এস এম এ ফায়েজ : সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নতুন বেতন কাঠামো ঘোষণায় আমলা আর শিক্ষকদের মধ্যে 'বিভাজন' তৈরি করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এস এম এ ফায়েজ। তিনি বলেন, '৮ম পে-স্কেলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য যে বেতন নির্ধারণ করা হয়েছে, তাতে শিক্ষকদের অত্যন্ত ব্যথিত করা হয়েছে। যারা সর্বোচ্চ মেধাবী, পিএইচডি ডিগ্রিধারী এবং আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা প্রকাশ করেছেন, তারাই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন।
নতুন পে-স্কেলে তাদের অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। আমলাদের সঙ্গে শিক্ষকদের বিভাজন তৈরি করা হয়েছে। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। সরকার ৭ম পে-স্কেলের ধারাবাহিকতা অনুসরণ করলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যেত বলে আমি মনে করি।' শনিবার রাতে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় এসব কথা বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা বিজ্ঞানের সাবেক এই অধ্যাপক।
তার মতে, এর আগে সরকার যে ৭ম পে-স্কেল ঘোষণা করেছিল, তা সব শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছেই গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। ওই পে-স্কেলকে সামনে রেখেই ৮ম বেতন কাঠামো ঘোষণা করলে শিক্ষক সমাজসহ কারোরই কোনো সমস্যা হতো না। ৮ম বেতন কাঠামোর জন্য কমিশন গঠনের পর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, এর পর বেতন কাঠামোর জন্য আর কোনো কমিশন গঠন করা হবে না। প্রতি বছর নিয়ম অনুযায়ী সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি পাবে। আমার মনে হয়, সপ্তম কমিশনের যে স্ট্রাকচার, সেটাকে ধারণ করেই তা করা যেত। অষ্টম পে-স্কেলে যে তারতম্য সৃষ্টি করা হয়েছে, তার কোনো প্রয়োজনই ছিল না।
তিনি বলেন, 'পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা খুবই কম। অভিযোগ করা হয়, শিক্ষকরা কনসালটেন্সি (পরামর্শ) করেন। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। তবে এর সংখ্যাও ১০ ভাগের বেশি হবে না। আমার মতে, এটাও বাংলাদেশে শিক্ষাব্যবস্থায় অবদান রাখার দৃষ্টিকোণ থেকেই করা হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই তারা এর বিপরীতে আর্থিক সুবিধা পাবেন। তা ছাড়া কনসালটেন্সি করা কোনো নেতিবাচক দিকও নয়। এটা দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। এটা দেশের উন্নয়নের লক্ষ্যেই করা হচ্ছে।
সাবেক এই উপাচার্য বলেন, 'শিক্ষকরাই সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। স্বাভাবিকভাবে তাদের কাছেই এ দায়িত্ব আসবে। তা না হলে বিদেশ থেকে কনসালটেন্ট নিয়োগ করতে হবে, যা কোনোভাবেই প্রয়োজনীয় নয়।
যারা এটাকে নেতিবাচক দিক বলে মনে করেন, আমার মতে, তারা পুরোপুরি অজ্ঞ। তারা বিষয়টি বুঝেও না বোঝার ভান করেন। বরং এক্ষেত্রে ওইসব শিক্ষককে আরও উৎসাহিত করা উচিত।' বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে টিউশন ফির ওপর সাড়ে ৭ ভাগ ভ্যাট আরোপ প্রসঙ্গে এস এম এ ফায়েজ বলেন, 'ব্রিটিশ শাসন থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত উচ্চশিক্ষাকে দেশের কল্যাণের স্বার্থেই বিবেচনা করা হয়ে আসছে। এ কারণেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে নামমাত্র মূল্যে ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। কিন্তু এর সংখ্যা খুবই সীমিত। সরকার আর্থিক দিক বিবেচনায় নতুন করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করতে পারছে না।
তিনি বলেন, 'সীমিত আসন থাকার কারণে যেসব ছাত্রছাত্রী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে পারছেন না- তারাই মূলত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছেন। বলা যায়, অনেকটা বাধ্য হয়েই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন বিশাল একটি জনগোষ্ঠী। এদের মধ্যে অনেকেই নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানও রয়েছেন। অনেক মেধাবীও এখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন। সরকারের উচিত, এসব শিক্ষার্থীর পাশে দাঁড়ানো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক বলেন, 'বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া গরিব ও মধ্যবিত্ত শিক্ষার্থীদের ওপর সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট নিয়ে সরকারকে আরও ভাবা উচিত। নতুন করে এই টাকা সংগ্রহ করা অবশ্যই মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য কষ্টকর হবে। ছাত্রছাত্রীদের দেওয়া অর্থ যেন বিশ্ববিদ্যালয় ও তাদের মেধার পেছনে ব্যয় হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। প্রয়োজনে বেসরকারি শিক্ষা খাতে সরকারকে আরও সহায়তা দিতে হবে।
তিনি বলেন, 'যুক্তরাজ্যে ২০১০ সালে সরকারের পক্ষ থেকে বেসরকারি শিক্ষাকে উৎসাহিত করতে ৩০ মিলিয়ন পাউন্ড বাজেট বরাদ্দ করা হয়েছিল, যা ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বরাদ্দ দেওয়া হয় ৯০০ মিলিয়ন পাউন্ড। সেই অর্থে আমাদের দেশে বেসরকারি শিক্ষা খাতকে উৎসাহিত করা হয় না। দেশে আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি বিবেচনায় জনগণের কল্যাণের স্বার্থে, দরিদ্র ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভ্যাট বসানো কোনোভাবেই সমীচীন হবে না। ভ্যাট নিয়ে অর্থমন্ত্রী বা এনবিআরের বক্তব্য আমার কাছেও 'কনফিউজিং' মনে হয়। এটাকে আরও স্পষ্ট করা উচিত। সরকারকে এ নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে হবে। হাজার হাজার শিক্ষার্থীর দাবিকে অগ্রাহ্য করা কোনোভাবেই ঠিক হবে না।-বিডিপ্রতিদিন
১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এস.এ.সুমন/একে