীয় রেকর্ডপত্রও সংগ্রহ করা হয়েছে। এসব তথ্যপত্র শিগগিরই যাচাই-বাছাই শুরু হবে। এই যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া শেষে লতিফ সিদ্দিকীকে জিজ্ঞাসাবাদও করা হতে পারে। সেই সঙ্গে তার বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে মামলা করা হবে বলে দুদক সূত্র জানায়।

লতিফ সিদ্দিকী বস্ত্র ও পাটমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকাকালে অনেক কিছুই করেছেন নিজের খামখেয়ালিপনায়। ২০১৩ সালে ক্ষমতা ছাড়ার চার দিন আগে এখতিয়ারবহিভর্ূতভাবে নিশাত জুট মিলের ১১ কাঠা ১৩ ছটাক জমি ঢাকায় অবস্থিত চট্টগ্রাম সমিতিকে ৯৯ বছরের জন্য ইজারা দেন তিনি। মতিঝিলে মধুমিতা সিনেমা হলের পেছনে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের মালিকানাধীন ওই জমির বর্তমান বাজারমূল্য ১৫০ কোটি টাকার বেশি হলেও তা মাত্র এক কোটি এক লাখ টাকায় ৯৯ বছরের জন্য ঢাকার চট্টগ্রাম সমিতিকে ইজারা দেন তিনি। এ ছাড়া ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে এখতিয়ারবহিভর্ূতভাবে কুষ্টিয়ার মোহিনী জুট মিল, গাজীপুরের কালীগঞ্জের মুসলিম কটন মিল ও কুমিল্লার চিশতি টেঙ্টাইল বিনা টেন্ডারে হস্তান্তর করেন সাবেক এই মন্ত্রী। এসব কারখানা হস্তান্তরের ক্ষেত্রে তিনি কোনো নিয়ম মানেননি বলেও দুদকে আসা অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।

চট্টগ্রাম সমিতিকে জমিটি ইজারা অনুমোদনের নথিতে আবদুল লতিফ সিদ্দিকী লেখেন, 'মেজবান চট্টগ্রাম সমিতির একটি আকর্ষণীয় বাৎসরিক অনুষ্ঠান। ব্যক্তিগত জীবনে আমি চট্টলাকন্যার পাণি গ্রহণ করেছি। ঢাকার চট্টগ্রাম সমিতি একটি সুপ্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান। তাদের হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় এ ভূমির প্রয়োজনীয়তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মানবতার সেবায় তাদের সহযোগিতা করার নৈতিক দায়িত্ব বোধ করছি।' প্রসঙ্গত, ঢাকার চট্টগ্রাম সমিতির বর্তমান সভাপতি লতিফ সিদ্দিকীর স্ত্রী লায়লা সিদ্দিকী। মন্ত্রী থাকাকালে ক্ষমতার দাপটে সরকারি নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করেননি আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। নিজের একক সিদ্ধান্তে মহাজোট সরকারের পাঁচ বছর বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় চালিয়েছিলেন তিনি। তার ভয়ে সচিব থেকে শুরু করে মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ছিলেন তটস্থ, অসহায়। সরকারি নিয়মকানুন কিংবা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কোনো কথাই মন্ত্রী আমলে নিতেন না।

নিজেই সব সিদ্ধান্ত দিতেন। আর এভাবেই নিজের একক সিদ্ধান্তে তিনি বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী থাকাবস্থায় বিনা টেন্ডারে সম্পূর্ণ নিয়মবহিভর্তভাবে মন্ত্রণালয়ের অধীন অন্তত ৪৮টি সম্পত্তি বিক্রি, ইজারা ও হস্তান্তর করেছেন, যাতে সরকারের হাজার হাজার কোটি টাকা লোকসান হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। মন্ত্রীর নির্দেশমতো তড়িঘড়ি কাজ করতে বাধ্য ছিলেন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। নীতিমালার তোয়াক্কা না করে এসব অনিয়ম ও দুর্নীতি করতে গিয়ে লতিফ সিদ্দিকী মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের এমনও বলেছেন, 'নীতিমালা বঙ্গোপসাগরে নিক্ষেপ করো।' মন্ত্রীর এমন আচরণে তখন মন্ত্রণালয় ও এর অধীন সব দফতর, অধিদফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ছিলেন অসহায়।

সাবেক এই মন্ত্রীর এসব অনিয়ম-দুর্নীতির সত্যতা পাওয়া যায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে গঠিত তদন্ত কমিটির অনুসন্ধানেও। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে লতিফ সিদ্দিকীর নানা অনিয়ম-দুর্নীতির বর্ণনা দিয়ে ৪৮টি সম্পত্তির বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হয়। কমিটির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সম্পূর্ণ নিয়মবহিভর্ূতভাবে, অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় ও বিনা বা কম মূল্যে যেসব সম্পত্তি হস্তান্তর করা হয়েছে, সেগুলো আবার সরকারের অনুকূলে ফেরত নেওয়ার বিষয়টি যাচাই করে দেখতে হবে। এ ছাড়া কমিটি রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি বিনা মূল্যে বিক্রি, হস্তান্তর ও ইজারা দেয়ার সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে।

কমিটি প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করে, মহাজোট সরকারের পাঁচ বছরে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের অধীন বিটিএমসি, তাঁত বোর্ড, বিলুপ্ত জুট করপোরেশন (বিজেসি) এবং বিজেএমসির মোট ৪৮টি প্রতিষ্ঠান বেসরকারিকরণ ও হস্তান্তর করা হয়েছে। এর মধ্যে বিনা টেন্ডারে দেয়া হয়েছে ১২টি। ৪৮টির মধ্যে ৩০টি প্রতিষ্ঠান পূর্ণাঙ্গ হস্তান্তর করা হয়েছে। ১৭টি হস্তান্তরের প্রক্রিয়াধীন। কমিটি প্রতিবেদনে বলেছে, এভাবে সম্পত্তি হস্তান্তরের কারণে জনস্বার্থ ক্ষুণ্ন হয়েছে। এ ছাড়া এসব ক্ষেত্রে বেসরকারিকরণ কমিশন আইন ও নীতিমালা মানা হয়নি। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৪৬টি প্রতিষ্ঠান বা ভূমি হস্তান্তরের ক্ষেত্রে মন্ত্রী যেসব অনিয়ম করেছেন সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে-যথাযথ মূল্য নির্ধারণ না করা, বিনা টেন্ডারে হস্তান্তর, কেবল মন্ত্রীর সিদ্ধান্তে বিনা মূল্যে স্থায়ী বন্দোবস্ত দেয়া, বিক্রির আগে অর্থনৈতিক সম্পর্কবিষয়ক মন্ত্রিসভা কমিটির অনুমোদন না নেওয়া, বিক্রির শর্ত না মানা, আইনগত জটিলতা নিরসন না করেই হস্তান্তর ইত্যাদি।

প্রতিবেদনে বলা হয়, গাজীপুরের কালীগঞ্জের বিখ্যাত মসলিন কটন মিলটি নয়ছয় করে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। ২০১১ সালে রিফাত গার্মেন্ট লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে মাত্র ১৩৫ কোটি টাকায় এটি বিক্রি করা হয়। এটি হস্তান্তর করা হয়েছে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় এবং এর দায়দেনা ও মূল্য যথাযথভাবে নির্ধারণ করা হয়নি বলেও কমিটির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, কুমিল্লার চিশতী টেঙ্টাইল মিলস বিনা টেন্ডারে ও কম মূল্যে বিক্রি করা হয়েছে। একইভাবে খুলনার দৌলতপুরে অবস্থিত বিজেএমসির সম্পত্তি পাট বেলিং কেন্দ্রটি বিক্রি হয়েছে মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকীর নির্দেশ অনুযায়ী। কমিটি তাদের প্রতিবেদনে সমঝোতার মাধ্যমে দাম ঠিক করে এটি বিক্রি করা হয়েছে কি না তা নিয়ে প্রশ্নও তুলেছে। ১৪ কোটি ৪২ হাজার ২১৩ টাকার ওই কেন্দ্রটি মাত্র পাঁচ কোটি পাঁচ লাখ টাকায় বিক্রি করা হয়।

দুদক সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ওই প্রতিবেদনসহ অনুসন্ধানের স্বার্থে সংশ্লিষ্ট আরও রেকর্ডপত্র সংগ্রহ করেছেন তারা, যেগুলো যাচাই-বাছাইয়ের প্রক্রিয়া চলছে।

প্রসঙ্গত, গত বছর ২৮ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে এক অনুষ্ঠানে পবিত্র হজ ও তাবলিগ জামাত নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করায় মন্ত্রিসভা ও দল থেকে অপসারিত হন লতিফ সিদ্দিকী। দেশে ফিরে এসে ২৫ নভেম্বর আদালতে আত্দসমর্পণ করলে লতিফ সিদ্দিকীকে কারাগারে পাঠানো হয়। নয় মাস পর উচ্চ আদালতের নির্দেশে ২৯ জুন মুক্তি পান তিনি। দল থেকে বহিষ্কারের পর লতিফ সিদ্দিকী এমপি থাকবেন কি না তা মীমাংসার জন্য ১৩ জুলাই নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দেন স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। ১ সেপ্টেম্বর আকস্মিকভাবে জাতীয় সংসদে গিয়ে পদত্যাগের ঘোষণা দেন আলোচিত সাবেক এই মন্ত্রী। নির্বাচন কমিশন সংসদে তার আসনটি শূন্য ঘোষণা করেছে এবং সেখানে উপনির্বাচনের আয়োজন চলছে।-বিডিপ্রতিদিন
১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এস.এ.সুমন/একে

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে