কিশোরগঞ্জ থেকে: ঈদের আর মাত্র ৫ দিন বাকি। এরিই মধ্যে দেশের সর্ববৃহৎ ঈদ জামাতের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দান। সুষ্ঠুভাবে ঈদ জামাত আয়োজনের জন্য শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠ পরিচালনা কমিটির গ্রহণ করা ঈদগাহ মাঠ প্রস্তুতকরণের কাজ এগিয়ে চলেছে পুরোদমে। কিন্তু এ মাঠের ঐতিহ্য ও সুনাম রক্ষায় দীর্ঘদিনেও কোন উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না।
প্রস্তুতি তদারকির অংশ হিসেবে আজ দুপুরে শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠ কমিটির সভাপতি ও কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. আজিমুদ্দিন বিশ্বাস মাঠ পরিদর্শন করেছেন। এ সময় আরোও উপস্থিত ছিলেন, জেলা পুলিশ সুপার মো. আনোয়ার হোসেন খান, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) তরফদার মো. আক্তার জামীল, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কিশোরগঞ্জ পৌর মেয়র মাহমুদ পারভেজ, মাঠ কমিটির সদস্যসচিব ও কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলা পরিষদের নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মাসউদসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
মাঠ পরিদর্শনের সময় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠ কমিটির সভাপতি ও কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. আজিমুদ্দিন বিশ্বাস বলেন, প্রতিবারের মতো এবারও শোলাকিয়ায় দেশের সর্ববৃহৎ ১৯০তম ঈদ-উল-ফিতরের জামাত অনুষ্ঠিত হবে। সুষ্ঠুভাবে জামাত অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে গত ২৮ই মে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রস্তুতিমূলক কর্মকান্ড ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। ঈদগাহ ময়দানজুড়ে কাতারের লাইন টানা, মাঠ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করণ ও ধোয়া-মোছার কাজ পুরোদমে চলছে। মাঠে পানি সরবরাহ, পয়নিষ্কাশন ব্যবস্থা উন্নয়নসহ মুসলি¬দের নামাজ পড়ার উপযোগী করে তোলার জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে।
জেলা প্রশাসক আরও জানান, এবারের ১৯০তম ঈদুল ফিতরের জামাতের ইমামতি করবেন ইসলাহুল মুসলিহীন পরিষদের চেয়ারম্যান মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ। তিনি আরো বলেন দূর-দূরান্ত থেকে আসা মুসলি¬দের সুবিধার্থে বাংলাদেশ রেলওয়ে বরাবরের মতো এবারও ঈদ-উল-ফিতরের দিন ‘শোলাকিয়া ঈদ স্পেশাল’ নামে ২টি বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করেছে। তিনি আরোও বলেন, অন্যবারের তুলনায় এবারের ঈদ জামাত আরও বেশি উৎসবমুখর হবে বলে আশা করছি। ঐতিহ্যবাহী এ ঈদ জামাতে অংশগ্রহণের জন্য দেশবাসীকে জেলা প্রশাসন ও কিশোরগঞ্জের পক্ষ থেকে সাদর আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।
অন্যদিকে জেলার পুলিশ সুপার মো. আনোয়ার হোসেন খান বলেন, আমরা ইতি মধ্যেই এই শোলাকিয়া মাঠে নিরাপত্তার জন্য পুলিশ মোতায়েন করেছি। এছাড়া ঈদেরদিন জামাতকে ঘিরে পর্যাপ্ত নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থার প্রস্তুতিও রাখা হয়েছে। মাঠে বসানো হবে সিসি ক্যামেরা। যাতে করে কেও কোন ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করতে না পারে এ জন্য সাদা পোশাকদারী গোয়েন্দা পুলিশ থাকবে। আগত মুসুল্লিরা মাঠে প্রবেশের সময় তাদের কে চেক করা হবে। আর মাঠে থাকবে ওয়াচ টাওয়ার।
কিশোরগঞ্জ জেলা শহরের পূর্বপ্রান্তে নরসুন্দা নদীর তীর ঘেঁষে অবস্থিত প্রাচীন এবং ঐতিহ্যবাহী এ শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানে এ বছর ১৯০তম ঈদ জামাত অনুষ্ঠিত হবে। কিশোরগঞ্জ মৌজার এ মাঠের মূল আয়তন বর্তমানে ৬.৬১ একর। চারপাশে অনুচ্চ প্রাচীর ঘেরা শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠে মোট ২৬৫টি কাতার রয়েছে, যেখানে একসঙ্গে দুই লক্ষাধিক মুসল্লি নামাজ আদায় করেন। এছাড়া মাঠে স্থান সংকুলান না হওয়ায় ঈদগাহ সংলগ্ন খালি জায়গা, রাস্তা এবং নিকটবর্তী এলাকায় দাঁড়িয়ে সমসংখ্যক মুসল্লি এ বৃহত্তম ঈদজামাতে শরিক হন। প্রতি বছরই জামাতের কলেবর বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ছে এ মাঠের সুনাম। শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানের আকর্ষণীয় ও বিশাল জামাত একইসঙ্গে গৌরবান্বিত ও ঐতিহ্যশালী করেছে কিশোরগঞ্জকে। এরপরেও মুসল্লিদের স্থান সংকুলান, অবকাঠামো উন্নয়নসহ আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধার উন্নত ব্যবস্থা এখনও গড়ে ওঠেনি। ঈদগাহ মাঠের স্থায়ী উন্নয়নের জন্য মহাপরিকল্পনার কথা প্রায়শই শোনা গেলেও এটি কাগজে-কলমেই থেকে যাচ্ছে।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, পাকিস্তান আমলে এ মাঠের চারদিকে নিচু দেয়াল নির্মাণ ও দোতলা মিম্বর নির্মাণ করা হয়। এরপর ১৯৭৫ সালে ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার খানে আলম খান মাঠের সীমানা প্রাচীর ও গেট নির্মাণ করেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার আসার পর তৎকালীন এলজিআরডি মন্ত্রী প্রয়াত রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে মাঠের মাইকিং সিস্টেমের উন্নয়ন, মিনার সংস্কার, মাঠে প্রবেশের প্রধান তোরণ নির্মাণ, ৪৫টি ওজুখানা, ১৫টি প্রস্রাবখানা ও পাঁচটি টয়লেট নির্মাণে ভূমিকা রাখেন। সাম্প্রতিক সময়ে মাঠের মিম্বরটির কিছুটা সংস্কার ছাড়া মাঠের স্থায়ী উন্নয়নে তেমন কোন উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। শোলাকিয়ায় মুসল্লিদের মাটিতেই জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজ আদায় করতে হয়। বৃষ্টি হলে কর্দমাক্ত মাঠে নামাজ আদায়ে মুসল্লিদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। এছাড়া প্রতি জামাতেই মুসল্লি¬র সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। ফলে মাঠে স্থান সংকুলান না হওয়ায় বিপুল সংখ্যক মুসল্লি নামাজ না পড়েই বাধ্য হয়ে ফেরত যান।
স্থান সংকুলান না হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে স্থানীয় বাসিন্দা মঞ্জিল মিয়া বলেন, লাখ লাখ মুসল্লি এখানকার ঈদ জামাতে অংশগ্রহণ করতে বিভিন্ন এলাকা থেকে এখানে ছুটে আসেন। কিন্তু স্থান সংকুলান না হওয়ায় আশপাশের বাড়ির উঠানে, রাস্তায়ও মুসল্লিরা নামাজ আদায় করেন। প্রতি বছরই মুসল্লির সংখ্যা বাড়ছে। তাই এই মাঠে স্থান সংকুলান না হওয়ায় নামাজ না পড়েই অনেক মুসল্লি বাধ্য হয়ে ফেরত যান। বারবার আশ্বাসের পরও উন্নয়ন না হওয়ায় ক্ষোভ প্রখাশ করে স্থানীয় বাসিন্দা আবদুল করিম বলেন, এ মাঠে অনেক সমস্যা বিরাজমান। তাই মুসল্লিরা নামাজ পড়তে ভোগান্তির মধ্যে পড়েন। সমস্যাগুলোর দ্রুত সমাধান প্রয়োজন। কিশোরগঞ্জকে দেশ-বিদেশে পরিচিত করেছে শোলাকিয়া ঈদগাহ। কিন্তু ২৬৬ বছরের পুরাতন শোলাকিয়া ঈদগাহটি ঐতিহ্যের তুলনায় উন্নয়ন ও সংস্কারের ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে ঈদগাহ পরিচালনা কমিটি থাকলেও এর কার্যক্রম কেবল ঈদকেন্দ্রিক হওয়ায় সারা বছর রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রে কোন তৎপরতা পরিলক্ষিত হয় না। ঈদগাহের সম্মুখস্থ পৌরসভার নিয়ন্ত্রণাধীন গরুর হাটটি মাঠের অনুকূলে ব্যবহার ও বরাদ্দের দাবি দীর্ঘদিনেও পূরণ হয়নি।
এছাড়া মাঠের আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণে কোন ধরনের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় দূরদূরান্ত থেকে আগত মুসল্লিদের কাঙিক্ষত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হচ্ছে না। এ মাঠের সুনাম এবং গুরুত্বকে আরও অর্থবহ ও ঐতিহ্যমন্ডিত করার স্বার্থেই এখানকার সার্বিক ব্যবস্থাপনা আরও গতিশীল ও কার্যকর হওয়া দরকার বলে মনে করেন স্থানীয়রা।
২২ জুন ২০১৭/এমটিনিউজ২৪/হাবিব/এইচআর