নিউজ ডেস্ক : আন্তনগর তূর্ণা নিশীথা এক্সপ্রেস ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশে ছাড়ার সময় নির্ধারিত রাত সাড়ে ১১টা। এই ট্রেনে চড়ে চট্টগ্রামে গিয়ে সোমবার অফিস করবেন—এমন চিন্তা থেকে টিকিট কিনেছিলেন ব্যাংক কর্মকর্তা ওয়াহিদুজ্জামান। গত রোববার রাত ১১টার দিকে স্টেশনে গিয়ে জানতে পারেন, ট্রেনটি তখনো চট্টগ্রাম থেকে আসেনি। যাত্রা অনিশ্চিত। এরপর টিকিট ফেরত দিয়ে বাসায় চলে যান তিনি।
তূর্ণা নিশীথা ট্রেনটি রোববার ভোর সোয়া পাঁচটার দিকে ঢাকা থেকে ছেড়ে যায়। অর্থাৎ ট্রেনটি ঢাকা ছেড়েছে প্রায় সোয়া ছয় ঘণ্টা দেরিতে। বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মকর্তারা বলেছেন, এই ট্রেনের অধিকাংশ যাত্রীই টিকিট ফেরত দিয়েছেন। ফলে ভোরে ট্রেনটি ঢাকা ছাড়ে অনেক আসন ফাঁকা নিয়ে। ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে একই সময়ে তূর্ণা নিশীথা নামে দুটি ট্রেন চলে। এই দুটি ট্রেনেরই টিকিটের বেশ চাহিদা রয়েছে।
শুধু তূর্ণা নিশীথা নয়, ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট ও ঢাকা-নোয়াখালী পথের সব ট্রেনই দুই দিন ধরে তিন থেকে আট ঘণ্টা পর্যন্ত দেরিতে চলেছে। তবে উত্তরবঙ্গ, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও ঢাকা-ময়মনসিংহ পথের ট্রেন চলেছে মোটামুটি সময় মেনেই। রেলের কর্মকর্তারা বলেছেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে রোববার একটি মালবাহী ট্রেন লাইনচ্যুত হওয়ার কারণেই পূর্বাঞ্চলের সময়সূচিতে বিপর্যয় নেমেছে। এর জন্য কোনো আন্তনগর ট্রেনের যাত্রা বাতিল করা হয়নি। তবে দুই দিনে চারটি মেইল ট্রেনের চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে।
আজ মঙ্গলবার থেকে ট্রেনের ঈদের অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরু হচ্ছে। এই অবস্থায় সময়সূচির বিপর্যয় ভাবিয়ে তুলেছে রেল কর্মকর্তাদের। কারণ, ঈদে যাত্রী ওঠানামার জন্য যাত্রাবিরতির সময় বাড়িয়ে দেওয়া হয়। নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে ট্রেনের গতিও কমানো হয়। সময়সূচির বিপর্যয় অব্যাহত থাকলে ঈদযাত্রায় বিলম্ব আরও বাড়তে পারে।
রেলওয়ের একটি সূত্র বলেছে, আশুগঞ্জের দুর্ঘটনা ঘটেছে ভুলের কারণে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স গ্রুপ কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে রেললাইন তুলে মেরামত করছিল। এ কারণে একটি মালগাড়ি এসে লাইনচ্যুত হয়। এর ফলে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট পথে রোববার সাত ঘণ্টা ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকে। গতকাল সেখান থেকে ক্ষতিগ্রস্ত ইঞ্জিন সরানো ও মেরামতের জন্য আরও তিন ঘণ্টা ট্রেন চলাচল বন্ধ রাখা হয়। এ জন্য কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। রেলের অধিকাংশ নির্মাণ ও মেরামত প্রকল্পেই এই প্রতিষ্ঠান কাজ করছে।
রেলের পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) মকবুল আহমেদ গত রাতে প্রতিবেদককে বলেন, সময়সূচির বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা চলছে। দু-এক দিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অবহেলার অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ঠিকাদারের ভুল আছে। তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। দোষীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
রোববার রাতে তূর্ণা নিশীথা ট্রেনে চট্টগ্রামে যেতে না পারা ওয়াহিদুজ্জামানের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হয় গতকাল সন্ধ্যা সোয়া সাতটায়। তখন তিনি মহানগর প্রভাতী ট্রেনে চট্টগ্রাম যাচ্ছিলেন। তিনি বলেন, রোববার রাতে টিকিট ফেরত দেওয়ার পর সকালে অন্য ট্রেনের খোঁজ করেন। জানতে পারেন, বিকেলে একটা ট্রেন আছে। সেভাবে টিকিট কেটে ট্রেনে ওঠেন।
ওই মহানগর প্রভাতী ট্রেনটি বিকেল চারটার আগে আগে আট ঘণ্টা দেরিতে ঢাকা ছেড়েছে। ট্রেনটি ঢাকা ছাড়ার নির্ধারিত সময় হচ্ছে সকাল ৭টা ৪০ মিনিট।
রেলের বাণিজ্যিক বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, গত দুই দিনে পূর্বাঞ্চলের প্রতিটি ট্রেনেরই প্রায় অর্ধেক টিকিট ফেরত দিয়েছেন যাত্রীরা। একান্ত প্রয়োজনের যাত্রা যাঁদের, তাঁরা এক ট্রেনের টিকিট কেটে না যেতে পেরে একই পথের অন্য যে ট্রেন পাচ্ছেন উঠে যাচ্ছেন।
সিলেট যেতে জয়ন্তিকা এক্সপ্রেসের টিকিট কেটেছিলেন ব্যবসায়ী শাজাহান আলী। ট্রেনটি কমলাপুর থেকে দুপুর ১২টায় ছেড়ে যাওয়ার কথা। মুঠোফোনে খুদে বার্তার মাধ্যমে জানতে পারেন, ট্রেনটি তিন ঘণ্টা দেরিতে ছাড়বে। সে অনুযায়ী স্টেশনে গিয়ে দেখেন, তখনো ট্রেন আসেনি। পরে ট্রেনটি ৫ ঘণ্টা ৩৫ মিনিট দেরিতে কমলাপুর থেকে ছাড়ে। শাজাহান আলী বলেন, বিকেলে সিলেটে পৌঁছে কিছু কাজ সেরে রাখতে চেয়েছিলেন। সময়সূচি বিপর্যয়ের কারণে সেটা আর হচ্ছে না। মনে হচ্ছে সিলেটে এক দিন বেশি থাকতে হবে।
সিলেট পথেরই আরেক ট্রেন পারাবত এক্সপ্রেস সকালে কমলাপুর থেকে সময়মতো ছেড়ে যায়। কিন্তু পথে দেরি হওয়ায় ট্রেনটি নির্ধারিত সময়ের চেয়ে চার ঘণ্টা পর গন্তব্যে পৌঁছায়। ফলে যাত্রীরা পড়েন ভোগান্তিতে।
দেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয় ঢাকা-চট্টগ্রাম পথের সুবর্ণ এক্সপ্রেস ট্রেনটিকে। ট্রেনটি বেলা তিনটায় ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু সেটি গতকাল চট্টগ্রাম থেকেই ছয় ঘণ্টা দেরিতে ছেড়েছে। কমলাপুর স্টেশনে আসে সন্ধ্যা সোয়া সাতটার দিকে। এরপর ফিরতি যাত্রা করে। একই অবস্থা গতকালের তূর্ণা নিশীথা ট্রেনেরও। চট্টগ্রাম ও ঢাকা থেকে মহানগর গোধূলী হিসেবে যে দুটি ট্রেন যায়, সেগুলোই গন্তব্যে গিয়ে রাত সাড়ে ১১টায় তূর্ণা নিশীথা হয়ে ফিরে আসে। কিন্তু দুই দিক থেকেই গোধূলী ট্রেন দেরিতে ছেড়েছে। ফলে তূর্ণা নিশীথার যাত্রীদের গতকালও ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে।
ঠিকাদারের ভুলে সময় বিপর্যয়: আশুগঞ্জ-আখাউড়ার মধ্যে রেললাইনের সংস্কারকাজের দায়িত্ব পেয়েছে ম্যাক্স গ্রুপ। নিয়মানুযায়ী রেললাইনের সংস্কারকাজ করতে হলে আগেই অনুমতি নিতে হয়। সেই অনুযায়ী ট্রেন চলাচলের সূচি তৈরি করা হয়। রোববার ভোর ছয়টা থেকে সকাল নয়টা পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটিকে কাজের অনুমতি দেওয়া হয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি নির্ধারিত সময়ের পরও লাইন খুলে মেরামতের কাজ করে। এ সময় ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া একটি মালবাহী ট্রেন ওই স্থানে গিয়ে লাইনচ্যুত হয়।
রেলের কর্মকর্তারা বলেন, আশুগঞ্জ ও তালশহর স্টেশনের মধ্যে রেলের লাইন ইংরেজি বর্ণ ‘ওয়াই’ আকৃতির। আশুগঞ্জ হচ্ছে ওয়াইয়ের নিচের অংশে অর্থাৎ সেখানে যাওয়া-আসার একটি লাইন। আর তালশহর প্রান্তে দুটি লাইন। তালশহরের কাছে মালবাহী ট্রেনটি লাইন থেকে ছিটকে পড়লে পাশের লাইনটিও বন্ধ হয়ে যায়। ফলে দুই দিকেই ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
রেলওয়ের সূত্র বলেছে, সাধারণত রেললাইন মেরামতের সময় লাল কাপড়ের নিশান দিয়ে সাড়ে ৪০০ গজ দূরে সতর্কতাব্যবস্থা নেওয়ার নিয়ম আছে। কিন্তু দুর্ঘটনাস্থলে সেই ব্যবস্থাও ছিল না।
এ বিষয়ে ম্যাক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ আলমগীরের বক্তব্য জানতে তাঁর মুঠোফোনে ফোন দেওয়া হলেও তিনি ধরেননি। খুদে বার্তা পাঠিয়েও সাড়া মেলেনি।-প্রথমআলো
১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এস.এ.সুমন/একে