সোমবার, ১৯ অক্টোবর, ২০১৫, ০৪:৫৮:০৯

যে কারণে বিএনপির ঘুরে দাঁড়াতে সময় লাগবে

যে কারণে বিএনপির ঘুরে দাঁড়াতে সময় লাগবে

সোহেল হায়দার চৌধুরী : বর্তমানে বাংলাদেশ একটি জটিল ও ক্রান্তিকালময় পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে উল্লেখ করে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা বলেছেন, সরকার মানুষের ইচ্ছার কোনো মূল্য দিচ্ছে না। রাষ্ট্র পরিচালনায় জনগণের কোনো অংশগ্রহণ নেই। মানুষের ভোটাধিকার নেই, জীবনের মূল্য নেই। সরকার একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। এ থেকে বেরিয়ে আসা সময়ের দাবি। তিনি বলেন, প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে বিএনপির আন্দোলন দুর্বল। তবে শেষ পর্যন্ত বিএনপি জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে। হয়তো ঘুরে দাঁড়াতে একটু সময় লাগবে। যুক্তরাষ্ট্রের নিজ বাসভবনে ১১ অক্টোবর এই প্রতিবেদককের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় এসব কথা বলেন অবিভক্ত ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকা। কিডনি ক্যান্সারে আক্রান্ত সাদেক হোসেন খোকা ২০১৪ সালের ২৪ মে থেকে চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। চিকিৎসকের নির্দেশনা মতে তাকে একটানা ৩ বছর চিকিৎসাধীন থাকতে হবে। পরবর্তী পরিস্থিতি নির্ভর করছে চিকিৎসার ধারাবাহিকতার ওপর। এখন তাকে প্রতি ৮ সপ্তাহ পরপর চেকআপ করাতে হয়। শেষ পর্যন্ত এ অবস্থা থেকে মুক্তি মিলবে কিনা তা-ও জানা নেই। তবুও চেষ্টা চলছে। তার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন স্ত্রী ও কন্যা। দুই ছেলের মধ্যে বড় ছেলে ঢাকায় রয়েছেন, আর ছোট ছেলে লন্ডনে আছেন। দেশের সামগ্রিক রাজনীতি, বিএনপির আন্দোলন ও রাজনৈতিক অবস্থা, জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সখ্য, বিগত নির্বাচন, ঢাকা সিটি কর্পোরেশন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নাগরিক ঐক্য নেতা মাহমুদুর রহমান মান্নার সঙ্গে টেলি কথোপকথনসহ প্রাসঙ্গিক সব বিষয়ে খোলামেলা কথা বলেন দেশের রাজপথ কাঁপানো এই নেতা। ক্যান্সারাক্রান্ত হলেও মনোবল এখনো চাঙ্গা। চিকিৎসার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় কিছু শারীরিক সমস্যা দেখা দিলেও সেটা নিয়ে ভাবছেন না। দেশের সামগ্রিক রাজনীতি সম্পর্কে জানতে চাইলে বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ নেতা সাদেক হোসেন খোকা বলেন, দেশে এখন কোনো রাজনীতি নেই। ক্ষমতাসীন পক্ষ কাউকে রাজনীতি করার সুযোগ দিচ্ছে না। কারো মতের কোনো তোয়াক্কা করছে না। তিনি বলেন, বর্তমান সরকার নিয়মতান্ত্রিক কোনো গণতান্ত্রিক সরকার নয়। এরা হলো দখলদার সরকার। এ ধরনের সরকার সবকিছু শক্তি দিয়ে করতে চায়। ফলে দেশের রাজনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। জনজীবন নিরাপত্তাহীন হয়ে উঠছে। সরকারের এমন অবস্থা হলে বিএনপি আন্দোলন করে সাফল্য পাচ্ছে না কেন জানতে চাইলে সাদেক হোসেন খোকা বলেন, নানা জটিলতার মধ্যেও বিএনপি নেতাকর্মীদের একাংশ পরিস্থিতি মোকাবিলা করে দলকে টিকিয়ে রেখেছে। দলের নেতাকর্মীদের কেউ জেলে, কেউ পলাতক। সরকার চরম দমন-পীড়ন চালাচ্ছে দলটির নেতাকর্মীদের ওপর। এ অবস্থায়ও বিএনপি এগিয়ে চলেছে ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণ করে। তিনি বলেন, প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে বিএনপির আন্দোলন দুর্বল মনে হতে পারে। তবে শেষ পর্যন্ত বিএনপি জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে। বর্তমানে বিএনপির আন্দোলন যেভাবে চলছে তাতে দলটি কতটা ঘুরে দাঁড়াতে পারবে জানতে চাইলে সাদেক হোসেন বলেন, বিএনপি শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হবে। হয়তো ঘুরে দাঁড়াতে একটু সময় লাগবে। সরকারের অত্যাচার-নির্যাতনের জন্য বিএনপি নেতাকর্মীরা আতঙ্কে আছেন। তবে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় কোনো স্বৈরাচারী বা জনবিচ্ছিন্ন সরকার বেশি দিন থাকতে পারে না। এ সরকারকেও বিদায় নিতে হবে জনরোষের মুখে। চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ভিন্ন ভিন্ন বলয়ের কারণে বিএনপির রাজনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এমনটি যারা বলছেন তাদের সঙ্গে একমত নন সাদেক হোসেন খোকা। তিনি বলেন, বিএনপির দুই প্রধান নেতা হলেন খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান। তারা সাংগঠনিক কাঠামো ও গঠনতান্ত্রিক ক্ষমতাকে মূল্যায়ন করে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। এক্ষেত্রে কোনো বলয় নেই। এমনটি যারা বলেন, তারা বিএনপিকে দুর্বল করার অপচেষ্টা করে থাকেন। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ না নেয়া বা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমন্ত্রণে খালেদা জিয়ার সাড়া না দেয়া বিএনপির ভুল ছিল না বলে মনে করেন প্রবাসী সাদেক হোসেন খোকা। তিনি বলেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে সিপিবি, বিকল্পধারা, ২০ দলের শরিক, কাদের সিদ্দিকীর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, আ স ম রবের জাসদসহ অনেক দলই অংশ নেয়নি। এরশাদও এ নির্বাচনে অংশ নেননি। ১৫৪টি সংসদীয় আসনে কোনো প্রার্থী ছিল না। এটা খালেদা জিয়ার বিজয়। এর মাধ্যমে বিএনপির নির্বাচনে না যাওয়ার যৌক্তিকতা প্রমাণিত হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক বা নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় দাবি করে সাদেক হোসেন বলেন, নির্বাচনকালে এমন একটা কর্তৃপক্ষ থাকবে যার অধীনে প্রতিদ্বন্দ্বী সবাই সমান সুযোগ পাবে। এ ধরনের নির্বাচনের জন্য যে ধরনের সরকারই হোক তার প্রয়োজনীয়তা আছে। দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় সেটা বিগত সংসদ, সিটি কর্পোরেশন ও উপজেলা নির্বাচনে প্রমাণ হয়েছে। তবে তত্ত্বাবধায়ক বা নিরপেক্ষ সরকারের বাড়াবাড়ি বন্ধে আইন-কানুন থাকতে পারে বলে মনে করেন তিনি। বিজ্ঞ রাজনীতিবিদ সাদেক হোসেন খোকার মতে, দেশ ভবিষ্যতে নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়বে। তিনি বলেন, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সংসদ নির্বাচন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় নেতৃত্ব সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এর জন্য বিএনপি আওয়ামী লীগ সবাই দায়ী। পার্লামেন্টে ব্যবসায়ী বা গজিয়ে ওঠা রাজনীতিবিদদের নিয়ে দলগুলোর মাতামাতি রাজনীতিকে রাজনীতিহীন করে তুলছে। এর মাশুল দিতে হবে মূল ধারার রাজনৈতিক দলগুলোকে। নাগরিক ঐক্য নেতা মাহমুদুর রহমান মান্নার সঙ্গে টেলি কথোপকথন দোষের নয় দাবি করে অভিযুক্ত সাদেক হোসেন খোকা বলেন, আমার সঙ্গে মান্নার টেলিফোন আলাপ ড্রয়িংরুম গসিপের মতো। সে সময় আন্দোলন ও এর গতি-প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এর অন্য কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। একই লক্ষ্যে সংগ্রামরত একজন রাজনীতিবিদের সঙ্গে আরেকজন রাজনীতিবিদের কথা বলা দোষের কিছু নয়। বরং এটি নিয়ে সরকারের রাজনীতি করাটা শিষ্টাচার বহির্ভূত। তিনি বলেন, মান্না একজন পরীক্ষিত নেতা। জনগণের পক্ষের মানুষ। তিনি সরকারের একতরফা নির্বাচনের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। জনমত উপেক্ষা করে এ সরকার যেভাবে ক্ষমতা দখল করেছে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে মান্নার নির্যাতনের শিকার হওয়া গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধারাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সখ্য মুক্তিযোদ্ধা সাদেক হোসেন খোকাকে কতটা কষ্ট দেয় জানতে চাইলে বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের এই নেতা বলেন, জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সখ্য খুব একটা ভালো লাগে না। তার পরও বলতে হয়, দুই দলের ঐক্যটা কৌশলগত। এটা হলো ভোটের রাজনীতির ঐক্য। তিনি বলেন, বিএনপি ও জামায়াতের আদর্শ ভিন্ন। দুটি দলই ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান থেকে রাজনীতি করছে। যদি এক আদর্শ হতো তাহলে অনেক আগেই দল দুটি একে অপরের মাঝে বিলীন হয়ে যেত। তাছাড়া জামায়াতের ’৭১ সালের ভূমিকা আর এখনকার অবস্থা এক নয়। দলটি এখন গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে কনট্রিবিউট করতে চায়। খোকা বলেন, জামায়াতের সঙ্গে শুধু বিএনপি নয়, আওয়ামী লীগেরও মিতালী ছিল। অথচ এখন আওয়ামী লীগ এটা নিয়ে সমালোচনা করে। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে কতটা স্বস্তি বোধ করেন জানতে চাইলে বিএনপি নেতা খোকা বলেন, শুধু জামায়াত কেন যত দলে যুদ্ধাপরাধী আছে তার বিচার হওয়া উচিত। তবে এ বিচার রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে হওয়া উচিত নয়। আমি ও বিএনপি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই। সে বিচার হতে হবে স্বচ্ছতার ভিত্তিতে। তিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ব্যক্তিগত আনন্দের বিষয় নয়। এ নিয়ে আমার কোনো বক্তব্য নেই। তবে এ বিচার আরো আগে হওয়া উচিত ছিল। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনেকে দুই ভাগ করায় নাগরিক সেবার মান কতটা বেড়েছে জানতে চাইলে অবিভক্ত সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন বলেন, ঢাকা সিটি কর্পোরেশনকে বিভক্ত করা ঠিক হয়নি। এটা অযৌক্তিক, ঢাকায় বসবাসকারী কেউ এমনটি চাননি। ঢাকা দেশের একটি রাজধানী শহর। এর প্রশাসনও একটি থাকা উচিত। তবে রাজধানীবাসীর জীবনমান উন্নয়নে সিটি কর্পোরেশনকে আরো ক্ষমতা দেয়া উচিত। ওয়াসা, রাজউক, ট্রাফিক বিভাগ সিটি কর্পোরেশনের অধীনে আনা প্রয়োজন। খোকার মতে, সিটি কর্পোরেশনের কর্তৃত্ব সম্প্রসারণ করা এখন সময়ের দাবি। তিনি বলেন, সিটি কর্পোরেশনের নিয়ন্ত্রণ স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীনে না রেখে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা উচিত। বিএনপির ক্ষমতাকালে দেশ বর্তমান সরকারের চেয়ে ভালো ছিল মন্তব্য করে সাদেক হোসেন খোকা বলেন, কিছু সমস্যা-সংকট থাকলেও জনগণ এতটা নিরাপত্তাহীন ছিল না। আর বর্তমান সরকার মারমুখী। তারা মনে করছে চিরদিনের জন্য বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণ তাদের কাছে থাকবে। এ থেকে উত্তরণে জনতাকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। কবে রাজনীতির মাঠে আবার সরব হয়ে উঠতে পারবেন এমনটি জানতে চাইলে খোকা বলেন, জানি না। শেষ পর্যন্ত নিয়তিতে কি আছে তা তো আমার জানা নেই। বয়স হয়েছে। অসুখ ধরেছে। এর শেষ কোথায় তা আমার জানা নেই। তাই নিয়তির অবশেষও আমি বলতে পারব না। তিনি বলেন, দেশের কথা সব সময় মনে পড়ে। নেতাকর্মীদের কথা ভেবে মন খারাপ হয়। কিন্তু কিছু করার নেই। অসুস্থ আমি ইচ্ছা থাকলেও কিছু করতে পারছি না।-মানবকণ্ঠ ১৯ অক্টোবর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এস.এ.সুমন/একে

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে