জাবেদ রহিম বিজন : একজন মাসুম মিয়া। পিতা-কুদ্দুস মিয়া। আরেকজন সামসু মিয়ার ছেলে মো. মাহফুজ মিয়া। দুজনেরই বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের নাসিরপুর গ্রামে। এ দু- প্রতিবশীর নাম-পরিচয়ে কোন ভুল নেই। পার্থক্য শুধু কর্মের। একজন অপরাধী, আরেকজন খেটে খাওয়া মানুষ। অপরাধী প্রতিবেশীর চতুরতার জালে খেটে খাওয়া মানুষটিই এখন অপরাধীর কাঠগড়ায়। এক মাসের বেশি সময় জেল খাটতে হয়েছে। জেলে থাকার সময় হারিয়েছেন মাকে। পুত্রের চিন্তায় কাতর ছিলেন মা। যেন সর্বনাশের খেলা। নিষ্কৃতি মেলেনি এখনও মাহফুজের।
প্রায় ৮ বছর আগের ঘটনা। কুমিল্লা কোতোয়ালি থানা পুলিশের হাতে ধরা পড়ে মাসুম নামের এক মাদক পাচারকারী। ৩ কেজি গাঁজাসহ সদর থানাধীন চানপুর থেকে তাকে আটক করে এস আই মো. ইকবাল উদ্দিন। চতুর মাসুম তখন পুলিশের কাছে নিজের নাম পরিচয় গোপন করে। নিজের নাম ঠিকানা হিসেবে যা বলে তা মাহফুজের। মাহফুজ মিয়া (২৭), পিতা-মৃত সামসু মিয়া, গ্রাম: নাসিরপুর, থানা-নাসিরনগর, জেলা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া। আসামির এই নাম পরিচয়েই মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা হয়।
জেলে পাঠানো হয় প্রকৃত মাসুমকে। মামলা নম্বর-৯৮। তারিখ: ২৭/০৯/২০০৮ইং। ওই বছরের ২২শে অক্টোবর আদালতে এই মামলার অভিযোগপত্র দেয়া হয়। এই মামলায় প্রায় ৭ মাস জেল খেটে মাহফুজ পরিচয়দানকারী মাসুম ২০০৯ সালের ৮ই এপ্রিল জামিনে বেরিয়ে আসে। এরপর আড়ালে চলে যায় সে। ঘটনার শেষ এখানেই নয়। আদালত থেকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা হয় মাহফুজের বিরুদ্ধে। এই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নিয়ে সম্প্রতি নাসিরনগর থানা পুলিশ হাজির হয় তার বাড়িতে। ঘটনা শুনে পরিবার নিয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটানো মাহফুজের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে।
তাজ্জব বনে যান পরিবারের লোকজন, পাড়া-প্রতিবেশী পুলিশকে বুঝিয়ে বলেন মাহফুজ এ ধরনের লোক নয়। তার বিরুদ্ধে কোন মামলা মোকদ্দমা হয়নি এই জীবনে। কিন্তু পুলিশ ওয়ারেন্ট দেখিয়ে তাদের কিছু করার নেই বলে ধরে নিয়ে আসে মাহফুজকে। গত ৭ই জুলাই রাতে তাকে গ্রেপ্তার করে কুমিল্লায় আদালতে পাঠানো হয়। আদালত তাকে জেল হাজতে পাঠায়। অসহায় মাহফুজের বিষয়টি নিয়ে তারই আরেক প্রতিবেশী ওয়াদুদ মিয়া কুমিল্লায় যান। আইনজীবী নিয়োগ করে তাকে ছাড়িয়ে আনার ব্যবস্থা করেন। গত ১৩ই আগস্ট মাহফুজের জামিন হয়।
আদালতে মাহফুজের আইনজীবীর করা আবেদনে বলা হয়- মাহফুজ মামলার এজাহারে বর্ণিত কোন অপরাধ করেনি। ষড়যন্ত্রমূলকভাবে তাকে জড়ানো হয়েছে, সে পরিস্থিতির শিকার। গাঁজাসহ ধৃত আসামি মাসুম মিয়া। তার পিতার নাম কুদ্দুস মিয়া। ধরা পড়ার পর নিজের পরিচয় গোপন রেখে সে মাহফুজের নাম পরিচয়, ঠিকানা ব্যবহার করে। মাসুম জেল হাজতে যাওয়ার পর ২০০৯ সালের ৮ই এপ্রিল জামিন পায়। মাসুম তার পিতা কুদ্দুস মিয়ার জিম্মাতেই জামিন পায়। জামিন পেয়ে সে আর আদালতে হাজির হয়নি।
অন্যদিকে মাহফুজ মিয়া এ মামলা সম্পর্কে কোন কিছুই জানে না। পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করার পরই সে জানতে পারে। মাহফুজ ভাল মানুষ এবং ইটাখোলার শ্রমিক বলে প্রত্যয়ন করেন নাসিরনগর সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. রফিজ মিয়া ও ২ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য জালু হোসেন। এদিকে মাহফুজকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পরই ছেলের চিন্তায় কাতর হয়ে পড়েন তার মা ললিতা বানু। গত ১০ই আগস্ট তিনি মারা যান। মাহফুজ জেলে থাকায় শেষ দেখা হয়নি তার মায়ের সঙ্গে।
মাহফুজের প্রতিবেশী ওয়াদুদ বলেন- মাহফুজ একজন খেটে খাওয়া মানুষ। তার এই বিপদে গ্রামের মানুষ হিসেবে কুমিল্লায় যাই। তাকে জামিনে মুক্ত করার ব্যবস্থা করি। তিনি বলেন আমরা ৭/৮ বছর আগে শুনেছিলাম মাসুম কুমিল্লায় ধরা পড়েছে। এরপরের আর কোন খোঁজখবর জানা ছিল না আমাদের। দারোগা আসার পর আমরা জানতে পারি মাহফুজের বিরুদ্ধে মামলা। এতে আমরা অবাক হই।
আমরা আগে থেকেই জানতাম মাসুম গাঁজা সেবনকারী এবং গাঁজার ব্যবসায়ী। এর আগেও সে বিভিন্ন জায়গায় ধরা পড়েছে মাদক নিয়ে। তিনি জানান- আদালত মাহফুজের বিষয়টি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু এখনও তদন্ত আসেনি। ওয়াদুদ বলেন- মাহফুজের শোক নিয়েই মারা গেছেন তার মা। আমরা তখন মাহফুজকে এ খবর জানাইনি পাছে যদি মাহফুজ আবার অসুস্থ হয়ে পড়ে।
নাসিরনগর সদর ইউপি চেয়ারম্যান মো. রফিজ মিয়া বলেন মাহফুজ কোন খারাপ কাজে জড়িত নয় বলে আমরা প্রত্যয়ন করেছি। নাসিরনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবদুল কাদের বলেন- কুমিল্লার ওয়ারেন্টে আমরা একজনকে ধরেছিলাম। ওয়ারেন্ট হলে পুলিশের কাজ হলো ধরা। মাঝখানে কি হয়েছে না হয়েছে তা আমার জানা নেই। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের সঙ্গে আমি বিষয়টি নিয়ে কথা বলবো।-এমজমিন
১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এস.এ.সুমন/একে