আবদুল আলীম : কোন প্রতিষ্ঠানের ডাকের অপেক্ষায় থাকেন তিনি। সরকার কিংবা বিরোধী দল, রাজনৈতিক কিংবা সামাজিক সংগঠন- যে কেউ ডাকলেই ছুটে আসেন। মাত্র ২ থেকে ৩ ঘণ্টা সময়। দাবি-দাওয়া সংক্রান্ত ব্যানার ধরে দাঁড়িয়ে থাকেন। এরপর কর্মসূচি শেষ হলে তিনি তার পাওনা নিয়ে আবারও অন্য কোন সংগঠনের পক্ষে রাজপথে দাঁড়ান। এভাবেই দিন কেটে যায় তার। নাম মতিউর রহমান। শরীয়তপুর সদরে বাড়ি। ৯০-এর দশকে কাজের সন্ধানে ঢাকায় আসেন। গুলশানে এক শিল্পপতির বাড়িতে দারোয়ানির কাজও পেয়ে যান। কিন্তু এ চাকরিতে তার মন বসে না।
একদিন চাকরি ছেড়ে দেন। ক’দিন বেকার থেকে বিভিন্ন দলের অফিসে যাওয়া-আসা শুরু করেন। নেতাদের পিছু পিছু থেকে যা বকশিশ পেতেন তা নিয়েই দিন পার করতেন। সেখানেই তিনি দেখতে পান নেতারা কোন সভা কিংবা সমাবেশ হলে, প্রেস ক্লাবের সামনে কোন দাবি আদায়ে ভাড়ায় লোক আনেন। একদিন তিনিও এ কাজে নেমে পড়েন। সে থেকে এখন পর্যন্ত সংগঠনের পক্ষে ভাড়ায় গিয়ে উপার্জন করছেন। সকাল থেকেই প্রেস ক্লাব থেকে হাইকোর্ট পর্যন্ত ঘুরাফেরা করেন। ভাড়ায় খাটা এই মতিউরকে সবাই চেনেন। প্রতি অনুষ্ঠানে কর্মী হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকলে তিনি পান ৭০ টাকা।
মতিউর রহমান বলেন, দেশে আন্দোলন হলে ব্যবসা ভাল যায়। সরকারের কোন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সংগঠনগুলো সোচ্চার হলেও ব্যবসা জমে ওঠে। এছাড়া, প্রতিদিন প্রেস ক্লাবে কোন না কোন আলোচনা সভাতো রয়েছেই। এই আলোচনা সভার অনুষ্ঠানে চেয়ারে বসে থাকার জন্যও চুক্তিবদ্ধ হই। অনুষ্ঠান শেষে পাওনা টাকা নিয়ে চলে আসি।
তিনি বলেন, জাতীয় প্রেস ক্লাবসহ আশেপাশের বিভিন্ন এলাকায় এখন প্রচুর প্রোগ্রাম হয়। নেতাসর্বস্ব দলগুলো আমাদের ডাকে। তাদের দলের নেতাকর্মী না থাকায় আমাদের ভাড়া করে নিয়ে যায়। এর বিনিময়ে আমাদের মাথাপিছু টাকা দিতে হয়। প্রেস ক্লাব এলাকায় আমাদের কয়েকজন ঠিকাদার আছে। তারা কাজ ধরে। পরে আমাদের ডাকে। তখন এসে সংশ্লিষ্ট অনুষ্ঠানের কর্মী হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকি।
তিনি বলেন, বিভিন্ন দলের কাছ থেকে যে কাজ ধরে, সে মাথাপিছু ৮০ টাকা করে নেয় আয়োজকদের কাছ থেকে। পরে জনপ্রতি ১০ টাকা রেখে আমাদের দেয় ৭০ টাকা। দিনে ২ থেকে ৩টা প্রোগ্রামও করে থাকি। আমার মতো আরও অনেকেই এই পেশায় জড়িত। তাদের কেউ রাতে সিকিউরিটির কাজ করে। কেউবা রাজমিস্ত্রি বা অন্যান্য পেশার সঙ্গে জড়িত। প্রেস ক্লাবের এক কর্মচারী আমাদের বেশি কাজ দেন। তার আন্ডারে কাজ করলে আমাদের কোন সমস্যা হয় না।
মতিউরের মতো শহীদুল্লাহও এ কাজে জড়িত। বাসা তোপখানা রোডে। বয়স ৭০ বছর। সারাদিন প্রেস ক্লাবের সামনে ঘোরাঘুরি করেন। কোন দলের লোক লাগলে তিনি সরবরাহের কাজ করেন। প্রেস ক্লাব এলাকায় শহীদুল্লাহর মতো আরও অনেকেই রয়েছেন। জাতীয় প্রেস ক্লাবের কর্মচারী থেকে শুরু করে সাংবাদিকদের কাছেও শহীদুল্লাহরা ‘ম্যানপাওয়ার আমদানি-রপ্তানিকারক’ হিসেবে পরিচিত। এই সব আমদানি-রপ্তানিকারক সরদারদের সঙ্গে বিভিন্ন নামসর্বস্ব দলের নেতাদের পরিচয়। মাথাপিছু ৭০ থেকে ৮০ টাকা করে দিয়ে লোক নেন। কাজ ধরে শহীদুল্লাহরা বিভিন্ন জায়গা থেকে লোক এনে দাঁড় করান প্রোগ্রামে। মানববন্ধন বা সভা-সমাবেশে লোক দেয়া শহীদুল্লাহর পেশা। দলগুলোর কাছে লোক সরবরাহ করে যে টাকা পায় তার থেকে মাথাপিছু ১০ টাকা করে রেখে বাকিটা কর্মীদের ভাগ করে দেন। শহীদুল্লাহ বলেন- আমরা দীর্ঘদিন ধরে কাজ করি। মানুষের কাছে অনেক বিশ্বস্ত হয়ে গেছি। আমাদের প্রতিদিন দুই একটা প্রোগ্রাম থাকে।
পেশায় প্রেস ক্লাবের দারোয়ান সুজনও এ পেশায় জড়িত। প্রেস ক্লাবেই থাকেন। ওখানেই খাওয়া- দাওয়া। বেশির ভাগ সময় রাতের ডিউটি নেন তিনি। সকাল বা বিকালে তার প্রধান কাজ সভা-সমাবেশে লোক সরবরাহ করা। বিভিন্ন দলের নেতারা সাধারণত সুজনের কাছেই লোক চায়। তখন শহীদুল্লাহ বা অন্যদের ডেকে কাজ দিয়ে দেন সুজন। এর বিনিময়ে সুজনের নির্দিষ্ট কমিশন থাকে। সুজন প্রেস ক্লাবের কর্মচারী হওয়ায় এখন আর ব্যানার ধরে দাঁড়ান না। তবে এখানে চাকরি করার আগে ব্যানার ধরে দাঁড়াতেন।
জাহিদও প্রেস ক্লাবে সারাদিন ঘোরাঘুরি করেন। নামসর্বস্ব দলগুলোর এমন কোন প্রোগ্রাম নেই যেখানে তাকে দেখা যায় না। শহীদুল্লাহ যেখানে থাকেন জাহিদকেও সেখানে প্রায় সব সময় দেখা যায়। তারা দুজনে মিলেই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে লোক সরবরাহ করেন। জাহিদও থাকেন তোপখানা রোড এলাকায়। এই পেশার বাইরে তার আর কোন কাজ নেই। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে লোক সরবরাহ করে যে আয় হয় তা দিয়ে বেশ ভালোই চলে যায় তার। প্রতিদিন দুই থেকে তিনটি প্রোগ্রামে নিজের মাথাপিছু আয় ছাড়াও জনপ্রতি ১০ টাকা কমিশন ভাগাভাগি করে অনেক টাকাই আয় হয় তার।
সালাউদ্দিনকে অনেকে প্রেস ক্লাবের কর্মচারী বলে চেনেন। কিন্তু আসলে তিনি প্রেস ক্লাবের কোন কর্মচারী নন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে চেয়ার গোছগাছ থেকে শুরু করে ঝাড়ুও দিয়ে দেন। প্রোগ্রাম শেষে আয়োজকদের কাছ থেকে বকশিশ নেন। এছাড়া, বিভিন্ন মানববন্ধনেও তিনি ব্যানার ধরে দাঁড়িয়ে থাকেন। অনুষ্ঠান শেষে তাদের কাছ থেকে টাকা দাবি করেন।
এছাড়া, মাঝে মধ্যে শহীদুল্লাদের সঙ্গে লাইনে
৮ বছর ধরে এই পেশার সঙ্গে জড়িত আজিজ। বয়স আনুমানিক ৪০ বছর। সেগুনবাগিচায় এক বাড়িতে দারোয়ানি করেন। রাতের বেলা দারোয়ানি আর দিনে প্রেস ক্লাবের সামনে বিভিন্ন সংগঠনের কর্মসূচিতে অংশ নেন।-এমজমিন
১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এস.এ.সুমন/একে