রবিবার, ১৮ অক্টোবর, ২০১৫, ০৪:০২:০৯

বিদেশি অনুদান নিয়ন্ত্রণ বিলে পশ্চিমাদের উদ্বেগ

বিদেশি অনুদান নিয়ন্ত্রণ বিলে পশ্চিমাদের উদ্বেগ

মেহেদী হাসান : প্রস্তাবিত 'বিদেশি অনুদান (স্বেচ্ছাপ্রণোদিত কার্যক্রম) নিয়ন্ত্রণ বিল' নিয়ে উন্নয়ন সহযোগী পশ্চিমা দেশ ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর উদ্বেগ জোরালো হচ্ছে। বিলটি গত ১ সেপ্টেম্বর সংসদে উত্থাপিত হয়েছে। আগামীতে বিলটি পাস হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এবং এতে দেশে মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা এনজিও ও নাগরিক সমাজের কর্মকাণ্ডে প্রভাব পড়বে বলে পশ্চিমা দেশগুলোর আশঙ্কা। সরকারি সূত্রগুলো জানায়, ইউরোপীয় পার্লামেন্টের একটি প্রতিনিধিদলের গত ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা সফরের সময়ও বিদেশি অনুদান নিয়ন্ত্রণ বিলের সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে আলোচনা হয়। তখন ইউরোপীয় পার্লামেন্ট প্রতিনিধিরা উদ্বেগ জানিয়ে বলেছিলেন, বিলটি গৃহীত হলে এনজিওগুলোর কাজের সুযোগ কমে যাবে, তাদের স্বাধীনতা খর্ব হবে। বিভিন্ন সময় বিদেশি প্রতিনিধিরাও বিষয়টি সরকারের কাছে তুলেছেন এবং এখনো তা অব্যাহত আছে। বেলজিয়ামের ব্রাসেলসভিত্তিক আন্তর্দেশীয় বেসরকারি সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ গত ৯ ফেব্রুয়ারি "ম্যাপিং বাংলাদেশ'স পলিটিক্যাল ক্রাইসিস" শীর্ষক যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল, তাতে ভিন্নমত দমনে বর্তমান সরকারের প্রচেষ্টা হিসেবে বিদেশি অনুদান নিয়ন্ত্রণ বিলের প্রসঙ্গ ছিল। ঢাকাভিত্তিক অনেক এনজিও ওই বিলকে সরকারি নিয়ন্ত্রণ আরোপের চেষ্টা বলে মনে করে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ ছিল। গত বছর জুন মাসে মন্ত্রিসভা আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় এনজিওগুলোর বিদেশি অনুদান নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে ওই বিলের খসড়া অনুমোদন করে। বিলটি গৃহীত হলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এনজিওবিষয়ক ব্যুরো কোনো এনজিওকে বিদেশি অনুদান গ্রহণের অনুমতি দিতে বা নাকচ করতে পারবে এবং এনজিওবিষয়ক ব্যুরোর মহাপরিচালক, বিভাগীয় কমিশনার, ডেপুটি কমিশনার ও অন্য স্থানীয় নির্বাহীরা বিদেশি অনুদান গ্রহণকারী এনজিওগুলোর কার্যক্রম পরিদর্শন, পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা করতে পারবেন। এ ছাড়া বিদেশি অনুদান ব্যয়ের শর্ত ভাঙা হলে তাদের বিরুদ্ধে মামলা, জরিমানা, নিবন্ধন স্থগিত বা বাতিলেরও সুযোগ থাকবে। তবে সরকারি সূত্রগুলো বলেছে, এনজিওগুলোতে বিদেশি অনুদানের বিষয়টি স্বচ্ছ করার জন্যই এ বিল আনা হয়েছে। নাগরিক সমাজ ও এনজিওগুলোর কাজের সুযোগ কমানো তাদের উদ্দেশ্য নয়। বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বিদেশি তহবিল কোন দেশ থেকে কী উদ্দেশ্যে কার কাছে আসছে এবং তা কতটা, কিভাবে কাজে লাগছে সে বিষয়ে রাষ্ট্রের দৃষ্টি দেওয়া জরুরি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা প্রতিবেদককে বলেন, আগেও বিক্ষিপ্তভাবে এ ধরনের নিয়ম-বিধিবিধান ছিল। এখন সমন্বিতভাবে আইন করা হচ্ছে। এর ফলে কোথা থেকে অর্থ আসছে এবং তা কোথায় ব্যয় হচ্ছে তা জানা হবে। জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন ঠেকাতে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, বাংলাদেশ যেসব বিষয় নিয়ে গর্ব বোধ করে সেগুলোর শীর্ষে রয়েছে এনজিও ও নাগরিক সমাজের ভূমিকা। আগামীতে এনজিও ও নাগরিক সমাজের আরো বিকাশ দেখতে চায় সরকার। রাতারাতি ওই আইন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বরং চার-পাঁচ বছর ধরে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনা ও মতামতের ভিত্তিতে এর খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে। মতামত দেওয়ার জন্য খসড়াটি দুই বছর ধরে ওয়েবসাইটে দেওয়া ছিল। জানা গেছে, প্রস্তাবিত ওই বিল নিয়ে পশ্চিমা উন্নয়ন সহযোগীদের উদ্বেগ জানানোর ঘটনা নতুন নয়। গত বছরের শেষ দিকে মন্ত্রিসভায় বিলটি অনুমোদিত হওয়ার আগে ও পরে বাংলাদেশে পশ্চিমা রাষ্ট্রদূতদের অনেকে এ নিয়ে তাঁদের উদ্বেগ ও শঙ্কা জানিয়েছিলেন। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক এনজিওগুলোও এ বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়ে আসছে। প্রতিবেশী ভারতেও এনজিও নিয়ে আইন প্রণয়নের সময় বিভিন্ন মহল উদ্বেগ জানিয়েছে। গত ১ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে বিলটি তোলার পর সেটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হয়। বিলে বলা হয়, বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের (এনজিও) কার্যক্রম বর্তমানে পরিচালিত হয় ১৯৭৮ ও ১৯৮২ সালের দুটি অধ্যাদেশ দিয়ে। সামরিক শাসনামলের অধ্যাদেশ দুটি একত্র করে নতুন আইন করতে বিলটি উত্থাপন করা হয়। বিদেশি অনুদান নেওয়ার ক্ষেত্রে নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করে এবং অনুমোদন ছাড়া প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন না করার বিধান রাখা হয় বিলটিতে। বিলে বলা হয়েছে, একটি এনজিও ১০ বছরের জন্য নিবন্ধন পাবে। তবে আইন অমান্য করলে যেকোনো সময় নিবন্ধন বাতিল বা স্থগিত করা যাবে। এদিকে এ দেশের এনজিও প্রতিনিধিরা গত ৩০ সেপ্টেম্বর সংসদীয় কমিটির সঙ্গে আলোচনায় ওই বিল বিষয়ে আট দফা সুপারিশ জমা দিয়েছেন। তাঁদের মতে, এই আইনের ফলে প্রবাসী বাংলাদেশিসহ অন্যদের জনহিতকর ও স্বেচ্ছাসেবামূলক কার্যক্রম নিরুৎসাহ হতে পারে। এ ছাড়া অবৈধ অর্থপ্রবাহ ও কর ফাঁকির প্রবণতাও বাড়তে পারে। অন্যদিকে বিশ্বের ৮০টিরও বেশি দেশে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর জোট দ্য অবজারভেটরি ফর দ্য প্রটেকশন অব হিউম্যান রাইটস ডিফেন্ডার্স (ওবিএস) গত শুক্রবার এক বিবৃতিতে প্রস্তাবিত ওই বিলটি প্রত্যাহার করে নিতে জাতীয় সংসদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। ফ্রান্সের প্যারিস ও সুইজারল্যান্ডের জেনেভা থেকে প্রকাশিত ওবিএসের বিবৃতিতে বলা হয়, ওই বিলটি আইনে পরিণত হলে বাংলাদেশে নাগরিক সমাজের কর্মকাণ্ড ও মানবাধিকার রক্ষার বৈধ উদ্যোগ ব্যাপকভাবে সীমিত হবে। ওয়ার্ল্ড অর্গানাইজেশন অ্যাগেইনস্ট টর্চারের (ওএমসিটি) মহাসচিব গেরাল্ড স্টাবেরক বলেন, 'বাংলাদেশে মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা এনজিওগুলোর ওপর ঝুলন্ত তরবারিকে স্থায়ী রূপ দেওয়া এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের স্তব্ধ করে দেওয়াই নতুন এ বিলের লক্ষ্য।' তাঁর আশঙ্কা, ওই বিল গৃহীত হলে মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে কাজ করা এনজিওগুলো বিদেশি অনুদান গ্রহণের ছাড়পত্র পাবে না এবং নিবন্ধন বাতিলের ঝুঁকিতে পড়বে। তিনি খুব দেরি হওয়ার আগেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে জেগে ওঠার বা বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সুযোগ 'নাটকীয়ভাবে কমে যাওয়া' দেখার জন্য প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানান। ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর হিউম্যান রাইটসের (এফআইডিএইচ) করিম লাহিদজির মতে, বিলটি গৃহীত হলে বাংলাদেশে নাগরিক সমাজ ও সংগঠনগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে। এটি সুস্পষ্টভাবে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানের লঙ্ঘন। ওই মানকে সম্মান জানাতে বাংলাদেশ বাধ্য বলে তিনি মন্তব্য করেন।-কালের কণ্ঠ ১৮ অক্টোবর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এস.এ.সুমন/একে

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে