বৃহস্পতিবার, ২২ অক্টোবর, ২০১৫, ০৮:১৭:৫৫

‘একটি শহরের যৌবন হারাতে দেখেছি’

‘একটি শহরের যৌবন হারাতে দেখেছি’

ড. সরদার এম. আনিছুর রহমান : এমন এক সময়ে শহরটিতে প্রবেশ আমার, চারপাশের পরিবেশ যেন তার উত্তাল যৌবনে দোল খেলছে।আনকুঁড়ে যুবতীর ভেজা পেঁজার মত কোমল ঠোঁটের উষ্ণতা শরীরের ভাঁজে ভাঁজে উত্তাল যৌবনের ঢেউ যেমন সবাইকে আকৃষ্ট করে তেমনি শহরটির অভয়ব।তাই সহজেই ভাল লেগে যায় এর সব কিছুই। শহরটি তার অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার বুকে নিয়ে ভরা যৌবনে আমাকে প্রবল ঘোরের মধ্যে ফেলে দেয়।আমিও ভালোবেসে ফেলি। এই শহরের উন্মাতাল দখিনা বাতাস, রূপালি ঢেউয়ের নৃত্য, ঝাউপাতার দোলা, শিঁ শিঁ সাঁই সাঁই শিস, ভঙ্গির রহস্যময়তা।যেমনটি এক বেড়ে উঠা নারীর কামনার নেশা মাতাল করে দেয়।শহরটিতে প্রবেশ করেই আমার অন্যরকম অনুভূতি। প্রসঙ্গত, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমাদের এক স্যার ক্লাশে জিজ্ঞেস করেছিলেন “মানুষ কেন একটি শহরের প্রেমে পড়ে?” এর উত্তরে আমার সহপাঠিরা বেশ কিছু কারণের কথা বলেছিলেন।স্যার নিজেও বেশ ক'টি কারণের কথা উল্লেখ করেছিলেন। এর মাঝে ছিলো এমন—মানুষটা যদি ওই শহরে জন্ম নেয় আর অন্যটা ছিলো যৌবনে সে যদি তার মনের মানুষের দেখা পায় ওই শহরে। অবশ্য রাজশাহী আমার জন্মস্থান নয়।এরপরও রাজশাহী আমার কাছে প্রিয়।স্যারের ঐ কথায় কিছু কারণ খুঁজে পেয়েছিলাম। যদিও বর্তমানে আর শহরটিতে বসবাস করি না, বছর দুই আগেই ছেড়ে এসেছি।এরপরও আমি কারণ খুঁজে পেয়েছি যার জন্য রাজশাহী শহর আমার প্রিয়। প্রথমত: এই শহরের পাশ দিয়ে পদ্মা নদী বয়ে গেছে, দুই. যেখানে আমার যৌবনের অনেকগুলো বছর কেটেছে।আর আমিও ওই শহরের একাধিক নারীর প্রেমে পড়েছিলাম।এছাড়াও শহরটার অনেক গৌরবোজ্জল অতীত রয়েছে।একটা শহরের প্রেমে পড়তে এই কারণগুলাই যথেষ্ট। শহরে তিনটি পার্ক।কেন্দ্রীয় উদ্যান বর্তমানে শহীদ কামরুজ্জামান পার্ক, শহীদ জিয়াউর রহমান পার্ক আর অন্যটি পদ্মা আবাসিক এলাকার পার্ক।একটি পদ্মার পাড়ে অবস্থিত।প্রায় বিকেলে বন্ধু-বান্ধবীদের সাথে আড্ডা দিতে পার্কে তথা পদ্মার পাড়ে যাওয়া হত।মাঝে মধ্যে ক'জন মিলে পদ্মায় জেগে উঠা চড়েও বেড়াতে যেতাম।পদ্মায় নির্মল হাওয়া শরীর-মন জুড়িয়ে যেত।চড়ে নৌকায় আসা-যাওয়ার পথে পানি নিয়ে ভাবতাম, এই জানি পদ্মার পানি দিন কে দিন কমে যাচ্ছে।অথচ এক সময়ের নদীর পানি শহর রক্ষার বাঁধের উপর পর্যন্ত আসতে দেখেছি, সেই পানি আজ বাঁধ এড়িয়ে অনেক দূরে চলে গেছে।সত্যিই আজ সেই পদ্মার বুকে জেগে উঠেছে মরু সাহারার ন্যায় বিশাল চর।থাক এসব ভাবাগের কথা।যৌবন হারানো পদ্মার কথা আরেক দিন না হয় লেখা যাবে।এবার আসি যৌবন হারানো শহরের কথায়। সেই ১৯৯৫ সালের শেষের দিকের কথা, কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পদার্পণ, সবেমাত্র এইচএসসি পাস করেছি, মনের মণিকোঠায় অপার স্বপ্ন।উচ্চশিক্ষা গ্রহণে ময়মনসিংহ থেকে সূদূর রাজশাহী গেছি।ভর্তি হয়েছি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। উত্তাল যৌবনে ঘুরে বেড়ানোই ছিল অন্যরকম এক নেশা।তাই নতুন শহরে সময় পেলেই ঘুরে বেড়াই আর খুঁজে নিই শহরের নতুন পুরানো সব কিছু।জানার চেষ্টা করি এর অতীত।আর এভাবেই ঘুরেফিরে আবিষ্কার করলাম শহরটির যৌবনগাঁথার কথা। অবশ্য এ কথা সবারই জানা- রাজশাহীর অপর নাম সিল্কসিটি।এই সিল্কের ঐতিহ্য শত বছরের।সিল্ককে ঘিরেই এক সময় রাজশাহীর সুনাম-সুখ্যাতি ছড়ায় পৃথিবীব্যাপী।প্রথম যখন রাজশাহী শহরে প্রবেশ করি, মহাসড়কের পাশঘেষা রেশম বোর্ড পেরিয়ে পুরাতন বাসস্টেশনে বাস থামতেই চোখে পড়ে ঐতিহ্যবাহী বিশাল রেশম কারখানাটি।কারখানার কর্মযজ্ঞের শব্দে তখন কান জ্বালাপালা। এক সময়ের ঐতিহ্যবাহী মসলিন হারিয়ে গেলেও সিল্কের ব্যাপক প্রসার ঘটে ব্যাপক হারে।রাজশাহী অঞ্চলের মাটি আবহাওয়া ভূপ্রকৃতি ও অন্যান্য দিক থেকে রেশম চাষের অনুকূল হওয়ায় লাখো মানুষ সাথে জড়িয়ে পড়ে এতে।তুঁতগাছ লাগানো গুঁটি উৎপাদন সুতা তৈরি নিয়ে শুরু হয় বিশাল কর্মযজ্ঞ।সেই ১৯৬১ সাল থেকে চল্লিশ বছরের বেশি সময় ধরে তৈরি করেছে রেশম কাপড়।যন্ত্র আর শ্রমিক কর্মচারীদের শব্দে থাকত মুখরিত। বিমান বালাদের বলাকা সিল্ক, লাল পাড়ের গরদ শাড়ি, নানা ছাপা আর কারু কাজ করা শাড়ি পাঞ্জাবীর কাপড়, মটকা ছিল সবার কাছে আকর্ষণীয়।এ কাপড় পড়লে অনেকের কাছে যেন স্বর্গীয় সুখ সুখ অনুভূত হতো।আর এসব সুতা নিয়ে অনবরত কাপড় করেছে এ রেশম কারখানা। রেশম চাষের প্রসার ঘটে দিনাজপুরের ঠাকুরগাঁ পর্যন্ত।সেখানে ১৯৬৭ সালে আরেকটি রেশম কারখানা স্থাপিত হয়।রেশম কাপড়ের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র।বহু মানুষের কর্মসংস্থান হয়।রেশম শিল্পের উন্নয়নে ১৯৭৭ সালে ‘রেশম উন্নয়ন বোর্ড’ হয়।রেশম চাষীদের মাঝে উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়। কিন্তু পরবর্তীতে সরকারের ভ্রান্তনীতির কারণে রেশমের দুর্গতি নেমে আসে।রেশম চাষে উৎসাহ হারায় কৃষক।বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসক্রিপশনে রেশম বোর্ডের বিপরীতে সিল্ক ফাউন্ডেশন করে রেশম বাগানগুলো তুলে দেয়া হয় এনজিওদের হাতে।ওরা উন্নয়নতো দূরে থাক।সবকছিু তালগোল পাকিয়ে পিছুটান দেয়।রেশম কারখানা দুটির কপালে দুর্ভোগ নেমে আসে।লোকসানের অজুহাত তুলে ২০০২ সালের নভেম্বর মাসে শেষ পেরেক ঠোকা হয়।থেমে যায় উৎপাদনের চাকা।বেকার হয় হাজারো শ্রমিক কর্মচারী। এইত কিছুদিন আগেও ঘুরে এলাম রাজশাহী।এক যুগ ধরে বন্ধ থাকায় চারিদিক জঙ্গল আর লতা পাতায় আচ্ছাদিত কারখানা ভবনে সাপ-বিচ্ছু, পশুপাখি বাসা বেঁধেছে।আর ভেতরের নতুন মেশিনের খোলগুলো পড়ে আছে, আর যে কয়টি লোহালক্কর আছে তাতেও ধরেছে মরিচা।একইদশা ঠাকুরগাঁ কারখানাটিরও।কারখানা দুটি অতীত সুখ-গৌরব আর এখনকার দু:খ-বেদনার সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সিল্কের ঐতিহ্য নিয়ে রাজশাহী রেশম নগরী হিসেবে গর্ব করতো।এখন সবই অতীত।রাজশাহী সিল্ক তার ঐতিহ্য হারালেও এখনও নাম নিয়ে বেঁচে আছে।এখানকার বেসরকারি রেশম কারখানাগুলো বিদেশ থেকে সুতো আমদানি করে কাপড় তৈরি করে দেশে বিদেশি বাজারজাত করছে রাজশাহী সিল্ক নামে।পোকা পাতা গুটি আর তা থেকে সুতা তৈরির বিস্ময়কর ব্যাপারটি এ প্রজন্মের মানুষের কাছে তুলে ধরার জন্য সপুরা সিল্ক প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করে এর ঐতিহ্যের কথা জানান দিচ্ছে। আর অন্য দিকে প্রকৃত রেশম চাষীরা তাদের পেশায় পরিবর্তন এনেছে।তুঁত চাষের জমিতে এখন ভিন্ন ফসল হয়।সুতা কাটার চরকাগুলো আর ঘোরে না।পেশা বদলেছে এর সাথে জড়িত নারী শ্রমিকদেরও।রেশমকে ঘিরে বিকাশমান কুটির শিল্প আজ মৃত প্রায়। এখনো কিছু মানুষ তাদের বাপদাদার পেশা হিসাবে রেশম চাষ করে যাচ্ছে।উৎপাদিত হচ্ছে সামান্য পরিমাণ সুতা।প্রকৃত অর্থে বাজারে রেশম নামে যেসব কাপড় তৈরি হয় তার সবই বিদেশ থেকে আমদানি করা।আমদানি করা সুতা দিয়ে তৈরি হচ্ছে রেশম কাপড়।পাশাপশি রেশম জাতীয় গ্রে থান কাপড় আনা হচ্ছে।সিল্ক সুতার সাথে সিনথেটিক সুতা মিশিয়ে থান কাপড় করে নজর কাড়া প্রিন্টিংয়ের মাধ্যমে শো রুমে প্রদর্শন ও বিক্রি করছে।বিভিন্ন শোরুম ও কাপড়ের দোকানে রাজশাহী সিল্ক নামে যে কাপড় বিক্রি হচ্ছে তার প্রকৃত মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে সর্বমহলে।যদিও রেশম শিল্প মালিকরা কাপড় তৈরি নিয়ে কোন কারসাজির কথা স্বীকার করেন না। এখনো স্মরণে আছে, সেই ১৯৯৫-৯৬ সালের দিকের কথা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পর স্বজনরা রাজশাহী সিল্কশাড়ির আবদার করতেন।সেসময় ৩০০-৫০০টাকায় সিল্কশাড়ি কিনে এনে দিলে আমার মামাতো-ফুফাতো বোন ও ভাবীরা কী যে খুশি হতেন!এখন সেই শাড়ি ৫ হাজার টাকায়ও পাওয়া যায় না।যা পাওয়া তাতেও ভেজাল। প্রসঙ্গত, রাজশাহী সিল্কের সেসব কথা সবই অতীত।সিল্কের সাথে সাথে হারিয়েছে এক সময়ের কর্মে প্রাণচাঞ্চল্য শহরটির যৌবনও।কিছু বৈদ্যুতিক বাতিতে বাইরের অভয়বে চাকচিক্য ফুটিয়ে তোলা হলেও প্রকৃতপক্ষে যৌবন হারিয়ে শহরটির গায়ে এখন বার্ধক্যের ছাপ পড়েছে।যৌবন হারিয়ে শুস্ক বক্ষ বিস্তার করে সর্বক্ষণ আর্তনাদ করছে।কেননা, এই শহরের প্রধান কর্মক্ষেত্রই বন্ধ হয়ে বেকার হয়েছে হাজার হাজার নারী-পুরুষ।এছাড়া তাদের নতুন স্বপ্ন দেখার মতো অন্য কোনো সম্ভাবনাও তৈরি হয়নি।বেকারত্বের কষাঘাতে নতুন প্রজন্ম তরুণরা জড়িয়ে পড়ছে চোরকারবারি তথা মাদক ব্যবসায়।মাদকের ছোবলে পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধনও ভেঙে পড়ছে।কেননা, এক সময়ের বিশ্বের সবচেয়ে সুখী (লন্ডন ইকোনোমিক্স কলেজ ২০০২) নগরী হয়েছে সবচেয়ে কষ্টের নগরী।কর্মসংস্থানের অভাবে সর্বত্রই হাহাকার।অনেকে শহর ছাড়ছেন। অথচ সিল্কের সেই অতীত ফিরিয়ে আনতে কথা দিয়েছিলেন খালেদা-হাসিনা।স্থানীয়-জাতীয় নির্বাচনে বারবার প্রতিশ্রুতি দেন লিটন, মিনু ও বাদশারা।ব্যবসায়িক থেকে রাতারাতি রাজনীতিবিদ বনে যাওয়া আব্দুল ওয়াদুদ দারা, ইঞ্জিনিয়ার এনামুল ও শাহরিয়ার আলমরা শিল্প-কারখানা গড়ে রাজশাহীর চিত্র পাল্টে দেয়ার অনেক স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, অনেক আশা জাগিয়েছিলেন রাজশাহীবাসীর মাঝে।এমন কি নিবার্চনে প্রতিশ্রুতি দিয়ে এমপি-মন্ত্রী হলেও শাহরিয়ার আলমের ২০০৯-১০ এ সুয়েটার ফ্যাক্টরীর জন্য লাগানো সাইনবোর্ডের কার্যক্রম আজও শুরু হয়নি। তাই কেউ কথা রাখেননি।সবাই নিজেদের আখের গুছিয়েছেন।কিন্তু আশায় বুকবেঁধে থাকা সেই শহরের মানুষের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি।তাই ভালো নেই এককালের কর্মচঞ্চল শহরটি।সবকিছুই যেন ঝিমিয়ে পড়েছে। শুধু তাই নয়, এক সময়ের শান্তি ও সহাবস্থানের নগরীতে ছড়িয়েছে প্রতিহিংসা আর প্রতিশোধ পরায়নতার বিষ বাষ্প।সাবেক-বর্তমান নগর পিতা মিনু-বুলবুলকে জড়ানো হয়েছে মামলায়, পাঠানো হয়েছে জেলে, মেয়র পদ থেকেও বরখাস্ত করা হয়েছে বুলবুলকে। মামলা-হামলায় শিকার হাজারো মানুষ হয়েছেন বাড়িঘর ছাড়া। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেও তাড়ানো হয়েছে প্রতিপক্ষকে। শুধু রাজনীতিতেই নয়, বিভিন্ন পেশাজীবীদের মধ্যেও এ ব্যাধি বিস্তার করেছে।সবমিলেই শহরটি এখন যৌবন হারিয়ে নূহ্যমান। লেখক: গবেষক এবং কলাম লেখক।ই-মেইল: [email protected] ২২ অক্টোবর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এসএম/ডিআরএ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে