বুধবার, ২৮ অক্টোবর, ২০১৫, ০২:৫৭:৩৩

চিরকুট ও ম্যাপে হিটলিস্ট

চিরকুট ও ম্যাপে হিটলিস্ট

সরোয়ার আলম : একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার বানচাল ও দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করতে নানা পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবির। তাদের সহায়তা করছে দেশি-বিদেশি একাধিক চক্র। ইতিমধ্যে তারা কয়েকটি নাশকতায় সফলও হয়েছে। গাবতলীতে পুলিশের এএসআই ইব্রাহিম মোল্লা হত্যায় গ্রেপ্তার মাসুদ রানা ওরফে সুমনের তথ্য মতে উদ্ধার করা হয়েছে হিটলিস্ট-সংবলিত একটি চিরকুট। তাতে সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী, উপদেষ্টা, এমপি, পুলিশ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিদের টার্গেট করার কথা বলা আছে। এ ছাড়া কোন কোন স্থানে নাশকতা চালানো হবে তারও একটি ছক আঁকা হয়েছে। পুলিশ ওই ছকের একটি 'ম্যাপ' উদ্ধার করেছে গাজীপুরের বোর্ডবাজার থেকে। হিটলিস্ট ও নাশকতার ম্যাপ পেয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও কিছুটা আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠায় আছেন। নাশকতা প্রতিরোধ করতে সারা দেশে রেড অ্যালার্টের মতো সতর্কতা জারি করা হয়েছে। গতকাল সোমবার থেকে শাহজালালসহ দেশের সব কটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দর্শনার্থী প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় নজরদারি বাড়াতে পুলিশ ও র‌্যাবকে বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। পুলিশ তথ্য পেয়েছে, জামায়াত-শিবির ক্যাডাররা শ্রমিক বা বাসের হেলপার সেজে বিভিন্ন স্থানে বাসাভাড়া নিচ্ছে। তারা গ্রুপ ধরে হামলা চালানোর চেষ্টা চালাবে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল প্রতিবেদককে বলেন, 'দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে জামায়াত-শিবির চোরাগোপ্তা হামলা ও কিলিং মিশন চালানোর পাঁয়তারা করছে বলে আমরা তথ্য পেয়েছি। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন শিবির ক্যাডারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকেও এ ধরনের তথ্য পাওয়া গেছে। ক্যাডারদের প্রতিরোধ করতে সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।' একই রকম কথা বলেছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক। তিনি বলেন, পুলিশ সদস্য হত্যা মামলার আসামি শিবিরকর্মী সুমনের কাছ থেকেও আমরা তথ্য পেয়েছি-যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করতে তারা উঠেপড়ে লেগেছে। তারা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের টার্গেট করে আছে। তারা পুলিশকে মারছে, তাজিয়া মিছিলে বোমা হামলা চালিয়েছে। তিনি বলেন, এত কিছুর পরও পুলিশের মনোবল ভাঙতে পারবে না ওরা। সারা দেশে চিরুনি অভিযান শুরু হয়েছে। আমরা সতর্ক আছি। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ঢাকাসহ সারা দেশে কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যেই বড় ধরনের কয়েকটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটেছে। দুই ভয়ংকর যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি কার্যকরের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে ততই দেশের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে। পেশাদার খুনিদের পাশাপাশি উগ্রপন্থী নিষিদ্ধ সংগঠনগুলোর সদস্যরাও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। প্রায় এক মাসের ব্যবধানে ঢাকা ও রংপুরে দুই বিদেশিকে হত্যা করা হয়েছে। অবশ্য গতকাল পুলিশ দাবি করেছে, তাভেল্লা হত্যাকাণ্ডের জট খুলেছে। এখনো কুনিও হোশির হত্যার মোটিভ উদ্ঘাটিত হয়নি। চাঞ্চল্যকর এ দুটি ঘটনার রেশ না কাটতেই গত বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকার গাবতলীতে চেকপোস্টে তল্লাশির সময় দুর্বৃত্তরা ছুরিকাঘাত করে পুলিশের এএসআই ইব্রাহিম মোল্লাকে হত্যা করে। আর শুক্রবার রাতে পুরান ঢাকায় তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতিতে বোমা হামলা চালানো হয়েছে। এই দুটি ঘটনা এক সূত্রে গাঁথা বলে পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। সূত্র জানায়, গ্রেপ্তারকৃত সুমন পুলিশকে জানিয়েছে, জামায়াত-শিবিরের নেতাদের নির্দেশেই পুলিশকে হত্যা করা হয়েছে। গ্রেপ্তারের দিন রাতেই সুমনকে নিয়ে ঢাকার কামরাঙ্গীরচর ও গাজীপুরের বোর্ডবাজারে বিশেষ অভিযান চালানো হয়। সুমনের তথ্যানুযায়ী কামরাঙ্গীরচরের একটি বাসা থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাগজ ও বিস্ফোরকদ্রব্য উদ্ধার করা হয়। কাগজগুলোর মধ্যে একটি চিরকুট পাওয়া যায়। চিরকুটে কিছু তথ্য ছিল যা গা শিউরে ওঠার মতোই। রাষ্ট্রের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে হত্যা করে দেশে আরো অরাজকতা সৃষ্টি করার নির্দেশ ছিল চিরকুটে। এ ছাড়া গাজীপুরের একটি বাসা থেকে কোন কোন স্থানে হামলা চালাতে হবে তার একটি 'ম্যাপ' উদ্ধার করা হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের এক কর্মকর্তা এই প্রতিবেদককে বলেন, পুলিশ হত্যাকাণ্ডের পর দেশের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। শিবির ক্যাডাররা সারা দেশে নাশকতার ছক এঁকে রেখেছে। তারা হিটলিস্ট তৈরি করেছে। সুমন জানিয়েছে, এ রকম তালিকা অন্য নেতাদের কাছেও আছে। লিস্টে যাঁদের নাম আছে তাঁরা সবাই সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। বগুড়ার আদমদীঘি শিবিরের সভাপতি এনামুল হকের সঙ্গে কেন্দ্রীয় জামায়াত নেতাদের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ আছে। এনামুলের কথা অনুযায়ী সুমন পুলিশকে হত্যা করেছে। তারা দুর্গাপূজায় নাশকতা চালানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু পুলিশ সতর্ক থাকায় তা সম্ভব হয়নি। ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, 'সামনে আরো নাশকতার চেষ্টা হবে সে তথ্যও আমাদের কাছে আছে। এ কারণে সারা দেশে রেড অ্যালার্টের মতোই সতর্কতা জারি করা হয়েছে।' এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পুলিশের ওপর কোনো হামলা হলে তাৎক্ষণিক গুলি করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে গত রবিবার পুলিশ সদর দপ্তরে বিশেষ বৈঠক হয়েছে। এদিকে গতকাল থেকে হযরত শাহজালালসহ দেশের সব কটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সব ধরনের দর্শনার্থীর প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আর্মড ব্যাটালিয়নের সিনিয়র এএসপি আলমগীর হোসেন জানান, দেশের পরিস্থিতি বিবেচনা করে বিমানবন্দরগুলোতে ব্যাপক সতর্কতা নেওয়া হয়েছে। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত এ সতর্কতা বলবৎ থাকবে। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তথ্য ও জনসংযোগ কর্মকর্তা ম. শেফায়েত হোসেন গতকাল এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানান, বিমানবন্দরের নিরাপত্তাব্যবস্থা বিন্যস্ত করা এবং সংস্কার ও মেরামত কাজের জন্য সাময়িকভাবে দর্শনার্থীদের প্রবেশ স্থগিত রাখা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে বিমানবন্দরে রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়নি। সিলেট ওসমানী বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক হাফিজ আহমদ বলেন, 'বিমানবন্দরের ভেতরের জায়গা ছোট হওয়ায় দর্শনার্থী প্রবেশে আগে থেকেই নিষেধাজ্ঞা ছিল। তবে সেই নিষেধাজ্ঞা সব সময় আরোপ করা যেত তা। এখন একটু কঠোরভাবে মনিটর করা হবে।' বিমানবন্দরে রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমার কাছে আনুষ্ঠানিক কোনো চিঠি আসেনি। তবে আমরা নিরাপত্তা ও সতর্কতা জোরদার করেছি।' সংশ্লিষ্ট সূত্রের বরাত দিয়ে আমাদের সিলেট অফিস জানায়, রবিবার রাতে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বিমানবন্দরে বৈঠক করেন। বৈঠকের পর নিরাপত্তা জোরদারে পদক্ষেপ নেওয়া হয়। সে অনুযায়ী গতকাল সকাল থেকে বিমানবন্দরের ভেতরে ও বাইরে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। ওসমানী বিমানবন্দরের নিরাপত্তা শাখার প্রধান নির্মল বলেন, 'নিরাপত্তা জোরদার করতে বলা হয়েছে। আমরা সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়েছি।' আমাদের রাজশাহী ব্যুরো অফিস জানায়, হযরত শাহ মখদুম (র.) বিমানবন্দরে গতকাল দুপুর থেকে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক সেতাফুর রহমান জানান, বিমানবন্দরে বাড়তি নিরাপত্তার অংশ হিসাবে সিভিল এভিয়েশনের পাশাপাশি এখন থেকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও কাজ করবে। পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি শফিকুল ইসলাম প্রতিবেদককে বলেন, ঢাকা ও রংপুরে দুই বিদেশি ও পুলিশের এএসআইকে হত্যা এবং তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতিকালে বোমা হামলার পর পুলিশসহ অন্যান্য সংস্থার সদস্যরা কঠোর সতর্ক অবস্থায় আছেন। দুর্বৃত্তদের ধরতে পুলিশের বিশেষ অভিযান চালানো হচ্ছে। দেশকে যারা অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে তাদের তালিকা হয়েছে। তবে কাউকে হয়রানি করা হচ্ছে না। একই কথা বলেছেন খুলনা রেঞ্জের ডিআইজি মনিরুজ্জামান ও রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি হুমায়ুন কবির। তাঁরা বলেন, যারা নাশকতার চেষ্টা করবে তাদের প্রতিরোধ করতে পুলিশকে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এলাকাভিত্তিক বিশেষ অভিযান চালানো হচ্ছে।-কালের কণ্ঠ ২৮ অক্টোবর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এস.এ.সুমন/একে

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে