মঙ্গলবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০৩:১৮:২০

ভ্যাটবিরোধী আন্দোলনে যত স্লোগান

ভ্যাটবিরোধী আন্দোলনে যত স্লোগান

এমরান হোসাইন শেখ : দাবি আদায়ের প্রতিটি আন্দোলনে স্লোগান একটি বড় ফ্যাক্টর। হৃদয়গ্রাহী স্লোগানগুলো গণমানুষের মনে দাগ কাটে। দ্রুত মানুষের মুখে-মুখে ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলন বেগবান করে। নিশ্চিত পরিণতির দিকে নিয়ে যায় যেকোনও আন্দোলনকে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে বাংলাদেশের প্রতিটি আন্দোলনে এসেছে নতুন-নতুন স্লোগান। বিগত আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের চলমান ভ্যাটবিরোধী আন্দোলনেও এসেছে কিছু নতুন স্লোগান। এ সব স্লোগানের মধ্যে কয়েকটি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিতর্ক সৃষ্টি হলেও তাদের আন্দোলনে ঠিকই গতি এনে দিয়েছে।

স্লোগানের অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, আগে ছড়া, কবিতা ও গানের ভাষায়ই ছিল স্লোগান। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’, ‘এই শিকল পরা ছল’ পঙক্তিগুলোও স্লোগান হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। অন্নদা শংকরের ‘তেলের শিশি ভাঙলো বলে খোকার পরে রাগ করো/তোমরা যে সব ধেড়ে  খোকা / ভারত ভেঙ্গে ভাগ করো’ ছিল দ্বিজাতি তত্ত্বের বিরুদ্ধে এক দুর্দান্ত স্লোগান। হেলাল হাফিজের ‘এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’ কবিতাটি উজ্জীবিত করেছিল মুক্তিবাহিনীদের। তবে, ছড়া কবিতার বাইরে আমাদের দেশে যেসব স্লোগান জনপ্রিয়তা পেয়েছে তার মধ্যে রয়েছে-মুক্তিযুদ্ধকালে ‘জয় বাংলা’, ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা/তোমার আমার ঠিকানা’, এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময়ে ‘স্বৈরচার নিপাত যাক/গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ ইত্যাদি। মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের সর্বোচ্চ সাজার দাবিতে গণজাগরণমঞ্চ থেকে যে আন্দোলন পরিচালিত হয়, সে সময়ও জয়বাংলার মতো পুরোনো জনপ্রিয় স্লোগানের পাশাপাশি প্রয়াত সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের বহুব্রীহি নাটকের ডায়ালগ ‘তুই রাজাকার’/তুই রাজাকার’ ‘গোলাম আযম মামু/ছিল্ল্যা লবণ লাগামু’, ‘পাকিস্তানের প্রেতাত্মারা/পাকিস্তানের ফেরত যা’, ‘জামাতে ইসলাম/মেড ইন পাকিস্তান’, ‘কফিন রেডি, বডি নাই/রাজাকারের ফাঁসি চাই’, ‘আপিলের কাম নাই/ডাইরেক্ট ফাঁসি চাই’ ইত্যদি স্লোগান জনপ্রিয়তা পায়।

এ সব আন্দোলনে তৈরি হওয়া স্লোগানের ধারাবাহিকতায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান আন্দোলনে যেসব নতুন স্লোগান এসেছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- ‘নো ভ্যাট/নো ভ্যাট’, ‘ভ্যাট দেব না/রক্ত দেব’, ‘রক্ত চাইলে রক্ত দেব/ভ্যাট ছাড়া শিক্ষা নেব’, ‘শিক্ষা আমার অধিকার/ভ্যাট নেবে সাধ্য কার’, ‘রক্তের বন্যায়/ভ্যাট যাবে গঙ্গায়’, ‘শিক্ষা কি পণ্য/ভ্যাট কিসের জন্য’, ‘আমরা কি পণ্য/ভ্যাট কিসের জন্য’, ‘শিক্ষা তোমার ভয় নাই/রাজপথ ছাড়ি নাই’, ‘ভ্যাট নিপাত যাক/শিক্ষা মুক্তি পাক’, ‘এ যুগের হাতিয়ার/গর্জে উঠুক আরেকবার’, ‘মানি না মানব না/ভ্যাট দিয়ে পড়ব না’, ‘ভ্যাট দেব না/গুলি কর’, ‘ভ্যাট এর স্বীকৃতি/শিক্ষানীতির বিকৃতি’, ‘দাবি মোদের একটাই/ভ্যাট ছাড়া শিক্ষা চাই’, ‘শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড/ভ্যাট চায় কোন ভণ্ড’, ‘ছাত্র পুলিশ ভাই ভাই/তাদের সাথে বিরোধ নাই’, ‘পাবলিক-প্রাইভেট ভাই ভাই/ভ্যাট ছাড়া শিক্ষা চাই’, ‘বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ/শিক্ষার ওপর কিসের ভ্যাট’, ‘হামলা মামলা যা ই করো না/অধিকারে ছাড় দেব না’, ‘বাঁচার মতো বাঁচতে চাই/ভ্যাট ছাড়া শিক্ষা চাই’, ‘জয় বাংলা/ভ্যাট সামলা’, ‘দেহ পাবি মন পাবি /মাগার ভ্যাট পাবি না’, শিক্ষায় আবার কিসের কর/ভ্যাট দিব না গুলি কর’।

এছাড়া ‘নো ভ্যাট অন এডুকেশন‘, ‘আমার বাবা ATM বুথ নয়’, ‘মাল সাহেব আমার বাবা মালদার না', ‘বাবার কষ্টার্জিত টাকা দেব না মালের বস্তায়/ তাই আমরা আজ নেমেছি রাস্তায়’, ‘গুলি করে যদি ছাত্রদের থামানো যেত তবে, এই বাংলার জন্ম হতো না’, ‘আমার মধ্যবিত্ত বাবা এফডি ভেঙে পড়ায়’, ‘চাই না রক্ত,চাই না বস্ত্র, চাই না যুদ্ধ, শিক্ষাই আমাদের আসল অস্ত্র ইত্যাদি একক স্লোগান উঠে এসেছে চলমান ভ্যাটবিরোধী আন্দোলনে।

নতুন এসব স্লোগান প্রসঙ্গে আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত বেসরকারি স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ‍আশরাফুজ্জামান আসিফ বলেন, অনেক স্লোগান তাৎক্ষণিকভাবে তাদের সহপাঠীরা তৈরি করেছেন। আবার তাদের পরিচিত বড় ভাইরাও কিছু কিছু স্লোগান তৈরি করে দিয়েছেন।

ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী নাফিজা রহমানও একই ধরনের মন্তব্য করেন। তিনি জানান, তাদের কর্মসূচির সময় অনেক নতুন নতুন স্লোগান এসেছে। তিনি ও তার একাধিক বন্ধু মিলে কয়েকটি স্লোগান তৈরি করেছেন বলেও জানান।

গণতান্ত্রিক আন্দোলনে এক সময়কার অগ্রভাগের নেতা ও বর্তমানে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলির সদস্য নূহ-উল আলম লেনিন প্রতিবেদককে বলেন, স্লোগান কখনও কখনও স্বতঃস্ফূর্তভাবে কোনও মিছিল বা সমাবেশ থেকে উদ্ভাবিত হয়। এ ছাড়া পরিকল্পিতভাবেও বিভিন্ন ইস্যুতে স্লোগান তৈরি করে তা প্রচারিত ও জনপ্রিয় করে তোলার চেষ্টা করা হয়। অনেক স্লোগান আছে, যেগুলো পোস্টারের প্ল্যাকার্ডে, প্রচারপত্রে এবং দেয়ালে লিখে প্রচার ও জনপ্রিয় করার চেষ্টা করা হয়।

স্লোগানের অতীত কথা

স্লোগান হচ্ছে সমবেতভাবে উচ্চারিত ধ্বনি সমষ্টি, Motto অথবা Phrase. যার দ্বারা রাজনৈতিক, বাণিজ্যিক, ধর্মীয় ও যুদ্ধসংক্রান্ত ঘোষণা, ধারণা, দাবি-দাওয়া অথবা বিশেষ বিশেষ উদ্দেশ্য প্রকাশ করা হয়। ইংরেজি স্লোগান শব্দটি উৎসারিত হয়েছে স্কটিশ ও আইরিশ জাতিগোষ্ঠীর যুদ্ধের রণধ্বনি হিসেবে। যুদ্ধের রণধ্বনি Slogan শব্দটির ব্যুৎপত্তি Sluagh-ghairm থেকে। তবে প্রাচীনকালে যূথবদ্ধ মানুষও আক্রমণ ও আত্মরক্ষার জন্য একত্রিত হওয়ার জন্য সতর্ক সংকেত হিসেবে অর্থবোধক বিশেষ ধ্বনি বা ধ্বনিসমষ্টি উচ্চারণ করত। এ ছাড়া ধর্মীয় বা সামাজিক উৎসবে যে জিগির বা আদর্শবাণী Motto অথবা সমবেত আনন্দধ্বনি প্রকাশ করত, তাও এক ধরনের স্লোগান। স্লোগানের আভিধানিক অর্থ ‘A party catch word’। কোনও দলের বুলি। আর বাংলা ভাষায় স্লোগান শব্দের আভিধানিক অর্থ করা হয়েছে ‘মিছিলের ধ্বনি; দাবি আদায়ের জন্য একসঙ্গে বহু মানুষের ধ্বনি; জিগির।’

স্লোগানের একটা ছন্দময়তা আছে। সাধারণত স্লোগানের একটি অংশ অথবা পুরো স্লোগানটি একজন উচ্চারণ করে, পরে সমবেত জনগোষ্ঠী তা উচ্চৈঃস্বরে চিৎকার করে পুনরুচ্চারণ করে। স্লোগান যেমন কণ্ঠে উচ্চারিত ধ্বনিসমষ্টি, তেমনি লিখিতভাবেও স্লোগান প্রচারিত হয়। স্লোগান হতে পারে নানা রকম। এরমধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হলো— উদ্দীপনামূলক, দেশপ্রেমমূলক, ঘৃণা, প্রতিহিংসামূলক, দাবিমূলক, প্রত্যয়মূলক, পরিচিতমূলক ও শুভকামনামূলক ইত্যাদি।

এছাড়া, উল্লাস বা আনন্দ প্রকাশ অথবা ব্যঙ্গাত্মক নানা রকম স্লোগানও রয়েছে। সরকারও নানারকম জনসচেতনতামূলক স্লোগান প্রচার করে থাকে; যেমন ‘ছেলে হোক মেয়ে হোক, দুটি সন্তানই যথেষ্ট’, ‘কুড়িতে বুড়ি নয়, বিশের আগে বিয়ে নয়’ ইত্যাদি। ইউরোপ, আমেরিকায় গণতান্ত্রিক সংগ্রামে, ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে, আন্তঃপার্টি-সংগ্রামে বহু স্লোগান ঐতিহাসিক গুরুত্ব পেয়েছে। যেমন, ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’; অথবা Vote for all ইত্যাদি।

পরাধীন ভারতে ‘বন্দে মাতরম’ স্বদেশিদের রণধ্বনিতে পরিণত হয়েছিল। বিপরীতে মুসলিম লীগের স্লোগান ছিল ‘আল্লাহু আকবর’। কৃষক প্রজা আন্দোলন ও তেভাগা আন্দোলনের জনপ্রিয় স্লোগান ছিল, বিনা খেসারতে জমিদার প্রথা বিলোপ করো, লাঙ্গল যার জমি তার, আধি নয় তেভাগা চাই। রাজনৈতিক আন্দোলনে কংগ্রেসের জনপ্রিয় স্লোগান ছিল ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’, ‘ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক’, ‘ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ভারত ছাড়ো’, ‘নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর আজাদ হিন্দ্ ফৌজের হয় স্বাধীনতা নয় মৃত্যু’, ‘করেঙ্গে ইয়ে তো মরেঙ্গে’, ‘মুসলিম লীগের কানমে বিড়ি মুমে পান/ লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’। কমিউনিস্ট পার্টির স্লোগান ছিল ‘সমাজতন্ত্র কায়েম কর’ ও ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়, লাখো ইনসান ভুখা হ্যায়’ ইত্যাদি।

বাংলাদেশ ভূখণ্ডে ১৯৪৭ সাল থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত বিভিন্ন গণ-আন্দোলনে অসংখ্য জনপ্রিয় স্লোগান লাখ-লাখ মানুষকে উজ্জীবিত করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের স্লোগান ছিল ‘তোমার ভাষা আমার ভাষা, বাংলা ভাষা, বাংলা ভাষা’। বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের স্লোগান ছিল ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা’, ‘তুমি কে আমি কে বাঙালি বাঙালি’, ‘তোমার নেতা আমার নেতা, শেখ মুজিব শেখ মুজিব’। আর সমগ্র বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের মূল স্লোগান হয়ে ওঠে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশেও আন্দোলন ও নির্বাচনকেন্দ্রিক অসংখ্য স্লোগান উচ্চারিত হয়েছে। এর মধ্যে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে নূর হোসেন নামক একজন যুবক বুকে-পিঠে ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ স্লোগান লিখে পুলিশের গুলিতে আত্মাহুতি দিয়ে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে।-বাংলা ট্রিবিউন
১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এস.এ.সুমন/একে

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে