নিউজ ডেস্ক : ডোনাল্ড ট্রাম্প ও মাইকেল ফ্লিনমাত্র তিন সপ্তাহ হলো প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এই স্বল্প সময়ে একের পর এক বিতর্ক ও কেলেঙ্কারিতে প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁর যোগ্যতা নিয়ে নানা মহলে কথা উঠেছে। গত সোমবার প্রেসিডেন্টের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইকেল ফ্লিনের পদত্যাগে সেই বিতর্ক আরও উসকে দিল।
সোমবার সকাল থেকেই শোনা যাচ্ছিল, প্রেসিডেন্টের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইকেল ফ্লিনের পদত্যাগ শুধু সময়ের ব্যাপার। হোয়াইট হাউস থেকে এ নিয়ে সারা দিন মিশ্র ইঙ্গিত পাঠানো হয়। দুপুর নাগাদ ট্রাম্পের অন্যতম উপদেষ্টা কেলিঅ্যান কনওয়ে বলেন, তাঁর পদত্যাগের প্রশ্নই ওঠে না। ফ্লিনের প্রতি প্রেসিডেন্টের পূর্ণ আস্থা রয়েছে। এর এক ঘণ্টার মধ্যে সেই ভাষ্য পরিবর্তন করে ট্রাম্পের মুখপাত্র শন স্পাইসার বলেন, ফ্লিনের ব্যাপারে ট্রাম্প পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে দেখছেন।
রাত ১১টার দিকে মাইকেল ফ্লিন এক বিবৃতিতে নিজেই জানালেন, তিনি নিরাপত্তা উপদেষ্টার দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করেছেন। এক সংক্ষিপ্ত বিবৃতিতে তিনি বলেন, রুশ রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে তাঁর টেলিফোন আলাপের বিষয়ে ভাইস প্রেসিডেন্ট পেন্সকে অনিচ্ছাকৃতভাবে অসম্পূর্ণ তথ্য দিয়েছিলেন তিনি। সে জন্য তিনি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও ভাইস প্রেসিডেন্ট পেন্সের কাছে আন্তরিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। তাঁরা উভয়েই তা গ্রহণ করেছেন।
মধ্যরাতে হোয়াইট হাউস থেকে জানানো হয়, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জেনারেল ফ্লিনের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেছেন এবং অস্থায়ী জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে জেনারেল কিথ কেলগকে নিয়োগ দিয়েছেন। জানা গেছে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই পদে আরও দুজনের কথা বিবেচনা করছেন। তাঁরা হলেন সিআইএর সাবেক পরিচালক ডেভিড পেট্রেয়াস এবং নৌবাহিনীর সাবেক ভাইস অ্যাডমিরাল রবার্ট হারওয়ার্ড।
জেনারেল ফ্লিন রাশিয়ার ওপর আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নেওয়ার ব্যাপারে ওয়াশিংটনে রুশ সের্গেই রাষ্ট্রদূত কিসলিয়াকের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন এবং সেই কথাবার্তার রেকর্ডিং রয়েছে—এ কথা জানার পর থেকেই ফ্লিনের আসন নড়বড়ে হয়ে পড়ে। তিনি নিজে ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সকে জানিয়েছিলেন, ক্রিসমাসের আগে তাঁদের টেলিফোনে যে কথাবার্তা হয়, তাতে নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি আলোচিত হয়নি, শুধু বড়দিনের শুভেচ্ছা বিনিময় করেছেন। পেন্স জাতীয় টিভিতে সে কথা উল্লেখ করে একাধিকবার ফ্লিনের পক্ষে সাফাইও গেয়েছেন। কিন্তু মার্কিন গোয়েন্দাদের বরাত দিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে রুশ রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে ফ্লিনের কথাবার্তা ফাঁস হওয়ার পর ব্যাপারটা সবচেয়ে বিব্রতকর হয়ে পড়ে পেন্সের জন্য।
সোমবার সারা দিন ওয়াশিংটনে সবচেয়ে বড় গুজব ছিল, ফ্লিন বাদ পড়ছেন। তাঁর অবস্থা মূল্যায়নের যে কথা ট্রাম্পের বরাত দিয়ে হোয়াইট হাউস থেকে বলা হয়, তাতেই এর স্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল। কিন্তু দিন শেষ হওয়ার আগেই গোয়েন্দা সূত্রের বরাত দিয়ে ওয়াশিংটন পোস্ট জানাল, ভারপ্রাপ্ত অ্যাটর্নি জেনারেল স্যালি ইয়েটস গত ডিসেম্বরেই গোয়েন্দা সূত্রে জানতে পারেন, রুশ কর্তৃপক্ষের হাতে এমন তথ্য আছে, যা ব্যবহার করে তারা জেনারেল ফ্লিনকে ব্ল্যাকমেল করতে পারে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার আগেই ট্রাম্প ও তাঁর টিমকে এ তথ্য পৌঁছে দেওয়া হয়। ট্রাম্প ও তাঁর উপদেষ্টারা বিষয়টি নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও ট্রাম্প ফ্লিনকেই জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার পদে নিয়োগ দেন। উল্লেখ্য, ইয়েটসকে ট্রাম্প মাত্র কয়েক দিন আগে তাঁর মুসলিম ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার সঙ্গে ভিন্নমতের কারণে পদচ্যুত করেন।
ফ্লিন ও রুশ রাষ্ট্রদূত কিসলিয়াকের মধ্যে টেলিফোন কথাবার্তার বিষয়টি বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ওবামার দৃষ্টি আকর্ষণ করে ২৯ ডিসেম্বরের পর। সে সময় মার্কিন নির্বাচনে হস্তক্ষেপের অভিযোগে প্রেসিডেন্ট ওবামা মস্কোর বিরুদ্ধে নতুন বিধিনিষেধ আরোপ করেন এবং ৩৫ জন রুশ কূটনীতিককে বহিষ্কারের নির্দেশ দেন। ওয়াশিংটন স্বাভাবিকভাবেই আশা করেছিল, এই নির্দেশের জবাবে মস্কোও সেখানে সমসংখ্যক মার্কিন কূটনীতিককে বহিষ্কার করবে। কিন্তু বিস্ময়করভাবে প্রেসিডেন্ট পুতিন এক ঘোষণায় বলেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পাল্টা কোনো ব্যবস্থা নেবেন না। এই সিদ্ধান্তে ওবামা প্রশাসনের সবাই চোখ কপালে তুললেও ডোনাল্ড ট্রাম্প এক টুইটার বার্তায় ওই সিদ্ধান্তের জন্য পুতিনকে চৌকস বলে প্রশংসা করেছিলেন।
জানা গেছে, জেনারেল ফ্লিন ও রুশ রাষ্ট্রদূতের মধ্যে কথাবার্তার রেকর্ডিং মার্কিন গোয়েন্দাদের হস্তগত হওয়ার পর এফবিআই তার একটি সারসংক্ষেপ তৈরি করে। রাষ্ট্রদূত কিসলিয়াক ফ্লিনের সঙ্গে কথোপকথনের যে প্রতিবেদন মস্কো পাঠান, তার কপিও এফবিআইয়ের হাতে পৌঁছে যায়। এই দুই প্রতিবেদন দেখার পরেই ভারপ্রাপ্ত অ্যাটর্নি জেনারেল ইয়েটস বিষয়টি ট্রাম্প প্রশাসনের গোচরে আনেন। এফবিআই অবশ্য এর আগে থেকেই মস্কো ও ট্রাম্পের গোপন সম্পর্ক বিষয়ে একটি তদন্ত শুরু করেছিল। রুশ রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে ফ্লিনের আলাপচারিতা সেই তদন্তে এক নতুন মাত্রা যোগ করে।
মার্কিন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞেরা ধারণা করছেন, ট্রাম্প ক্ষমতা গ্রহণের পর রাশিয়ার বিরুদ্ধে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা ক্রমশ তুলে নেবেন—ফ্লিন হয়তো এমন কোনো প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকবেন। সম্ভবত সে কারণেই পুতিন ওয়াশিংটনের বিরুদ্ধে কোনো পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণে অনাগ্রহী ছিলেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের আগে ট্রাম্প নিজেই একাধিকবার ইঙ্গিত করেছেন, তিনি রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার পক্ষে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তিনি যাঁকে নিয়োগ দিয়েছেন, সেই রেক্স টিলারসনও নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার ব্যাপারে তাঁর আগ্রহের কথা বলেছেন।
মাত্র ২৪ দিন দায়িত্ব পালনের পর জেনারেল ফ্লিন নিরাপত্তা উপদেষ্টার দায়িত্ব থেকে সরে যেতে বাধ্য হলেন। স্বল্প সময়ের জন্য দায়িত্ব পালনের এটি একটি রেকর্ড। শপথ গ্রহণের পর থেকেই ট্রাম্প প্রশাসন নানা সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অযোগ্যতা ও অনভিজ্ঞতা ছাড়াও বিভিন্ন শীর্ষ কর্মকর্তার মধ্যে অন্তঃকলহ প্রশাসনিক কাজকর্মে বিশৃঙ্খলার জন্ম দেয়। ট্রাম্পের দুই প্রধান উপদেষ্টা স্টিভ ব্যানন ও স্টিভ মিলার বিভিন্ন দপ্তরের সঙ্গে পর্যাপ্ত আলাপ-আলোচনা ছাড়া তাড়াহুড়ো করে মুসলিম দেশ থেকে নাগরিকদের ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা-সংক্রান্ত নির্বাহী আদেশ জারি করেছেন, সেই সমালোচনার ঝড় এখনো থামেনি। হোয়াইট হাউসের চিফ অব স্টাফ রিন্স প্রিবাসের সঙ্গে তাঁদের দুজনের দ্বন্দ্বও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। হোয়াইট হাউসের সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত মুখপাত্র শন স্পাইসারের কাজে ট্রাম্প নিজে সন্তুষ্ট নন, এমন কথা হোয়াইট হাউস থেকেই ফাঁস করা হয়েছে।
প্রশাসনের একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাকে মস্কোর সঙ্গে গোপন সম্পর্কের অভিযোগে মাত্র তিন সপ্তাহের মাথায় সরে যেতে বাধ্য হওয়ায় বিব্রতকর অবস্থায় পড়লেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজে। তবে জেনারেল ফ্লিনের পদত্যাগের মধ্য দিয়ে মস্কোর সঙ্গে ট্রাম্পের গোপন সম্পর্কের বিতর্ক শেষ হবে, সে কথা ভাবার কোনো কারণ নেই। ওবামার সাবেক ক্যাম্পেইন ম্যানেজার ও শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডেভিড এক্সেলরড বলেছেন, বিরোধী ডেমোক্র্যাটরা সহজে বিষয়টি ছেড়ে দেবেন না। তাঁরা স্বাভাবিকভাবেই জানতে চাইবেন, ফ্লিন মস্কোর সঙ্গে নিষেধাজ্ঞা প্রশ্নে কথা বলেছেন—এ কথা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আগে থেকেই জানতেন কি না এবং জেনে থাকলে কখন জানতেন। এই প্রশ্নে কেঁচো খুঁড়তে গেলে সাপ বেরিয়ে আসার সম্ভাবনা রয়েছে।
আমাদের ব্যাপার নয়: ক্রেমলিন
রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের কার্যালয় ক্রেমলিন গতকাল মঙ্গলবার বলেছে, মাইকেল ফ্লিনের পদত্যাগ ওয়াশিংটনের অভ্যন্তরীণ বিষয়। ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ মস্কোতে সাংবাদিকদের বলেন, ‘এটা মার্কিনদের অভ্যন্তরীণ বিষয়, এটা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রশাসনের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এটা আমাদের কোনো বিষয় নয়।’
নতুন আইনি বাধায় ট্রাম্প
সাতটি মুসলিমপ্রধান দেশের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ সাময়িক নিষিদ্ধ করে দেওয়া ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশের আরেক দফা আইনি পরাজয় হলো। ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্যের একজন ডিস্ট্রিক্ট জজ সোমবার ওই নিষেধাজ্ঞা অসাংবিধানিক বলে রায় দিয়েছেন। একজন বিচারক ইতিমধ্যেই ওই আদেশের কার্যকারিতার ওপর স্থগিতাদেশ বহাল রেখেছেন। তবে ভার্জিনিয়ার আদালতের রায়টি গুরুত্বপূর্ণ কারণ, বিচারক অভিমত দিয়েছেন ট্রাম্পের নিষেধাজ্ঞার মূলে রয়েছে ধর্মীয় পক্ষপাত। মার্কিন সংবিধানের প্রথম সংশোধনীর বলে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার কোনো ধর্মকে অন্য ধর্মের চেয়ে বাড়তি সুবিধা দিয়ে আইন করতে পারে না। -প্রথম আলো।
১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭/এমটিনিউজ২৪/সৈকত/এমএম