রবিবার, ১৮ অক্টোবর, ২০১৫, ০৪:৩৫:৫০

ফেঁসে যেতে পারেন বিএনপির সেই নেতা

ফেঁসে যেতে পারেন বিএনপির সেই নেতা

সরোয়ার আলম : জাপানের নাগরিক কুনিও হোশি হত্যাকাণ্ডের রহস্য অনেকটাই উদ্ঘাটন করে ফেলার দাবি করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা। তাদের মতে, কুনিওকে কেন হত্যা করা হয়েছে তা জানা গেছে। ব্যবসাসংক্রান্ত বিরোধকে পুঁজি করে তাঁকে হত্যা করা হয়। আর হত্যাকাণ্ডে যারা জড়িত ছিল তাদেরও নজরদারির আওতায় আনা হয়েছে। তদন্তকারী সংস্থাগুলো ঘাতকদের সম্পর্কে অচিরেই বিস্তারিত জানানোর পরিকল্পনা নিয়েছে। চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সরকারবিরোধী মহল ও বিদেশি দুটি গোয়েন্দা সংস্থা জড়িত বলে তদন্তকারীরা নিশ্চিত হয়েছেন। পুলিশ ও গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রংপুর জেলা মৎস্যজীবী দলের আহ্বায়ক কামাল হোসেনকে একটি গোয়েন্দা সংস্থা আটক করেছে। তাদের দাবি, কামাল হোসেন ওই খুনের পরিকল্পনাকারীদের মধ্যে একজন। তবে কোনো কর্মকর্তা প্রকাশ্যে এ বিষয়ে কিছু বলতে রাজি নন। ফেঁসে যেতে পারেন হাবিব-উন-নবীও পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, হত্যাকাণ্ডের দুই দিন আগে ঢাকা মহানগর বিএনপির সদস্যসচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেল ও কামালের মধ্যে নাশকতার বিষয় নিয়ে দীর্ঘক্ষণ আলোচনা হয়েছে মোবাইল ফোনে। রংপুরে আরেকটি অঘটন ঘটানো হবে বলে কামালকে জানান সোহেল। আর কামাল তাতে সাড়া দেন। কামাল তাঁর বড় ভাই হীরার সঙ্গেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি হীরাকে বলেন কুনিও হোশির খামারে কিছুদিন না যেতে। সেখানে কোনো একটা সমস্যা হতে পারে বলে কামাল সতর্ক করেন। এসব কথোপকথন উদ্ঘাটন করেছে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থা। ঘটনার দিন কামাল রংপুরেই ছিলেন বলে উল্লেখ করে ওই কর্মকর্তা বলেন, হীরার কাছ থেকে হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে চমকপদ তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। কারা হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে সেই তথ্যও তিনি দিয়েছেন। এক প্রশ্নের জবাবে ওই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, 'সরকারকে ঘায়েল করতেই বিদেশিকে হত্যা করা হয়। হত্যার সঙ্গে ভাড়াটে কিলার গ্রুপও জড়িত আছে বলে আমরা তথ্য পেয়েছি। আশা করি আগামী সপ্তাহের মধ্যে এই হত্যাকাণ্ডের বিস্তারিত দেশবাসীকে জানানো যাবে।' এদিকে কামাল হোসেনের মা হাসিনা বেগম জানিয়েছেন, কামাল ছাড়াও তাঁর আরেক ছেলের কোনো সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। হাসিনা বেগমের আরেক ছেলে হুমায়ুন কবির হীরা এ মামলায় পুলিশ হেফাজতে আছেন। তিনি কুনিও হোশির ব্যবসায়িক অংশীদার। হীরার নামে কানাডা ও লন্ডন থেকে ৮৯ লাখ টাকা আসার বিষয়টিকেও সন্দেহের চোখে দেখছেন তদন্তকারীরা। কেন এত টাকা এসেছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। হীরাকে তৃতীয় দফায় রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে তাঁর কাছ থেকে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া যাচ্ছে বলে তদন্তকারী সংস্থার দাবি। পুলিশ ও গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, ঢাকা মহানগর বিএনপির সদস্যসচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেলের সঙ্গে কামাল হোসেনের ছিল সুসম্পর্ক। কুনিও হোশি হত্যাকাণ্ডের দুই দিন আগে একাধিকবার কামাল ও সোহেলের মধ্যে মোবাইল ফোনে কথোপকথন হয়েছে। তাঁদের সেই কথোপকথনের অডিও রেকর্ড একটি গোয়েন্দা সংস্থার কাছে আছে। তবে এ ঘটনায় হাবিব-উন-নবী খান সোহেলের ছোট ভাই রাশেদ-উন-নবী বিপ্লবের সংশ্লিষ্টতা এখনো পাওয়া যায়নি। সে কারণেই তাঁকে আর রিমান্ডে নেয়নি পুলিশ। সূত্র মতে, আরো তথ্যের আশায় রংপুর জেলা বিএনপি ও জামায়াতের দেড় শতাধিক নেতার মোবাইল ফোন ট্র্যাকিং করছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। এতেও নানা তথ্য পাওয়া গেছে। তদন্তকারী সংস্থাগুলো তথ্যগুলো যাচাই-বাছাই করছে। এ হত্যা মামলার তদন্ত কার্যক্রম মনিটরিংয়ে নিয়োজিত পুলিশ সদর দপ্তরের এক এআইজি জানান, কুনিও হোশি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার একটি ও পশ্চিমা একটি দেশের গোয়েন্দা সংস্থার ইন্ধন ছিল বলে তদন্তকারী সংস্থাগুলোর কাছে তথ্য এসেছে। ওই দুটি বিদেশি সংস্থার সঙ্গে বিএনপি ও জামায়াতের শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন নেতার যোগাযোগ আছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই পুলিশ কর্মকর্তা প্রতিবেদককে বলেন, এই হত্যাকাণ্ড কোনো জঙ্গি সংগঠনের কাজ নয়- এ বিষয়ে নিশ্চিত। উদ্দেশ্যমূলকভাবেই জঙ্গিদের বিষয়টি প্রচার করা হয়েছে। তদন্তের অগ্রগতি প্রসঙ্গে পুলিশের রংপুর রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক হুমায়ুন কবির গতকাল শনিবার এই প্রতিবেদককে বলেন, 'জাপানি নাগরিক কুনিও হোশি হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটন এখন সময়ের ব্যাপার। কারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে সে তথ্যও আমরা পেয়েছি। যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের কাছ থেকেও পাওয়া যাচ্ছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। আশা করি, অল্প সময়ের মধ্যে হত্যাকারীদের মুখোশ উন্মোচন করা যাবে।' তাঁর দাবি, অহেতুক কাউকে হয়রানি করা হচ্ছে না। পরিবার ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, হত্যাকাণ্ডের পর দিনই মৎস্যজীবী দলের নেতা কামাল হোসেনকে ধরে নিয়ে গেছে একটি সংস্থা। তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটিও বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, কামালকে প্রতিনিয়ত জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তাঁকে দিয়ে হাবিব-উন-নবী খান সোহেলকে কবজায় আনার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। এ কারণেই কামালকে আটক রাখার বিষয়টি স্বীকার করা হচ্ছে না। সময় হলেই কামালসহ অন্যদের জনগণের সামনে হাজির করা হবে। এদিকে মৎস্যজীবী দলের নেতা কামাল হোসেনের মা হাসিনা বেগম বলেছেন, 'কামালসহ তিন ভাইয়ের কোনো সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। হীরার স্ত্রী সুলতানা বেগমকে আটক করে নিয়ে গেছে পুলিশ। তাঁকে গ্রেপ্তারও করছে না আবার ছেড়েও দিচ্ছে না। আমার সন্তানেরা এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিল না' বলে তিনি দাবি করেন। ৮৯ লাখ টাকা নিয়ে সন্দেহ : মাসখানেক আগে কানাডা ও লন্ডন থেকে ব্যবসায়ী হুমায়ুন কবির হীরার নামে মানি এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে দুই দফায় ৮৯ লাখ টাকা আসে। প্রথম দফায় কানাডা থেকে আসে ৫২ লাখ টাকা। পরে লন্ডন থেকে আসে ৩৭ লাখ টাকা। এত টাকা তুলতে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন প্রয়োজন হলে বিপাকে পড়ে যান হীরা। তিনি ৯ লাখ টাকা তুলতে পেরেছেন। এ প্রসঙ্গে এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, এত টাকা কেন এসেছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। হীরাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তিনি বলছেন, ব্যবসায়িক কাজের জন্য তাঁর দুই আত্মীয় টাকাগুলো পাঠিয়েছেন। পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রের দাবি, হীরার মোবাইল ফোনের কললিস্ট পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে পুলিশের সবকটি সংস্থা। তাতে বেরিয়ে আসে স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা হাবিব-উন-নবী খান সোহেল ও জেলা মৎস্যজীবী দলের আহ্বায়ক কামাল হোসেনের নাম। তাঁদের মধ্যে কতবার কথা হয়েছে- তাও উদ্ঘাটন করা হয়। তাঁদের কথোপকথনের রেকর্ড তদন্তকারী সংস্থার নিয়ন্ত্রণে নেওয়া হয়। গত ৩ অক্টোবর রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার কাচুআলুটারী গ্রামে খুন হন জাপানের নাগরিক কুনিও হোশি। এর আগে ঢাকার গুলশানে খুন হন ইতালির নাগরিক সিজারে তাভেল্লা। এ দুটি ঘটনায় দেশ-বিদেশে তোলপাড় শুরু হয়। হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটন করতে মাঠে নামে র‌্যাব-পুলিশের পাশাপাশি একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা। রংপুরে হোশি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পুলিশ সদর দপ্তরের একটি চৌকস টিম রংপুরে গিয়ে রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা চালায়।-কালের কণ্ঠ ১৮ অক্টোবর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এস.এ.সুমন/একে

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে