মঙ্গলবার, ২০ অক্টোবর, ২০১৫, ০২:১২:৩৮

কেন দেশে ফিরছেন না খালেদা জিয়া?

কেন দেশে ফিরছেন না খালেদা জিয়া?

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী : লন্ডনের একটি বাংলা সাপ্তাহিক খবর দিয়েছে, 'এ মাসে (অক্টোবর) বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার দেশে ফেরার সম্ভাবনা কম।' পত্রিকাটি দলীয় সূত্রের বরাত দিয়ে এ খবর দিয়েছে। আগে বলা হয়েছিল, তিনি ১৬ অক্টোবর দেশে ফিরবেন। তারপর বলা হয় ২১ অক্টোবর। এখন দলীয় সূত্রেই জানা গেছে, ২১ অক্টোবরেও তাঁর দেশে ফেরার সম্ভাবনা কম। তিনি চিকিৎসা ও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মিলিত হতে লন্ডনে এসেছেন এবং নির্দিষ্ট তারিখেই দেশে ফিরে যাবেন বলা হয়েছিল। কারণ হিসেবে বলা হয়েছিল, বিএনপিকে বর্তমান কোমরভাঙা অবস্থা থেকে উদ্ধার করার জন্য সংগঠন পুনর্গঠন ও নতুন আন্দোলন শুরু করার প্রস্তুতির জন্যও তিনি বিদেশে অবস্থান দীর্ঘ করবেন না। লন্ডনে খালেদা জিয়া তাঁর হাঁটু ডাক্তারকে দেখিয়েছেন। তাঁর এক চোখে অপারেশন হয়ে গেছে। অপর চোখে এবার অপারেশন করাবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তারেক রহমান ও বিদেশে অবস্থানরত দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গেও তাঁর শলাপরামর্শ শেষ হয়েছে। এ অবস্থায় তিনি দল পুনর্গঠনের জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য দেশে ফিরে যাওয়া কেন বিলম্বিত করছেন- এ প্রশ্ন দলটির নেতাকর্মীদের মধ্যেও দেখা দিয়েছে। লন্ডনে আসার পর ঈদুল আজহার দিন পূর্ব লন্ডনের বার্কিংসাইড এলাকায় দ্য লেক ভিউর কনফারেন্স হলে সবার সঙ্গে তাঁর ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়ের নামে একটি সভা করা হয়। এ সভা চূড়ান্ত গোলমালের জন্য ভালোভাবে শেষ হতে পারেনি। খালেদা জিয়া প্রচণ্ড হট্টগোলের মধ্যে যে বক্তব্য দেন, তা পবিত্র ঈদের দিনের শুভেচ্ছা বিনিময়ের বদলে হয়ে দাঁড়ায় শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারের কঠোর সমালোচনা। এই ঈদ রি-ইউনিয়নের পর লন্ডনে খালেদা জিয়ার আর কোনো প্রকাশ্য রাজনৈতিক তৎপরতা দেখা যায়নি। লন্ডনের কোনো কোনো বাংলা পত্রিকায় তাঁকে নিয়ে গুজবের ঘুড়ি ওড়ানো হচ্ছিল। এ গুজবের সার কথা ছিল, তিনি বিদেশে বিভিন্ন মহলের সঙ্গে অপ্রকাশ্য যোগাযোগ ও আলোচনায় ব্যস্ত। তিনি সহসা দেশে ফিরছেন না। যাঁরা ঢাকায় বিভিন্ন দৈনিকে প্রকাশিত আমার কলামগুলো দয়া করে পড়েন, তাঁদের স্মরণ থাকতে পারে, আমি এই সময় একটি দৈনিকে প্রকাশিত কলামে লিখেছিলাম, খালেদা জিয়া নির্ধারিত সময়ে দেশে ফিরবেন না। এ ব্যাপারে বিএনপি সূত্র থেকেই দুটি কারণ আমি জেনেছিলাম। খালেদা জিয়া সহসা কেন দেশে ফিরছেন না প্রথম কারণ, দেশে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের মামলাসহ যেসব দুর্নীতির মামলা আদালতে চলছে, তার রায় ঘোষিত হওয়ার সময় সন্নিকটে। খালেদা জিয়া আশঙ্কা করেন, এ রায় তাঁর বিরুদ্ধে যেতে পারে। তিনি এ রায় ও দণ্ড আপাতত এড়ানোর জন্য বিদেশে অবস্থান করতে চান। বিভিন্ন দুর্নীতির মামলার রায় যে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে যাবে, এটা ধরে নিয়ে দলের একজন শুভানুধ্যায়ী ডা. জাফরুল্লাহ বিএনপির সাম্প্রতিক আলোচনা সভায় দলের নেতাকর্মীদের একজন নতুন নেতাকে সাময়িকভাবে নেত্রীর স্থলাভিষিক্ত করার উপদেশ দিয়েছিলেন। দ্বিতীয় কারণ, দু-দুটি ব্যর্থ আন্দোলনের পর দলে তারেক রহমানের মাতব্বরি ও হাইকমান্ডের দুর্বলতায় দলের সাধারণ নেতাকর্মীদের মধ্যে যে গোপন বিক্ষোভ ধূমায়িত হচ্ছে তাকে এ মুহূর্তে মোকাবিলা না করে তারেক রহমানকে তাঁর অবস্থান শক্ত রাখার জন্য সুযোগ ও সময়দান এবং সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য বিদেশিদের সঙ্গে কৌশলে যোগাযোগ স্থাপন। খালেদা জিয়ার সময়মতো দেশে না ফেরার কারণ হিসেবে বিএনপির একটি মহল থেকে একটি গুজব ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। গুজবটি হলো, বিএনপি নেত্রী যাতে সহসা দেশে ফিরতে না পারেন সে জন্য সরকার বাধা সৃষ্টি করতে চায়। গুজবটি সত্য নয় বলেই রায়ে প্রমাণিত হয়েছে। এখন এ গুজবের বদলে আরেকটি নতুন গুজব বাজারে চালু করা হয়েছে। এটি হলো দুজন বিদেশি নাগরিকের সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে বিএনপি নেত্রীকে জড়িত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে বক্তব্য দিয়েছেন, তার প্রতিক্রিয়াতেই বিএনপি নেত্রীর দেশে ফেরা বিলম্বিত হচ্ছে। অবশ্য ঢাকায় বসে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান বলেছেন, 'প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের সঙ্গে তাঁদের চেয়ারপারসনের দেশে ফেরা বা না ফেরার কোনো সম্পর্ক নেই।' তাহলে প্রায় ভেঙে পড়া বিএনপিকে পুনর্গঠন ও নতুন করে আন্দোলনের কর্মসূচি গ্রহণের জরুরি তাগিদে দেশে না ফিরে খালেদা জিয়া কেন বিদেশে বসে কালহরণ করছেন? তাহলে সরকারি দলের এ অভিযোগটাই কি সত্য বলে ধরে নিতে হবে যে 'খালেদা জিয়া আদালতে তাঁর মামলার কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করার জন্যই দেশে ফিরতে চাইছেন না, বরং বিদেশে অবস্থান করে দেশে তিনি রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করতে চান?' অথচ খালেদা জিয়া যখন লন্ডনে আসেন তখন সব মিডিয়াকেই তাঁর দল ঢাকঢোল পিটিয়ে বলেছিল যে শুধু চিকিৎসা ও পারিবারিক মিলন নয়, দল পুনর্গঠন, শক্তিশালী করা ও আন্দোলনের নয়া কর্মসূচি নির্ধারণের লক্ষ্যে পুত্র তারেক রহমান ও দলের অন্যান্যের সঙ্গে আলোচনার জন্যই তিনি লন্ডনে এসেছেন। শিগগিরই তিনি দেশে ফিরে যাবেন এবং বিএনপির নতুন চাঙ্গামূর্তি দেখা যাবে। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, বিএনপি চাঙ্গামূর্তি ধারণ করেনি। লন্ডনে নেত্রীর উপস্থিতিতেও দলের যেমন কোনো তৎপরতা নেই, তেমনি দেশেও বিএনপির ত্রিভঙ্গ অবস্থা। দলের প্রধান কর্মকেন্দ্র নয়াপল্টনের অফিসে বা গুলশানের অফিসে নেতাকর্মীরা কদাচিৎ যায়। দলের মুখপাত্র আসাদুজ্জামান রিপন কালেভদ্রে অফিসে যান এবং কখনো কখনো দায়সারা গোছের একটি বক্তব্য দিয়ে দায়িত্ব শেষ করেন। দলের প্রবীণ নেতারা, যাঁদের অধিকাংশই জেলের বাইরে একেবারেই নিষ্ক্রিয় ও নিশ্চুপ। ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর মতো দলত্যাগী প্রবীণ নেতাদের দলে ফিরিয়ে এনে বিএনপির আধমরা দেহে প্রাণসঞ্চার করা হবে বলে যে জোর গুজব রটেছিল, সে সম্পর্কেও কোনো কথাবার্তা আর নেই। জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক পুনর্নির্ধারণের প্রশ্নটিও স্পষ্ট না হয়ে কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে আছে। মিডিয়ার খবরেই জানা গিয়েছিল, বিএনপি নেত্রী এ মুহূর্তে দেশে না ফিরলেও দল পুনর্গঠন ও নতুন আন্দোলন শুরু করার কর্মসূচি ঠিক করে ফেলেছেন। তিনি নভেম্বর মাস নাগাদ দেশে ফিরবেন, দলের ঘোড়াটিকে তাজা করে তুলবেন এবং আগামী বছরের ৫ জানুয়ারি থেকে সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরু করবেন। কিন্তু সেই সিদ্ধান্তের মাথাতেও ঠাণ্ডা পানি ঢেলেছে একটি খবর। খবরটি হলো দলীয় প্রতীকে ডিসেম্বর মাসে পৌরসভাগুলোর নির্বাচন। বিএনপি কি এ নির্বাচন বয়কট করতে পারবে? পারবে না। তাহলে দলের সাধারণ নেতাকর্মীরাই বিদ্রোহী হবে। দল ভেঙে যাবে। এ অবস্থায় অনুমান করা যায় বিএনপিকে নির্বাচনে যেতে হবে। তাহলে প্রস্তাবিত জানুয়ারি আন্দোলনের কী হবে? নির্বাচন আর আন্দোলন তো পাশাপাশি চলতে পারে না। আর নির্বাচনে যদি অংশ নিতে হয়, তাহলে দলনেত্রীকে এখনই দেশে ফিরে গিয়ে দল গোছাতে হবে। আওয়ামী লীগের প্রতি অসন্তুষ্টির জন্য ভোটদাতারা এসে দলে দলে বিএনপির ভোট বাক্স ব্যালট পেপারে ভরে দেবে- এ আশা সম্ভবত বিএনপির চরম আশাবাদী নেতারাও এখন পোষণ করেন না। এটা জাতীয় সংসদের নির্বাচন নয়। পৌরসভাগুলোর নির্বাচনে প্রার্থী হবে অনেক এবং লড়াইও হবে ফাটাফাটি। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়ার দ্রুত দেশে না ফেরার কোনো সংগত কারণ নেই। কিন্তু তিনি চলতি মাসে দেশে ফিরছেন কি? কিংবা নভেম্বর মাসে? এ সম্পর্কে লন্ডনের বাজারে যে খবরটি চাউর হয়েছে তা হলো, খালেদা জিয়া যে উদ্দেশ্যটি নিয়ে লন্ডনে এসেছেন সেই উদ্দেশ্য পূর্ণ হলেই তিনি যেকোনো দিন, যেকোনো মুহূর্তে দেশে ফিরে যাবেন। তাঁর লন্ডনে আসার কারণ হিসেবে চিকিৎসা, পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মিলন ইত্যাদিসহ যেসব কারণ দেখানো হয়েছে তা 'এহ বাহ্য'। আসল কারণ, বিশেষ বিশেষ দেশের সঙ্গে সবার অগোচরে যোগাযোগ স্থাপন ও তাদের দ্বারা বাংলাদেশের হাসিনা সরকারের ওপর বিএনপির দাবিগুলো মেনে নেওয়ার জন্য জোর চাপ সৃষ্টি। বিদেশিদের দ্বারা এই চাপ সৃষ্টি জোরদার করার লক্ষ্যে সাম্প্রতিক বিদেশি হত্যার পেছনে বিএনপি-জামায়াতের হাত আছে বলে সরকারি দলের নেতারা যে অভিযোগ তুলেছেন তা অনেকে হেসে উড়িয়ে দিচ্ছেন না। লন্ডনের ভারতীয় মহলের একাধিক সূত্রে খবর আরো গুরুতর। লন্ডনে ভারতের বর্তমান ক্ষমতাসীন দল বিজেপির একটি অফিস রয়েছে। এ অফিসের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে দিল্লির বিজেপি হাইকমান্ডের সঙ্গে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালাচ্ছেন বিএনপি নেত্রী। তিনি নাকি বুঝতে পেরেছেন, একমাত্র ভারতের মোদি সরকারকে হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে রাজি করানো গেলেই এ সরকারের ওপর বিদেশি চাপ কার্যকর করা যাবে। ভারতের রাজি হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে আমেরিকা। ভারতকে ডিঙিয়ে আমেরিকা বাংলাদেশে কিছু করতে চায় না এবং তা পারবেও না। সুতরাং মোদি সরকারের মন গলানোর অসাধ্য সাধনে লন্ডনে বসে প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন বিএনপি নেত্রী। তিনি যদি সহসাই দেশে ফিরে যান, তাঁর প্রচেষ্টা হয়তো অনেকটা সফল মনে হতে পারে। আর যদি তাঁর দেশে ফেরা বিলম্বিত হয়, তাহলে বুঝতে হবে বিজেপির সঙ্গে একটা সমঝোতা প্রতিষ্ঠায় বিএনপি এখনো সফল হয়নি। সফল করার চেষ্টা চলছে। একটি ভারতীয় মহলের এ খবর কতটা সঠিক আমি জানি না। তবে কথায় বলে, যা রটে তা কিছুটা ঘটেও বটে। বিএনপি নেত্রী ও তাঁর পুত্র তারেক রহমানের কিছুকাল আগের কার্যকলাপ থেকেই বোঝা যায় ভারতের মোদি সরকারের কাছে নাকে খত দিয়ে হলেও বিএনপি হাসিনা সরকারকে ক্ষমতা থেকে উৎখাতের কাজে সাহায্য চায়। নরেন্দ্র মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর পদে বসতেই তারেক রহমান তাঁকে জ্যাঠাবাবু (আংকেল) সম্বোধন করে অভিনন্দন জানিয়ে চিঠি লিখেছিলেন। বিএনপি ঢাকায় মিষ্টি বিতরণ করেছিল। খালেদা জিয়া মোদির সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য রীতিমতো ধরনা দিয়েছেন। অথচ এর আগে ভারতের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ না করার অসৌজন্যতা দেখিয়েছেন। বিএনপির এই মোদি-ভজনা তখন ব্যর্থ হয়। মোদি সরকার নিজেদের স্বার্থেই হাসিনা সরকারের দিকে সহযোগিতার বাড়িয়ে দেয়। সাম্প্রতিক অতীতের এই ব্যর্থতার কথা ভুলে গিয়ে খালেদা জিয়া যদি বিদেশে বসে আবার বিদেশিদের সহায়তায় দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির চক্রান্ত চালান, তাহলে সম্ভবত আবারও তাঁকে ব্যর্থতা ও হতাশার গ্লানি ভোগ করতে হবে। তিনি যদি লন্ডনের চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে থাকেন, তাহলে দেশের সুস্থ রাজনীতিতে ফিরে আসুন, এটাই আমার কামনা। অসুস্থ ও চক্রান্তের রাজনীতি বিএনপিকে ভবিষ্যতে কোনো দিন আর কোনো সাফল্য এনে দেবে না।-কালের কণ্ঠ ২০ অক্টোবর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এস.এ.সুমন/একে

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে