বৃহস্পতিবার, ২২ অক্টোবর, ২০১৫, ০২:৪২:০৪

সেই চ্যালেঞ্জের জবাব দিবে আওয়ামী লীগ

সেই চ্যালেঞ্জের জবাব দিবে আওয়ামী লীগ

তৈমুর ফারুক তুষার : আসন্ন পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ তৃণমূলে সংগঠনকে শক্তিশালী করবে বলে মনে করছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। নেতারা এ নির্বাচনকে সরকারের জনপ্রিয়তা প্রমাণের চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন। সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডগুলোর ব্যাপক প্রচারণা সারা দেশে নিজেদের জনপ্রিয়তা বাড়াবে বলে মনে করছে দলটি। এ জন্য প্রথমবারের মতো দলীয়ভাবে স্থানীয় সরকারের এ নির্বাচনে দলটির কেন্দ্রীয় ও জাতীয় নেতারা ব্যাপকভাবে মাঠে নামবেন। আওয়ামী লীগের কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তৃণমূলে নিজেদের জনপ্রিয়তা আর সাংগঠনিক শক্তিও পরখ করে নিতে চায় আওয়ামী লীগ। আর বিএনপি জোট নির্বাচনে এলে প্রায় সাত বছর পর নৌকার সঙ্গে ধানের শীষের প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। এ জন্য এ নির্বাচনে জয়লাভ গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক মহল। নেতাদের মতে, এবারের স্থানীয় সরকার নির্বাচনে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের দলীয় সম্পৃক্ততা বাড়বে। যাঁরা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন তাঁরা তৃণমূলের নেতাকর্মীদের নিজেদের পক্ষে আনতে সক্রিয় হবেন। এতে গ্রাম বা ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন বাড়বে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তৃণমূলে নেতাকর্মীরা সক্রিয় হবে। এর মধ্য দিয়ে সংগঠনে গতি বাড়বে ও দল শক্তিশালী হবে। জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, 'স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয়ভাবে করার আইনটি পাস হলে সেটির আলোকেই নির্বাচনের জন্য আমরা দলীয় প্রস্তুতি নিতে শুরু করব। আমরা এবারের নির্বাচনকে গুরুত্ব দিয়ে দেখছি।' এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দলের আগামী কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে প্রার্থী মনোনয়নপ্রক্রিয়া নিয়ে সিদ্ধান্ত হবে। সভাপতিমণ্ডলীর আরেক সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ বলেন, 'এত দিন স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনে আমাদের দলের চার-পাঁচজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করত। এতে দলীয় নেতাকর্মীরা কার পক্ষে কাজ করবে তা নিয়ে বিভ্রান্ত হতো। ভোটাররাও দ্বিধায় পড়ত। কিন্তু দলীয়ভাবে নির্বাচন হওয়ায় এবারে কেন্দ্রীয় ও জাতীয় নেতারাও দলীয় প্রার্থীর পক্ষে মাঠে নামতে পারবেন। এর আগে দেখা যেত, একজনের পক্ষে মাঠে নামলে দলীয় অন্য প্রার্থীরা ক্ষুব্ধ হতেন। এবার দলের ঘোষিত প্রার্থী থাকায় কেন্দ্রীয় নেতাদের কাজ করতে সুবিধা হবে। আর দলের সিদ্ধান্তের বাইরে কেউ বিদ্রোহী প্রার্থী হলে তাঁর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থাও নেওয়া যাবে। এতে তৃণমূলে দলীয় শৃঙ্খলা বজায় রাখা সহজ হবে।' আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নূহ-উল আলম লেনিন এই প্রতিবেদককে বলেন, এত দিন দলের তৃণমূল অনেকটা উপেক্ষিত ছিল। এখন আমাদের তৃণমূলে সক্রিয় ও দৃশ্যমান সংগঠন গড়ে তুলতে হবে। আওয়ামী লীগের তৃণমূলে সব পর্যায়ে সাংগঠনিক ভিত্তি থাকলেও এত দিন তাদের দলে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তেমন ভূমিকা ছিল না। এখন সে অবস্থার অবসান হবে। সেখানে গণতন্ত্রের চর্চা বাড়বে।' দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ বলেন, 'দলীয়ভাবে নির্বাচনের ফলে তৃণমূলে দল শক্তিশালী হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। এ নির্বাচন কিভাবে ভালোভাবে সম্পন্ন করা যায় সে বিষয়ে আমরা একটি গাইডলাইন তৈরি করব। সেই ভিত্তিতে আমরা নির্বাচন পরিচালনা করব।' দলীয় সূত্রগুলো জানায়, স্থানীয় সরকার নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ব্যাপকভাবে প্রচারের নির্দেশনা দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। তিনি সরকারের এ পর্যন্ত যাবতীয় অর্জন বারবার জনগণকে মনে করিয়ে দিতে পরামর্শ দেন। দলের সর্বশেষ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকেও শেখ হাসিনা এমন নির্দেশনা দেন। তিনি নিজেও দেশের বিভিন্ন জেলায় জনসভায় বক্তব্যে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বিস্তারিতভাবে তুলে ধরছেন। গত ১৫ অক্টোবর কুড়িগ্রামে এক জনসভায় শেখ হাসিনা বলেন, 'নৌকা মার্কায় আপনারা ভোট দিয়েছেন, নৌকা আপনাদের মার্কা, এই নৌকা মার্কাই আপনাদের উন্নয়ন দেবে, এই নৌকা মার্কাই দেশের স্বাধীনতা এনে দিয়েছে। কাজেই নৌকা মার্কা ক্ষমতায় এলে দেশের উন্নয়ন হয়।' শেখ হাসিনার এ বক্তব্য প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনকে সামনে রেখেই দলীয় সভাপতি নৌকা মার্কার প্রতি সমর্থন চেয়েছেন। আমরা সামনের স্থানীয় সরকার নির্বাচনকে সরকারের জনপ্রিয়তা প্রমাণের চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছি। গত সাত বছরে সরকার দেশের ব্যাপক উন্নয়ন করেছে। এর ধারাবাহিকতা রক্ষায় আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীদের ভোট দেওয়ার গুরুত্ব জনগণের সামনে তুলে ধরার প্রয়োজন আছে। এ নির্বাচনের ফলাফল আগামী জাতীয় নির্বাচনের জন্য কোনো বার্তা দেবে কি না জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'বিএনপি-জামায়াত জোট বারবার আগাম নির্বাচন চাইছে। তবে সরকারের আগাম নির্বাচন দেওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই। বিগত সংসদ নির্বাচনে বিএনপি জোট আসেনি। এবার নিশ্চয় তারা স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নেবে। এতে নৌকা বনাম ধানের শীষের প্রতিদ্বন্দ্বিতার একটি সুযোগ তৈরি হবে। ফলে নির্বাচনের ফল থেকে প্রতিদ্বন্দ্বী দুই রাজনৈতিক জোটই নিজেদের জনপ্রিয়তার একটি ধারণা পাবে।' প্রার্থী মনোনয়ন দেবে তৃণমূল : দলীয় সূত্রগুলো জানায়, পৌর ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মনোনয়নে তৃণমূলের মতকে প্রাধান্য দেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে সংগঠনের উপজেলা ও পৌর কমিটির নেতারা প্রার্থী চূড়ান্ত করার দায়িত্ব পাবেন। দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা সংশ্লিষ্ট ইউনিটগুলোর নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে যোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা বিবেচনা করে প্রার্থী মনোনয়ন দেবেন। তবে কেন্দ্রীয় কমিটি যুক্তিযুক্ত মনে করলে যেকোনো প্রার্থীর মনোনয়ন পরিবর্তন করতে পারবে। দলীয় একটি সূত্র জানায়, সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়ন দিতে আওয়ামী লীগের একটি সংসদীয় বোর্ড রয়েছে। এটির আদলে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে মনোনয়ন দিতে তৃণমূল পর্যায়ে নির্বাচনী বোর্ড গঠন চান নীতিনির্ধারক একাধিক নেতা। তবে আসন্ন পৌর নির্বাচনে এ ধরনের বোর্ড গঠন নাও হতে পারে। তৃণমূলে বিশৃঙ্খলার শঙ্কাও : ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সর্বশেষ নির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে এবারের স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মাধ্যমে তৃণমূলে বিশৃঙ্খলা বাড়ার আশঙ্কার কথাও বলছেন কেউ কেউ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সম্পাদকমণ্ডলীর একজন সদস্য বলেন, 'বিগত সিটি করপোরেশন ও উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে আমরা দলের একক প্রার্থী নিশ্চিত করতে পারিনি। কেন্দ্রীয় নেতাদের কঠোরতা সত্ত্বেও বিপুলসংখ্যক বিদ্রোহী প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। পৌর ও ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনেও বিদ্রোহী প্রার্থীদের আটকানো কঠিন হবে। বিশেষ করে কাউন্সিলর ও ইউপি সদস্য পদে দলের একক প্রার্থী নিশ্চিত করা অসম্ভব হবে।' সম্পাদকমণ্ডলীর আরেক সদস্য বলেন, 'বাস্তবতা হলো, দলের ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে শতভাগ সাংগঠনিক শৃঙ্খলার চর্চা নেই। গণহারে বহিষ্কার করার পরিস্থিতি তৈরি হলে তা তৃণমূলে বিশৃঙ্খলা বাড়াবে।' ১৪ দলের শরিকদের ভিন্ন চিন্তা : আসন্ন পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন জোটগতভাবে হবে, নাকি শরিকরা নিজেদের মতো করে অংশগ্রহণ করবে, তা নিয়ে এখনো কোনো আলোচনা হয়নি ক্ষমতাসীন ১৪ দলীয় জোটে। এমনকি শরিক দলগুলোর অভ্যন্তরেও স্থানীয় সরকার নির্বাচনের কৌশল বা প্রস্তুতি নিয়ে কোনো বৈঠক হয়নি। জাতীয় সংসদের আগামী অধিবেশনে দলীয়ভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের আইন পাস হলে এবং নির্বাচন কমিশনের এ-সংক্রান্ত বিধিমালা জারির পর দলগুলো নির্বাচনী প্রস্তুতির কাজ শুরু করবে বলে জানা গেছে। তবে ১৪ দলের শরিক কয়েকটি দলের কেন্দ্রীয় নীতিনির্ধারকরা জানিয়েছেন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন জোটগতভাবে করা সম্ভব হবে না। স্থানীয়ভাবে কিছু এলাকায় জোটের শরিকদের মধ্যে সমঝোতা সম্ভব হলেও দেশের বেশির ভাগ এলাকাতেই শরিকরা আলাদা নির্বাচন করবে। জানতে চাইলে ১৪ দলের মুখপাত্র মোহাম্মদ নাসিম বলেন, 'আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ এখনো এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। দলীয় সিদ্ধান্ত হওয়ার পর জোটের শরিকদের সঙ্গে আলোচনা করব। অতীতেও অনেক নির্বাচন আমরা একসঙ্গে করেছি। আশা করি, এবারও একসঙ্গে করব।' জাসদের সাধারণ সম্পাদক শরিফ নুরুল আম্বিয়া প্রতিবেদককে বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে জোটের সঙ্গে কোনো আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক আলোচনা হয়নি। এ নিয়ে জাসদের কোনো বৈঠক এখনো হয়নি। জোটের অন্য শরিক দলগুলোও এ নিয়ে কোনো আলোচনা করেছে বলে আমার জানা নেই। তবে অতীতে জোটগতভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করা যায়নি। ওয়ার্কার্স পার্টির পলিটব্যুরোর সদস্য আনিসুর রহমান মল্লিক বলেন, আওয়ামী লীগ অনেক বড় একটি দল। তাদের অভ্যন্তরীণ বিবাদও প্রকট। স্থানীয় সরকারের মতো এত বড় একটি নির্বাচনে তাদের সঙ্গে জোটগত সমঝোতা কঠিন হবে। তিনি বলেন, আমরা আমাদের নিজেদের প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে যাব। তবে স্থানীয়ভাবে দেশের কোথাও যদি ১৪ দলের মধ্যে সমঝোতা হয় সেটি আমরা গ্রহণ করব।-কালের কণ্ঠ ২২ অক্টোবর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এস.এ.সুমন/একে

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে