নিউজ ডেস্ক : ভোট নেই। তবে ভোটের রাজনীতি চাঙ্গা। আদর্শিক টানাপড়েন চলছে দুই শিবিরেই। বিএনপির রাজনীতিতে এ টানাপড়েনের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। সব দল আর মতের মানুষকে এক ছাতার নিচে আনার রাজনীতি ছিল জিয়াউর রহমানের। সুবিধাবাদিতা নাম দিয়ে কেউ কেউ তার সমালোচনাও করেছেন। তবে চরম বাম থেকে পরম ধার্মিক সবাইকে কাছে টেনেছেন তিনি। মূল উদ্দেশ্য ছিল আওয়ামী লীগ বিরোধী সব মানুষকে এক শিবিরে আনা। এ রাজনীতি বিএনপিকে সুবিধাও দিয়েছে।
ক্ষমতা আর ক্ষমতার বাইরের রাজনীতির রূপ-রস-গন্ধ আলাদা। ক্ষমতায় থাকতে যে নীতি সহযোগিতা করে বিরোধী দলে গেলে তা বুমেরাংও হয়ে যেতে পারে। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর বিএনপিকে কঠিন সময়ে পড়তে হয়েছে। সমন্বয়ের রাজনীতি বহাল রাখেন খালেদা জিয়াও। এক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষা কখনো কখনো তার জন্য কঠিন হয়েছে। কখনো বিএনপিতে ড্রাইভিং সিটে বসেছেন উদারপন্থিরা। কখনো আবার নিয়ন্ত্রণ গেছে কট্টর ডানপন্থিদের কাছে।
১৯৯১ সালের নির্বাচন জামায়াতের সঙ্গে অঘোষিত যোগাযোগ ছিল বিএনপির। ক্ষমতায় যেতে বিএনপিকে সমর্থনও জানায় জামায়াত। তবে পরে জামায়াত ক্রমশ আওয়ামী লীগের কাছাকাছি যায়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার আন্দোলনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে একযোগে রাজপথে ছিল জামায়াত। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়। চরম ভরাডুবি হয় জামায়াতের। পরে আবার জামায়াত বিএনপি শিবিরে ফিরে যায়। গড়ে ওঠে চারদলীয় জোট। এ জোট ২০০১ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে।
তবে বিএনপির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠতে থাকে দলটি ক্রমশ ডানপন্থার দিকে ঝুঁকছে। ভোটের রাজনীতিতে এ অভিযোগ বিএনপির জন্য তেমন ক্ষতি না করলেও দলটিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বন্ধুহীন করে তোলে। জঙ্গিবাদের উত্থান আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোকে ক্ষুব্ধ করে। বিএনপির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং ভারতের দূরত্ব বাড়তে থাকে। ওয়ান-ইলেভেনের পটভূমি তৈরি করতে এইসব শক্তি প্রধান ভূমিকা পালন করে।
এরপর দীর্ঘ দিন থেকেই বিশেষ করে জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক নিয়ে নানা বিতর্ক সর্বত্র। অনেকেই বিএনপিকে জামায়াত ত্যাগের পরামর্শ দিয়েছেন। তাদের কেউ কেউ বিএনপির হিতাকাঙ্ক্ষী হিসেবেও পরিচিতি। কখনো কখনো বিএনপি নেতৃত্বের মুখেও জামায়াতের সমালোচনা শোনা গেছে। দল দুটির সম্পর্কে কখনো কখনো ভাটার টানও দেখা গেছে। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত জোট এখনো ভাঙেনি। তবে এখন দল দুটি অনেকটা কৌশলগত সম্পর্ক বহাল রেখেছে।
আগামী নির্বাচনে এ জোট থাকে কি-না অথবা থাকলেও তারা কোন কৌশলে নির্বাচনে অংশ নেয় তা হবে দেখার বিষয়। গত কয়েক বছরে বিএনপির অতি ডানপন্থি ভূমিকার সমালোচনা দলটির সমর্থক অনেক বুদ্ধিজীবীই করে থাকেন। এ নিয়ে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যেও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব রয়েছে। তবে সম্প্রতি বিএনপি ঘোষিত ভিশন-২০৩০ এ দলটির অবস্থানগত পরিবর্তনের ইংগিত মিলে। দলটিকে মধ্যপন্থি অথবা উদারপন্থার দিকে নিয়ে যেতে বিএনপি নেতৃত্বের এক ধরনের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পেয়েছে ওই ঘোষণায়। এক্ষেত্রে দলটি সমর্থক বুদ্ধিজীবীদের চিন্তাধারা প্রাধান্য পেয়েছে বলে কোনো কোনো পর্যবেক্ষক মনে করেন।
আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে বিএনপির মতো অতটা না হলেও আদর্শিক টানাপড়েন ছিল। আওয়ামী লীগের বর্তমান নেতৃত্বে সাবেক কয়েকজন বামপন্থি নেতার প্রাধান্যের সমালোচনা অনেকেই করে থাকেন। তবে আওয়ামী লীগ প্রগতিশীল মহলের সবচেয়ে বেশি সমালোচনার মুখে পড়েছে দলটি যখন ধর্মভিত্তিক কোনো রাজনৈতিক দলকে কাছে টানতে চেয়েছে। অতীতে খেলাফত মজলিশের সঙ্গে দলটির সমঝোতা নিয়ে বিপুল সমালোচনা হয়েছে।
সম্প্রতি হেফাজতে ইসলাম এবং সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে স্থাপিত ভাস্কর্য ইস্যুতে অনেক আওয়ামী লীগপন্থি বুদ্ধিজীবী ও সাংস্কৃতিক কর্মী আওয়ামী লীগের সমালোচনা করেছেন। এমনকি এটাও বলা হয়েছে, সরকার হেফাজতে ইসলামকে বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে গড়ে তুলতে চাচ্ছে। মন্ত্রিসভার অন্তত তিন জন সদস্যও সরকারের সমালোচনা করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবশ্য এক বাক্যে এসব সমালোচনা নাকচ করে দিয়েছেন।
বিশেষত, পদত্যাগ না করে তিন মন্ত্রীর সরকারের সমালোচনা করার বিষয়টিও আলোচিত হচ্ছে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, কিছু কিছু ইসলামপন্থি দল ও সংগঠনের ব্যাপারে সরকারের নমনীয় নীতির পেছনে ভোটের হিসাব মুখ্য ভূমিকা রাখছে। বিশেষ করে বিএনপি-জামায়াত থেকে হেফাজত ইসলামকে দূরে রাখতে চান নীতি-নির্ধারকরা। যে কারণে দীর্ঘ দিন থেকে ক্ষমতাসীন মহল থেকে হেফাজতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রক্ষা করা হচ্ছে।
ঢাকার একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেন, আওয়ামী লীগ যে ইসলামপন্থি কোনো সংগঠন বা দলকে জোটে টানবে বিষয়টি হয়তো তা নয়। আওয়ামী লীগ চাচ্ছে আওয়ামী লীগ বিরোধী সব ভোট যেন এক ঝুড়িতে না থাকে। এটা নিশ্চিত করা গেলে নির্বাচনে দলটি সুবিধাজনক অবস্থায় থাকবে। সবমিলিয়ে আগামী নির্বাচনের আগে ভোটের রাজনীতিতে আদর্শের টানাপড়েন আরো বাড়বে। এমজমিন
জুন, ২০১৭/এমটিনিউজ২৪ডটকম/এসবি