সমরেশ মজুমদার : যত দিন যাচ্ছে, তত আধুনিক সভ্যতা যেসব সুযোগ-সুবিধা দেয় তা পাওয়ার জন্য মানুষ ব্যস্ত হয়ে উঠছে। ফলে সমতলের জায়গাগুলোর চেহারা ক্রমশ একই রকমের হয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে আধুনিক দোকানগুলো যে রাস্তায় সাজানো তার সামনে দাঁড়ালে ধন্দে পড়তে হয়। জলপাইগুড়ির সঙ্গে বর্ধমানের পার্থক্য থাকে না, কলকাতার সঙ্গে পাল্লা দেয় শিলিগুড়ি। বিশ্বায়ন কিনা জানি না, তবে পশ্চিমবঙ্গায়ন যে হতে চলেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এই চেহারা শুধু ঘরবাড়ি, উড়ালপুল, দোকান বা রাস্তার ক্ষেত্রে নয়, মানুষের কথাবার্তা, চালচলন, পোশাক-আশাকেও স্পষ্ট। বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে। যে তরুণী কদমতলায় মোড়ে জিন্স আর গেঞ্জি পরে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারছে তাকে জলপাইগুড়ি শহরের মানুষ দশ বছর আগেও কল্পনা করেনি।
এখন জিন্স অথবা কেপ্রিতে স্বচ্ছন্দ মেয়েরা গোটা পশ্চিম বাংলায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। মুখ না দেখতে পেলে মুর্শিদাবাদ বা কোচবিহারের মেয়েকে একই রকম দেখাবে। আমি এই পরিবর্তনের বিরোধী নই, কিন্তু মাঝে মাঝেই মনে হয় এর ফলে কি নিজস্বতা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে না! বছর ষাটেক আগে জলপাইগুড়ির বেশির ভাগ বয়স্ক মানুষ ধুতির ওপর শার্ট অথবা পাঞ্জাবি পরতেন। যারা একটু উঁচু পদে চাকরি করতেন, তারা অফিসে যেতেন শার্ট-প্যান্ট পরে, বাড়িতে এসেই ধুতিতে ফিরে যেতেন। যত সময় গড়াল তত ধুতি পরার অভ্যাস কমতে লাগল।
এখন শহরের পথে অতি সামান্যসংখ্যক মানুষকে ওই পোশাকে দেখা যাচ্ছে। দশ বছর আগে সত্তর পেরিয়ে যাওয়া মানুষ যিনি শার্ট-প্যান্টে অভ্যস্ত তিনি জিন্স পরতেন না। ওটা ছেলে-ছোকরাদের পোশাক বলে দূরত্ব রাখতেন। এখন ওই মনোভাব বদলে গেছে। মেয়েদের ক্ষেত্রে তো পোশাকের বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে গেছে। যে মেয়েটি হাঁটু থেকে পা উন্মুক্ত করে হাঁটছে তার জড়তা কাটল কী করে? পঞ্চাশ বছর আগে স্লিভলেস জামা পরতেই সাহস পেতেন না বেশির ভাগ মহিলা। স্বামী জোর করলে সেই জামা পরে আঁচলের তলায় নিজেকে আড়াল করতেন। সালোয়ার-কামিজের সঙ্গে ওড়না ব্যবহার না করার কথা অল্পবয়সীরা ভাবতেই পারত না। যদি বলি সংস্কার, তাহলে তার বয়স দীর্ঘকালের নয়।
দেড়শো বছর আগে, অন্তর্বাস দূরের কথা, বাংলার মেয়েদের ব্লাউজ ব্যবহার করার চল ছিল না। সে সময়ের আঁকা ছবি ইত্যাদিতে এই ব্যাপারটা স্পষ্ট। সেমিজের চল ছিল বাড়ির বাইরে কোথাও যেতে হলে, সেই সেমিজ থেকে নানা রকমের ব্লাউজের জন্ম হলো। মূলত ঠাকুরবাড়ি থেকে পোশাকের পরিবর্তন শুরু হয়েছিল। সালোয়ার-কামিজের সঙ্গে ওড়নার ব্যবহার যখন বাহুল্য বলে মনে হচ্ছিল, তখনই প্যান্ট-শার্টের চল শুরু। সেই শার্ট থেকে গেঞ্জি, যার ওপর ওড়নার কোনো ভূমিকা নেই। প্যান্ট পরলে হাঁটাচলায় স্বচ্ছন্দবোধ করা যায়। বাসে ওঠানামা করতে অসুবিধে হয় না, দুটি প্যান্টে সারা মাস চলে যায় যা শাড়িতে সম্ভব নয়। কিন্তু এই পরিবর্তন যার কল্যাণে দ্রুত সম্ভব হয়েছে, সেই টিভি চ্যানেলগুলো তো এখানেই থেমে যায়নি। যে মেয়েটি সিউড়িতে বসে প্রতিদিন টিভির বিজ্ঞাপন বা অনুষ্ঠান দেখছে, ওই মুহূর্তে আলিপুরদুয়ারের মেয়েটিও তার শরিক।
তাই প্যান্টের প্রান্ত গোড়ালি থেকে উঠে যাচ্ছে হাঁটু পর্যন্ত, শার্টের হাতা খসে পড়ছে কাঁধ থেকে। ওই একই দৃশ্য টিভিতে অভিভাবকরা দেখছেন, রাস্তার যাবতীয় মানুষ দেখছে, তাই দেখতে দেখতে তারাও অভ্যস্ত হয়ে গেছে বলে মেয়েটিকে সমালোচনার মুখে পড়তে হয় না। এই যে বঙ্গায়ন, ভালো না মন্দ, তা নিয়ে কথা বলতে যাওয়া বোকামি। ভারতচন্দ্র বলেছিলেন, নগর পুড়িলে কি দেবালয় এড়ায়? এই বিপুল পরিবর্তনের সে াত আটকাবে এমন সাধ্য কার? আর আটকাতেই বা যাবে কেন? কিন্তু আমার আফসোস হয়, যখন স্মৃতি ধাক্কা খায়। এবং সেইসব স্মৃতি যা কয়েকশো মাইল দূরে থেকেও মনে লালন করে যাই অনায়াসে। সেই স্মৃতি জড়িয়ে আছে ছোটবড় নদীতে, গাছগাছালি, বাঁক নেওয়া জঙ্গলের পথে অথবা ঝরনার তিরতিরে স্বচ্ছ সে রাতে ঘুরে বেড়ানো ঝিলা মাছের ঝাঁকে!
এই স্মৃতি আমি ভুলে যাব কী করে? আংরাভাসা নদী থেকে খাল কেটে একটি জলের ধারা মুখার্জিদের স্টেশনারি দোকানের পাশ দিয়ে চা বাগানের ভিতর দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ফ্যাক্টরিতে বিদ্যুৎ তৈরি করার প্রয়োজনে। আর আমাদের কোয়ার্টার্সের পিছন দিকে বয়ে যাওয়া বড়জোর একশো ফুট চওড়া সেই জলের ধারার সঙ্গে আমার শৈশব, কৈশোর কেটেছে। জলপাইগুড়ির স্কুল বন্ধ হলেই চা বাগানের কোয়ার্টার্সে পেঁৗছেই ছুটে যেতাম সেই জলের ধারার কাছে। ঢেউয়ের কুলকুল ধ্বনি কানে যেতেই বুক জুড়িয়ে যেত। তারপর সেই সময়টা এলো। জলের প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়ায় জলধারার মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। শুকনো কঙ্কালের মতো পড়ে আছে জলশূন্য পাথরগুলো। মনে হয়েছিল বুকে এক ফোঁটা বাতাস নেই আমার।
দ্বিতীয়বার যাইনি সেই স্বপ্নের মতো নদীর কাছে। গয়েরকাটা থেকে নাথুয়া যাওয়ার পথে খুঁটিমারি জঙ্গলের শুরুর মুখে ছিল একটা ঝরনা। ঝরনার ওপর কাঠের পুল যার পাটাতনের ফাঁক দিয়েও নিচের জল দেখা যেত। হাঁটুর কিঞ্চিৎ উপরে বইত জলের ধারা। ঝিঁঝির ডাক, বিচিত্র পাখিদের আওয়াজের মধ্যে বসে হলদেটে অথবা লালচে ছোট মাছেদের সাঁতার দেখতাম। পাথর সরিয়ে চিংড়ি ধরে ভালো করে দেখে আবার জলে ছেড়ে দিতাম। মনে হতো এসবই আমার। কয়েক বছর আগে গিয়ে দেখলাম কাঠের পুল সরিয়ে আধুনিক সেতু হয়েছে, নিচে জলের ধারা শীর্ণতর হয়ে যাওয়ায় মাছেরা উধাও। পাশের জঙ্গলও ন্যাড়া। সরে এসেছি তৎক্ষণাৎ।
সন্ধের পর গয়েরকাটার আলো কমে যেত, ঘুমঘুম স্বপ্নের রাজ্যে চলে যেতাম আমি। এখন মধ্যরাত পর্যন্ত দোকানে গান বাজে, অত্যাধুনিক দোকান সব। জায়গাটা আছে, শুধু সেই মায়াটা চলে গেছে। কিন্তু যতই বঙ্গায়ন বলি, যতই সভ্যতার ব্যাপক আগ্রাসন দেখি তবু মাঝে মাঝে এমন খবর পাই যে চমকে উঠতে হয়। নইলে ষাট বছর আগে দেখা একটি মদেশিয়া বালিকা যে এখন অভাবে অতি বৃদ্ধা, আমাকে দেখে হেসে কী করে বলে, 'বাবলু তুই!' কোনো সন্দেহ নেই তার, আর এই জন্যেই বেঁচে থাকা।-বিডিপ্রতিদিন
১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এস.এ.সুমন/একে