শুক্রবার, ২৩ অক্টোবর, ২০১৫, ১১:৩৪:৩৩

স্মৃতিতে চাষী নজরুল

 স্মৃতিতে চাষী নজরুল

ড. সরদার এম. আনিছুর রহমান : প্রয়াত কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব চাষী নজরুল ইসলামের আজ ৭৫তম জন্মদিন। ১৯৪১ সালের এইদিনে বিক্রমপুরের শ্রীনগর থানাধীন সমষপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এই মহান ব্যক্তিত্ব। সর্বাধিক মুক্তিযুদ্ধ ও সাহিত্যভিত্তিক চলচ্চিত্রের নির্মাতা আর বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সবার প্রিয় ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছিলেন তিনি। আজ তিনি আমাদের মাঝে নেই। এইত গেল ১১ জানুয়ারী পৃথিবীর সব ভালবাসা ছেড়ে চলে গেছেন এক অজানার দেশে । কিন্তু তাঁর কর্ম, তাঁর ভালবাসা আমাদের স্মৃতিতে বারবার দোলা দিচ্ছে।স্মরণে পড়ছে চাষী নজরুলের সাথে কাটানো সেই দিনগুলোর কথা। এর আগেও তাঁকে নিয়ে একটি নিবন্ধ লিখেছিলাম। ওই নিবন্ধেও আমার স্মৃতির পাতার কিছু বিষয় তুলে ধরেছিলাম। তাঁর সাথে আমার সম্পর্কটা খুব বেশী গভীরের না হলেও তাঁকে নিয়ে আজ তাঁর জন্মদিনে অনেক স্মৃতিই মনে পড়ছে। এর আগে বেশ কয়েকবছর ধরে জন্মদিনের সকালে ফোনে শুভেচ্ছা জানাতাম, ফোন ধরেই ধরাজ গলায় ‌‘ছোট ভাই আনিছ’ বলেই গল্পে মেতে উঠতেন। আজকের সকাল থেকেই আমার মনটা বিষন্ন, বারবার অতীত স্মৃতিগুলোই আমাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। তাই সদা হাস্যোজ্জ্বল প্রাণবন্ত মানুষটির আজবারবার মনে পড়ছে কথা সাহিত্যিক তারাশঙ্করের সেই অমর উক্তি, “জীবন এত ছোট কেন?” । ঠিক কখন থেকে তাঁর সাথে পরিচিত হয়ে উঠি তা আজ স্মৃতিতে নেই। তবে বলতে পারি টেলিভিশনের পর্দা আর বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে চাষী নজরুল ও তাঁর কর্মের সাথে আমার পরিচয় সেই ছোটবেলা থেকেই। তবে তাঁর সাথে সম্পর্ক গভীর হয় ২০১২ সালের প্রথমার্ধে। বলা যায়- অনেকটা কাকতালীয়ভাবেই তাঁর সাথে আমার ব্যক্তিগত সুসম্পর্ক। সদা হাস্যোজ্জ্বল মুখ, প্রাণবন্ত লোকটিকে ভাই বলেই ডাকতাম, আমাকেও ছোট ভাইয়ের মত স্নেহ করতেন। তখন আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক। পাশাপাশি একটি মানবাধিকার সংগঠনের সাথেও জড়িত ছিলাম। সম্ভবত তিনি অ্যাড. সিগমা হুদার পরিচালনায় বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার কাজে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ সফরে গিয়েছিলেন। আর সেই সুবাদেই হঠাৎ রাজশাহীর প্রবীণ আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী আবুল কাসেম সাহেব কোন এক সকালে আমাকে ফোনে জানালেন, চাষী নজরুল ইসলাম রাজশাহীতে, তিনি মানবাধিকার কর্মী ও পেশাজীবীদের সাথে কথা বলতে আগ্রহী। ঠিক হলো- সন্ধ্যার পর আমার অফিসেই আসবেন। আমিও কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও পেশাজীবীদের আমন্ত্রণ করলাম। চাষী নজরুলের কথা শুনে সবাই সন্ধ্যার পরপরই চলে এলেন। সেদিন চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে মানবাধিকার সংস্থার পূর্বনির্ধারিত প্রোগাম শেষে আসতে একটু দেরি হওয়ায় সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিলেন তিনি। এরপর দীর্ঘসময় দেশের সার্বিক বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা করলেন। মাঝে মধ্যে প্রাণোজ্জ্বল হাসি।সে কথা আজও ভুলতে পারি না। দেশ-জাতি আর বিশ্ব পরিস্থিতি নিয়ে সেদিনকার তাঁর প্রাণবন্ত বুদ্ধিদীপ্ত আলোচনায় আমরা সবাই মুগ্ধ হলাম। সেদিনকার আলোচনায় ফুঁটে উঠেছিল দেশ-জাতির প্রতি তাঁর অগাধ ভালোবাসা। এরপর সবার কাছ থেকে বিদায় নিলেন। আমি আর কথা সাহিত্যিক ডা. নাজিব ওয়াদুদ তাঁকে নিয়ে অ্যাড. আবুল কাশেমের বাসায় রাতের খাবার খেলাম। সেখানেও দীর্ঘ সময় কথা হলো। পরদিন আমরা তাঁকে বিদায় দিলাম। এরপর থেকেই তিনি যতবারই রাজশাহী অঞ্চলে যেতেন আগেই আমাকে ফোন করে জানাতেন। তাঁর সাথে আমার নিয়মিতই ফোনে যোগাযোগ হতো। প্রথম সাক্ষাতেই মনে হয়েছিল তাঁর সাথে যেন আমার অনেক দিনের পরিচয়। আজ বারবার স্মরণে পড়ছে। সেই ২০১৩ সালের শেষ দিকে কোনো একটি সাংস্কৃতিক উৎসব অনুষ্ঠান উদ্বোধন করতে রাজশাহী গিয়েছিলেন, সাথে কণ্ঠশিল্পী মনির খান ও রিজিয়া পারভীনও ছিলেন।রাজশাহী পৌঁছেই তিনি আমাকে হোটেল নাইসে ঢেকে পাঠালেন। বিকাল ৪টার দিকে একজন ব্যবসায়ীকে সাথে নিয়ে সরাসরি তাঁর রুমে গেলাম, তিনি রুমের দরজা খুলেই বুকে জড়িয়ে ধরে কুশলবিনিময় করলেন। আমাদের বসতে দিলেন, চা-মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করালেন। পরে সেখানে আমাদের সাথে যোগ দিলেন রিজিয়া পারভীন ও সাংস্কৃতিককর্মী মামুনসহ আরো অনেকে। দীর্ঘসময় রসালো গল্প আর এর ফাঁকে রিজিয়া পারভীনের কণ্ঠে দেশাত্মাবোধক আধুনিক গান। সবমিলেই আড্ডাটা বেশ জমে উঠে। শয্যাশায়ী হবার পরও ফোনে তাঁর সাথে আমার অনেকবার কথা হয়, ফোন রিসিপ করে তিনি শুধু বলতেন- ছোটভাই আমার জন্য দোয়া কর। আমার শারীরিক অবস্থা বেশী একটা ভালো না। সুস্থ হয়ে বিস্তারিত কথা হবে। হাসপাতালেও বেশ কয়েকবার দেখতে গিয়েছিলাম।অসুস্থ থেকেও আমার সঙ্গে আগের মতোই হেসে কথা বলেছেন। অনেকের খোঁজ নিয়েছেন। কোনো ভাবেই বুঝতে দেননি কতটা কষ্ট হচ্ছে তাঁর। তাঁর কন্ঠে শেষ বক্তব্য শুনেছিলাম ২০১৪ সালের গত ২৫ অক্টোবর, জাতীয় প্রেসক্লাবের মিলনায়তনে ভাষাসৈনিক অলি আহাদের মৃত্যুবার্ষিকীর আলোচনা সভায়।ওইদিন তিনি সুললিত কণ্ঠে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে অলি আহাদের অবদানের কথা তুলে ধরে স্মৃতিচারণ করেন। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি তাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে হবে এমনটি কখনোেই ভাবিনি। আজ মনে হচ্ছে যেন আমার পরম আপনজনকে হারিয়েছি। আপনজনদের সাথে যেমন নিজের সুখ-দুঃখের কথা শেয়ার করে থাকি, তেমনি তাঁর সাথেও করতাম। প্রসঙ্গত: একবার ঢাকায় এসে ব্যক্তিগতভাবে একটা সমস্যায় পড়ে যাই। সরাসরি তাঁর কাছে গেলাম, তিনি মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শুনলেন এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিলেন।সেসময়কার তাঁর সুপরামর্শের কথা জীবনে কখনো ভুলে যাবার নয়।তাই তাঁর প্রতি আমার এক অন্যরকম শ্রদ্ধাবোধ।আমি তাঁকে অভিভাবক মানতাম। যেকোনো বিষয়ে তাঁর সঙ্গে আলোচনা করতাম। তিনি আন্তরিকভাবে পরামর্শও দিতেন। ফলে একথা আমি জোর দিয়েই বলতে পারি- চাষী নজরুলের মতো এত বিশাল হৃদয়ের মানুষ খুব কমই দেখা মেলে। কী খাবার টেবিল, কী আলোচনার টেবিল সবখানেই সবাইকে মাতিয়ে রাখতেন তিনি। তাঁর কণ্ঠ মানেই মাইক। তিনি ধীরে কথা বললেও মনে হতো জোরে কথা বলছেন। কিন্তু সেটা কখনোই বিরক্তকর মনে হয়নি। থাক আমারেএসব কথা। চাষী নজরুল ও তাঁর কর্মকে তাঁর সহকর্মীরাই হয়তো বেশী মূল্যায়ন করতে পারবেন। তবে এটা বলতে পারি- স্বাধীন বাংলায় চলচ্চিত্র জগতের পাশাপাশি তিনি ছিলেন আমাদের সমাজের একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র ও অভিভাবক। তিনি ছিলেন ক্ষণজন্মা সৃজনশীল প্রাণপুরুষ। সেই সৃজনশীল কর্মের মাধ্যমেই তিনি মানুষের মাঝে চিরঞ্জীব থাকবেন। যত দিন বাংলাদেশ থাকবে তত দিন বাঙালি জাতি বীর মুক্তিযোদ্ধা চাষী নজরুলকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে। স্বাধীন বাংলার প্রথম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র 'ওরা ১১ জন'-এর পরিচালক, এর চেয়ে বড় পরিচয় তাঁর আর কী হতে পারে! দেশ স্বাধীনের পর চাষী নজরুল ইসলামের মতো একজন সৃজনশীল চলচ্চিত্র পরিচালক পাওয়া বাংলাদেশের জন্য ছিল পরম সৌভাগ্যের যা তাঁর সহকর্মীদের কণ্ঠেই ফুটে উঠেছে। তিনি যে কত বড় মাপের মানুষ ছিলেন, মৃত্যুর পর দলমত নির্বিশেষে হাসপাতাল, এফডিসি ও বাসায় তাঁর মরদেহের পাশে হাজারো মানুষের উপস্থিতি ও তাঁর জানাযায় অংশ গ্রহণই প্রমাণ করেছিল। জাতি গঠনে বিশেষ করে মহান মুক্তিযুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জীবনবাজি রেখে তিনি যে অবদান রেখে গেছেন তা আমরা কোনো ভাবেই শোধ করতে পারবো না। এছাড়া সৃজনশীল প্রতিভায় রুচিশীল চলচ্চিত্র নির্মাণের মাধ্যমে বিভিন্ন বিষয়ে জাতিকে দিয়ে গেছেন অনেক দিক নির্দেশনা। আজীবন তিনি সত্য ও ন্যায়ের পথে সংগ্রাম করে গেছেন। সাধারণ মানুষের অধিকার রক্ষায় এবং অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধেও তিনি ছিলেন সর্বদা সোচ্চার ও এক লড়াকু সৈনিক। তিনি ছিলেন ক্ষণজন্মা এক পুরুষ। তাঁর শূণ্যতা কোনো ভাবেই পূরণ হবার নয়। তাঁর সব অবদানের কথা জাতি চিরকাল শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে বলেই আমার বিশ্বাস। সেই সাথে তাঁর জীবন ও কর্ম ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে অনুকরণীয় ও পাথেয় হয়ে থাকবে। সবশেষে মরহুম চাষী নজরুলের আত্মার শান্তি কামনা করে এখানেই শেষ করছি। মহান আল্লাহ তাকে সর্বোচ্চ প্রতিদান দান করুন। আমিন। লেখক: শিক্ষা ও সমাজ বিষয়ক গবেষক এবং কলাম লেখক। ই-মেইল: [email protected]

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে