সোহরাব হাসান : গত বছর ঈদের আগে গুলশানের হলি আর্টিজানে জঙ্গিরা নৃশংস হামলা চালিয়ে ২০ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করে। এরপর ঈদের দিন শোলাকিয়ায় জঙ্গিদের হামলায়ও পুলিশসহ একাধিক মানুষ মারা যায়।
এই প্রেক্ষাপটে অনেকের মনেই শঙ্কা ছিল যে এবারের ঈদে কী হয়। কিন্তু শেষমেশ সব শঙ্কা দূর করে ভালোয় ভালোয় ঈদ উদ্যাপিত হয়েছে। এটি দেশবাসীর জন্য স্বস্তিদায়ক খবর।
ঈদে যাতে কোনো অঘটন না ঘটে, সে জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আগে থেকেই নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করে। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন, শীর্ষ জঙ্গিরা গ্রেপ্তার হওয়া ও মারা পড়ায় তাদের নেটওয়ার্ক অনেকটা ভেঙে পড়েছে এবং বড় ধরনের হামলা চালানোর শক্তি তাদের নেই।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি পুরো আস্থা রেখেই বলব, জঙ্গিরা দুর্বল হয়েছে, এ কথা ভেবে আত্মতুষ্টির কোনো সুযোগ নেই—মওকা পেলেই তারা ফের মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। তাই ঈদে অঘটন ঘটেনি বলেই নিশ্চিত করে বলা যাবে না যে বাংলাদেশ জঙ্গিমুক্ত হয়েছে। জঙ্গিদের বিরুদ্ধে লাগাতার অভিযান সত্ত্বেও বিভিন্ন স্থানে তাদের বিক্ষিপ্ত তৎপরতা লক্ষ করা যাচ্ছে।
দ্বিতীয়ত, জঙ্গিবাদ মূলত একটি বৈশ্বিক রাজনৈতিক সমস্যা। জঙ্গিবাদ নির্মূল করতে হলে এর কারণগুলো দূর করতে হবে? জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষকদের চিহ্নিত করতে হবে। যে অপরাজনৈতিক দর্শন মানুষকে জঙ্গি বানায়, সেই দর্শনকে পরাস্ত করতে না পারলে জঙ্গিবাদকে নির্মূল করা যাবে না।
তাই জঙ্গিদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের পাশাপাশি রাজনৈতিক লড়াইটাও জারি রাখতে হবে। কবি নির্মলেন্দু গুণের একটি বইয়ের নাম ছিল, ‘সবার আগে চাই সমাজতন্ত্র’। আর এ ক্ষেত্রে সবার আগে ‘চাই রাজনৈতিক ঐকমত্য।’ জঙ্গি নামের অপশক্তির বিরুদ্ধে দলমত-নির্বিশেষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
অতীতে জাতীয় রাজনীতির অনৈক্য ও বিভেদের সুযোগ নিয়ে তারা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। সরকারের জঙ্গিবিরোধী কঠোর অবস্থান সত্ত্বেও যখন দেখি আটক বহু জঙ্গি জামিন নিয়ে জেলখানা থেকে বেরিয়ে আসছে, জেলখানায় আটক থাকা অবস্থায় সহবন্দীদের জঙ্গিবাদে দীক্ষিত করছে, তখন শঙ্কিত না হয়ে পারা যায় না। যেখানে বিরোধী দলের নেতারা জামিন পান না, সেখানে জঙ্গিরা কীভাবে জামিন পায়? এসব মামলার তদন্তই বা কেন মাসের পর মাস ঝুলে থাকে? তাহলে কী সরষের ভেতরেই ভূত আছে?
বরাবরের মতো এবারও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করেছেন। এই ‘সর্বস্তরের’ মানুষের মধ্য আবার মিলের চেয়ে অমিলের ভাগ বেশি। অর্থাৎ যারা প্রধানমন্ত্রীর শুভেচ্ছা বিনিময় অনুষ্ঠানে যান, তারা বিএনপি চেয়ারপারসনের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পান না। একইভাবে যারা বিএনপি চেয়ারপারসনের অনুষ্ঠানে যান, তারাও প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠানে বাঞ্ছিত নন। দুই আয়োজনের মধ্যে সম্ভবত বিদেশি কূটনীতিকেরাই একমাত্র অভিন্ন অতিথি। যেসব কূটনীতিক অনেক বছর ধরে বাংলাদেশে আছেন, তারা নিশ্চয়ই বিষয়টি উপভোগ করছেন।
আবার অনেকে আছেন, দুই আয়োজনেরই বাইরে থাকেন। তাদের ‘নিরপেক্ষ’ বলে সরকার ও বিরোধী দল উভয় পক্ষ উপহাস করেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিটা হয়েছে, হয় আপনি ‘এ’ দলে থাকবেন, নাহয় ‘বি’ দলে। ‘এ’ দলের লোকেরা ‘বি’ দলকে শত্রু ভাবে। ‘বি‘ দলের লোকেরা ‘এ’ দল সম্পর্কেও একই মনোভাব পোষণ করে। এই ধারণাটি কেবল দলীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে সীমিত থাকলে সমস্যা হতো না। এখন প্রায় সব পেশাজীবীর মধ্যে ঢুকে পড়েছে। অদূর ভবিষ্যতে বিদেশি কূটনীতিকদের স্পর্শ করতে পারে।
সোমবার গণভবনে সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়কালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘এ বছর কোনো প্রকার অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই শান্তিপূর্ণ পরিবেশে পবিত্র ঈদুল ফিতর উদ্যাপিত হওয়ায় আমি মহান আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।’ তিনি বলেন, প্রত্যেকে সচেতন হওয়ায় এবং শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ঈদ উদ্যাপনে তাদের আন্তরিক প্রচেষ্টা চালানোর কারণে এটি সম্ভব হয়েছে। মানুষ আনন্দমুখর পরিবেশে ঈদ উদ্যাপন করছে।’
অন্যদিকে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলনে কেন্দ্রে সর্বস্তরের নাগরিকদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় অনুষ্ঠানে বলেছেন, সাধারণত বিপুল উৎসবের মধ্য দিয়ে সব সময় ঈদ উদ্যাপিত হয়। কিন্তু এবার দেশে ঈদের কোনো আনন্দ নেই। নিত্যপ্রয়োজনীয় চাল, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির দাম বৃদ্ধিতে কারও মনে কোনো আনন্দ নেই। উৎসবমুখর পরিবেশ এবার ছিল না।’
একজন বলেছেন, মানুষ আনন্দের সঙ্গে ঈদ উদ্যাপন করেছে। আরেকজন বলেছেন, মানুষের মনে আনন্দ ছিল না। অর্থাৎ ঈদ ছিল নিরানন্দ। মানুষ কোনটি বিশ্বাস করবে? মানুষ আনন্দের সঙ্গে ঈদ উদ্যাপন করেছেন, এ কথা যেমন সত্য, তেমনি অসত্য নয় অনেকেই এই ঈদ খুশির বার্তা বয়ে আনতে পারেনি। বিশেষ করে হাওরের বানভাসি ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে পাহাড়ধসা মানুষ।
বিএনপি ১০ বছরের বেশি সময় ধরে ক্ষমতার বাইরে। তাই এ সময়ে যেসব দুর্নীতি ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে, তার কথা খালেদা জিয়া দেশবাসীকে জানাবেন, সেটাই স্বাভাবিক। একই সঙ্গে এই প্রশ্নটিও আসবে, তার সময়ে কী দুর্নীতি, অপশাসন ও বিরোধী দলের ওপর দমন-পীড়ন ছিল না? ছিল। এ কথার অর্থ এই নয় যে বিএনপি আমলে দুর্নীতি, অপশাসন ও বিরোধী দলের ওপর দমন-পীড়ন ছিল বলে এখনো থাকতে হবে। একটি অন্যায় কাজ কখনোই আরেকটি অন্যায় কাজের অজুহাত হতে পারে না। মানুষ সামনে এগোয়। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতি ক্রমাগত পেছনে হাটে।
শুভেচ্ছা বিনিময় অনুষ্ঠানে খালেদা জিয়া সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে ভবিষ্যতে ক্ষমতায় এসে বর্তমান ‘দুঃশাসন’ থেকে দেশবাসীকে মুক্তি দেওয়ার আশ্বাস দিচ্ছেন। কিন্তু দেশবাসী এই আশ্বাসে কতটা আশ্বস্ত হবেন। প্রতিবারই তারা তপ্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত চুল্লিতে পড়েন।
তবে তিনি সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ যে কথাটি বলেছেন, তা হলো ‘দিন দিন মানুষের মধ্যে ব্যবধান বাড়ছে।’ কিন্তু দিন দিন মানুষের মধ্যে ব্যবধান যে বাড়ছে, তা মোকাবিলায় কোনো কার্যকর পদক্ষেপ কি তার সরকার কখনো নিয়েছিল? বরং তার কিংবা বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের সরকারের নীতিই ছিল ধনীকে আরও ধনী এবং গরিবকে আরও গরিব বানাও। এমনকি খালেদা জিয়ার সদ্যঘোষিত ভিশন ২০৩০-এও ধনীকে আরও ধনী করার বিপরীত কোনো অর্থনৈতিক কর্মসূচি আছে বলে মনে হয় না। প্রথম আলো
জুন, ২০১৭/এমটিনিউজ২৪ডটকম/এসবি