রবিবার, ১৮ অক্টোবর, ২০১৫, ১১:১৯:০২

একটি ফুল ও ছোটদের প্রেম-ভালোবাসা

 একটি ফুল ও ছোটদের প্রেম-ভালোবাসা

ড. সরদার এম. আনিছুর রহমান : এইতো ক’দিন আগে আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা সিএনএন একটি ছবি প্রকাশ করেছে। ছবিটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গণমাধ্যমে গুরুত্বের সাথে প্রকাশিত হয়। ছবিটিতে দেখা যায়, স্পেনের ভালডেনোসেডার একটি সমাধিতে ৫-৬ বছর বয়সী ছোট একটি ছেলে একটি ছোট মেয়েকে ফুল দিচ্ছে। এসময় আরেকটি ছোট মেয়েকে মন খারাপ করে বেরিয়ে যেতে দেখা যায়। জানি না, ওই তিন শিশুর প্রেক্ষাপট কী ছিল, তবে সেখানেও যে প্রেম-ভালোবাসার একটা কাহিনী নিহিত তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আমরাও শিশুদের পছন্দ করি, ভালোবাসি। ইসলামেও শিশুদের ভালোবাসা সুন্নাত। অন্য ধর্মেও শিশুদের ভালোবাসার কথা বলা আছে। আল্লাহর রাসূল এবং অন্য ধর্মের মনিষীরাও শিশুদের ভালোবাসতেন। শিশুরা দেখতে সুন্দর, তাদের হাসি-কান্না, কথা-বার্তা, চলাফেরা, খেলাধূলা সব কিছুতেই যেন সৌন্দর্য্যের অপূর্ব সমাহার। সবচেয়ে বেশি সুন্দর শিশুদের ভালোবাসা। যেখানে নেই কোনো খাঁত, নেই কোনো কপটতা। ওই ভালোবাসায় যেন পবিত্রতার ছোঁয়া। প্রসঙ্গত, একটি শিশু জন্মের কিছুদিন পর যখন তার বাবা-মা, ভাই-বোন, দাদা-দাদি, নানা-নানি কিংবা অন্য কোনো স্বজনকে সম্বোধন করে তখন যেন খুশিতে সবার হৃদয় বিগলিত হয়ে যায়। ছোট কচি খোকার এমন সম্বোধনের চেয়ে ভালোলাগার আর কী থাকতে পারে!তাই কে না ভালোবাসতে চায় শিশুদের! তবে আমরা যে শিশুদের ভালোবাসি সে কথা কিন্তু বিভিন্নভাবে ফুটিয়ে তুলি। আর সব সময় বড়দের প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে ঘাটাঘাটি করি। আর তাই নাটক-সিনেমা, গল্প-কবিতায় সর্বত্রই বড়দের তথা তরুণ-তরুণীদের প্রেম-ভালোবাসার ছাপ। এতে সহজেই প্রশ্ন জাগে, তাহলে প্রেম-ভালোবাসা কি শুধু বড়দেরই সম্পত্তি? ছোটরা শুধু বড়দের কাছ থেকে ভালোবাসা পেয়ে থাকে, তাদের মাঝে এসব কোনো কিছু নেই? প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। মনিষীরা অনেক কথাই বলেছেন। এর মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, আনন্দকে ভাগ করলে দুটি জিনিস পাওয়া যায়; একটি হচ্ছে জ্ঞান এবং অপরটি হচ্ছে প্রেম। আইরিশ অভিনেত্রী ম্যালানি ক্লার্ক বলেন, ‘আমরা কোনোভাবেই ভালোবাসার ওপর মূল্য নির্ধারণ করতে পারি না, কিন্তু ভালোবাসার জন্য দরকারি সব উপকরণের ওপর মূল্য নির্ধারণ করতেই হবে। অস্কার ওয়াইল্ড বলেন, ‘আমি সেই নারীকে ভালোবাসি যার অতীত আছে আর সেই পুরুষকে ভালোবাসি যার ভবিষ্যৎ আছে।’ সমরেশ মজুমদারের ভাষায়, ‘ছেলেরা ভালোবাসার অভিনয় করতে করতে যে কখন সত্যি সত্যি ভালোবেসে ফেলে তারা তা নিজেও জানে না। মেয়েরা সত্যিকার ভালোবাসতে বাসতে যে কখন অভিনয় শুরু করে তারা তা নিজেরাও জানে না।’ জর্জ বার্নাডশ বলেন, ‘ভালোবাসার ব্যাপারে পুরুষরা চিরকালই শিকার, আর মেয়েরা শিকারী, একজন শিকারী যেমন শিকারের জন্য তার বন্দুককে ভালোবাসে, একজন মেয়ে মানুষও তেমনি সৃষ্টির প্রয়োজনে পুরুষকে ভালোবাসে। এ ভালোবাসা বন্দুকের প্রতি শিকারীর প্রেম-ভালোবাসার সঙ্গেই একমাত্র তুলনীয়।’ মেরী বেকার হার্ডির মতে ‘যে গভীরভাবে ভালোবাসতে জানে বয়স তার কাছে কোন বাধা নয়।’ ডেল কার্নেগীর ভাষায়, ‘পৃথিবীতে ভালোবাসার একটি মাত্র উপায় আছে, সেটা হলো প্রতিদান পাওয়ার আশা না করে শুধু ভালোবেসে যাওয়া।’ কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায়- ‘যে ভালোবাসা দুজনকে দুদিক থেকে আকর্ষণ করে মিলিয়ে দেয়, সেটা ভালোবাসা নয়, সেটা অন্য কিছু বা মোহ আর কামনা।’ অনেকের মতে, দু'জনের সখ্যতার আরেক নাম ভালোবাসা। আর এই ভালোবাসা মানুষের জন্মগত প্রবণতা। সব বয়সের সব মানুষের মাঝেই আছে। সন্তানের প্রতি মাতার ভালোবাসা, পিতার ভালোবাসা, মাতা-পিতার প্রতি সন্তানের ভএলাবাসা, ভাইয়ের প্রতি ভাইয়ের ভারোবাসা, ভাইয়ের প্রতি বোনের ভালোবাসা, বোনের প্রতি ভাইয়ের ভালোবাসা, বোনের প্রতি বোনের ভালোবাসা, মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা। প্রতিটি ভালোবাসাই আলাদা স্বকীয়তার স্বাক্ষ্য বহন করে। আবার তরুণ-তরুণীর ভালোবাসা, স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসা ইত্যাদি। তাই বলা হয়ে থাকে, প্রেম-ভালোবাসা মানুষের চিরন্তণ প্রবণতা। ফলে প্রেম যে শুধুই বড়দের বিষয় না তা সহজেই বলা যায়। প্রসঙ্গত, ছোটকালে আমরাও প্রেম-ভালোবাসার বাইরে ছিলাম না। আজও স্মরণে আছে- আমার এক মামাতো বোন ছিল, তার আর আমার বয়সের ব্যবধান মাত্র ৭দিনের। ফলে সেই একেবারে ছোটকাল থেকেই লেখাপড়া, ঘুরাফেরা, খেলাধূলা, খাওয়া-ধাওয়া, ঘুমানো অর্থাৎ সব কিছুতেই আমরা পরস্পরের সাথী ছিলাম। একে অপরকে ছাড়া যেন আমাদের এক মুহূর্তও চলতো না। আমাদের এই সম্পর্ক দেখে অন্যদের ঈর্ষা হতো। এছাড়া স্কুলজীবনেও সহপাঠীদের পরস্পরকে অনেক ভালোবেসেছি। ক্লাসের ফাঁকে অনেক ঘুরাফেরা ও আড্ডা দিয়েছি। খেলাধূলার সাথি হয়েছি, পড়ার সাথী হয়েছি। কই কোনো দিন তো অন্য কোনো কিছু ভাবিনি, অসততা ও অপবিত্রতা আমাদের স্পর্শ করেনি কিংবা কারো পক্ষ থেকে কোনো আপত্তিও উঠেনি। কিন্তু আজকাল প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে কী হচ্ছে? আর সেসব প্রেম-ভালোবাসার অবাধ প্রচার-প্রসার শিশুদের উপরও এর প্রভাব পড়ছে। এইতো কিছুদিন আগে একটা নিউজ পড়ে রীতিমত ভীমরি খেলাম। রাজধানীর 'রায়েরবাজারে প্রেমঘটিত কারণে পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রীর আত্মহত্যা।' ‘প্রেমঘটিত কারণে দিনাজপুরে ৫ম শ্রেণীর ছাত্রীর আত্মহত্যা’। শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও, কেন যেন এমনটাই বাস্তব হচ্ছে প্রতিদিন। একটু একটু করে পাল্টে যাচ্ছে আমাদের চারপাশটা। প্রেমের নাম করে অনৈতিক বাণিজ্যিকরণের প্রভাব পড়ছে শিশুদের উপরও। এর দায় কাদের? শহর তো বটেই, পাল্টে যাচ্ছে আমাদের গ্রামবাংলার চিত্রও। আমাদের গ্রাম একেবারে অজপাড়া গাঁ ছিল। কয়েক বছর আগেও যেখানে বিদ্যুতের আলো ছিল না। কিন্তু আজ সেই গ্রামেই ঘরে ঘরে টেলিভিশন, হয়েছে বিউটিপারলার এবং আমাদের বোন-ভাবী, খালা-ফুফুরা সেখানে গিয়ে সিরিয়ালের নায়িকাদের মত সাজগোজ করছে। চলাফেরায় তাদের মধ্যে এখন আধুনিকতা। আমার ই ভীমরি খাবার যোগাড়! এর সাথে সাথে আমাদের পুরনো কিছু সংস্কৃতির সমাধি! এবার শহরে আসুন। আমার মনে হয়না ঢাকাতে এমন কোন মহিলা বা মেয়ে আছে যারা ইন্ডিয়ান সিরিয়ালের ভক্ত নয়। আমি নিজেও স্কুলের সামনে মহিলাদের এমন সিরিয়াল নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা শুনেছি। এর ফলে আমাদের ছেলেমেয়েরাও আলট্রা মডার্ন হয়ে উঠছে এবং ইন্ডিয়ান প্রতিটা দিবস, জাতীয়দিন, পূজা, ফ্যাশান সম্পর্কে রীতিমত বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠছে। আমিও কয়েকটি সিরিয়াল দেখার চেষ্টা করেছি। আশ্চর্য হলেও সত্য যে, প্রতিটা সিরিয়াল এর কাঠামো এবং কাহিনী খুবই কাছাকাছি। পরকীয়া এবং অমুলক সন্দেহ হলো এসব সিরিয়ালের হট কেক। আজকাল পত্রিকাগুলোতে স্বামীর হাতে স্ত্রী, স্ত্রীর হাতে স্বামী, ছেলেমেয়ের হাতে পিতামাতা, ভাইবোন খুন হবার মেলা খবর দেখা যায়। আমি স্বীকার করি যে, সমস্ত কিছুই সিরিয়ালের জন্য হয় না। কিন্তু বাংলাদেশে পরকীয়াকে ব্যাধি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে কিন্তু এই সিরিয়াল। সবার মনে সন্দেহ ঢুকিয়েছে এই সিরিয়াল। নৈতিকতার সর্বনাশ করেছে এই সিরিয়াল। কথায় কথায় ডিভোর্স, সম্পর্ক ভাঙাও সিরিয়ালের অবদান। পারিবারিক হিংসাও এর ই সৃষ্টি। কেউ মানুক আর না মানুক, এগুলো সত্যি ও বাস্ত। আমাদের দেশের চ্যানেলগুলোর ব্যর্থতাও এই বিপর্যয়ের জন্য দায়ী। টি ভি চ্যানেলগুলো অতি মাত্রায় ব্যবসায়ী আচরন করে। বাঙলা চ্যানেল দেখতে বসলেই বিরক্ত লাগে। বিজ্ঞাপন আর ফালতু কাহিনীর নাটক দিয়ে চ্যানেল গুলো ভর্তি। খবর আর টক শোগুলো না থাকলে কি হত বলা মুশকিল। ইন্ডিয়ানদের চেয়ে আমাদের মেধা মনন কম নেই। তবে কেন এই হাল! শিশুরা বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি ভুলে যাচ্ছিলো বলে বিভিন্ন কার্টুন চ্যানেল বন্ধ করে দেয়া হলো। কিন্তু তাদের জন্য কি বিকল্প বিনোদন ব্যবস্থা হয়েছে? সেই তো কম্পিউটার গেম ই ভরসা। আজকাল তো বাচ্চারা মাঠেও খেলার সুযোগ পায়না পড়ালেখার প্রতিযোগিতা আর মাঠের অপ্রতুলতার জন্য। তাদের শৈশবের কি কোন মূল্যই নেই ! দোষ কি খালি শিশুদের। মা-বোনরাই তো তাদের পাশে বসিয়ে ওইসব আজগুবি পরকিয়ার সিরিয়াল দেখাচ্ছেন। ঈদ-পূজার বাজারে খালি ইন্ডিয়ান পোশাক (নামও ইন্ডিয়ান সিরিয়াল, মুভির নামে!)। সব কিছুই ইন্ডিয়ান। আবার কিছু হলেই ইন্ডিয়ানদের দোষ। তারা আমাদের বাজার নিয়ে যাচ্ছে। আরে, আমরাই তো ডেকে ডেকে তাদের দিচ্ছি! কোথায় প্রেমের কচকচানি নেই ? নাটক, শিল্প-সাহিত্য, বিজ্ঞাপন, গান, সিনেমা সব জায়গায় প্রেম। ছোটবেলা থেকেই যখন একটা শিশু এসব দেখে বড় হতে থাকে, তখন এই প্রেম জিনিসটার প্রতি প্রবল আগ্রহ জন্মায়। তাই দেখা যাচ্ছে টিনএজের শুরুর দিকেই বেশীরভাগ ছেলেমেয়ে জড়িয়ে পড়ছে প্রেমে। বয়ঃসন্ধির সময়টা এমনিতেই সবার জন্য একটি সঙ্কটকাল। তাই প্রেম ঘটিত কারণে অতি আবেগের বশবর্তী হয়ে তারা আত্মহত্যার মত কাজও করে ফেলছে। এর পেছনে যে জিনিসটা বেশি কাজ করছে, সেটা হলো টিভি চ্যানেলগুলো। শিশুদের জন্য পর্যাপ্ত টিভি চ্যানেল না থাকায়, প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য নির্মিত অনুষ্ঠানগুলো দেখতে হচ্ছে শিশুদের। যার ফলে শিশুদের মনোজগতে এই বিষয়গুলো বেশী আগ্রহ তৈরী করছে। অবাক লাগে, যখন দেখি শিশুদের জন্য নির্মিত রিয়েলিটি শোগুলোতে শিশুদের দিয়ে বড়দের গান গাওয়ানো হচ্ছে, প্রাপ্তবয়স্কদের গানে শিশুদের নাচানো হয়। এভাবেই ধীরে ধীরে নষ্ট করে দেয়া হচ্ছে শিশুদের মনোজগতকে। আরেকটা বিষয় মোবাইল-ইন্টারনেট। যেটার ক্ষতিকর প্রভাবের শিকার হয় কিশোরীরা। বেশীরভাগ বাবা-মাই এখন প্রাইমারী স্কুলে থাকা অবস্থাতেই শিশুদের হাতে মোবাইল তুলে দিচ্ছেন। যার ফলে মোবাইলের মাধ্যমে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছে অল্প বয়সেই। এ ক্ষেত্রে সমাধান কি? তা নিয়ে আমাদের ভাববার সময় এসেছে। আমাদের রাষ্ট্রের হর্তাকর্তারা শিশু অধিকার নিয়ে অনেক গলাবাজিই করেন। কিন্তু তারা কি শিশুবান্ধব পরিবেশ নিয়ে একটু কখনো ভেবে দেখেছেন? সবশেষে, এ দেশের শিশুরা বেড়ে উঠুক শিশুবান্ধব পরিবেশে। সুস্থ সংস্কৃতি অর সুস্থ মননের মধ্যদিয়ে বেড়ে উঠুক। আর এক্ষেত্রে রাষ্ট্র এবং অভিভাবকদের সচেতনতাই পারে শিশুদের একটি সুন্দর পরিবেশ উপহার দিতে। লেখক: শিক্ষা ও সমাজ বিষয়ক গবেষক এবং কলাম লেখক। ই-মেইল:[email protected] (এ লেখার জন্য এমটিনিউজ২৪ডটকমের সম্পাদক দায়ী নয়। লেখকের একান্তই মতামত।) ১৮ অক্টোবর,২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এমআর/এআর

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে