তসলিমা নাসরিন : তিরিশ বছর আগে একবার বলেছিলাম রবীন্দ্রনাথকে আমার ঈশ্বর বলে মনে হয়। ঈশ্বর তো তিনিই, যাঁর জ্ঞানের আর গুণের কোনও সীমা নেই। রবীন্দ্রনাথের গানে দীর্ঘ দীর্ঘ কাল বুঁদ হয়ে থাকলে এমনই মনে হয়। রবীন্দ্রনাথকে ঈশ্বর বলেছিলাম বলে কোথাও কোনও তান্ডব হয়নি।
কেউ আমার মুন্ডু কেটে নেওয়ার জন্য লাফায়নি। আমার রূপসী খালাকে দূর্গা দেবী বলে ডাকলেও কেউ চিৎকার করে না। আমার ভাইপো চুল দাড়ি না কেটে এমন চেহারা বানিয়েছে যে, আমি প্রায়ই বলি, তুই এখন একেবারেই যীশুর মতো দেখতে। প্রকাশ্যেই বলি আমার বাবাটা ছিল সাক্ষাৎ ভগবান, নিজের কথা কিছু ভাবেনি, কেবল মানুষের কথা ভেবেছে। কিন্তু যদি বলি ‘আমার আব্বা আমার আল্লাহ’, তাহলেই সমস্যা।
তাহলেই আমি শির্ক করেছি। শির্ক করা অমার্জনীয় অপরাধ। পরকালে আমি দোযখে যাবো, ইহকালে আমার গর্দান যাবে। মীর যদি ‘আমার আব্বা আমার আল্লাহ’ না বলে বলতেন ‘আমার আব্বা আমার ঈশ্বর’, তাহলে কোনও সমস্যা হতো না। কেউ আর মীরকে মারতে আসতো না। ঈশ্বর এবং আল্লাহ মীরের কাছে হয়তো একই, কিন্তু মূর্খদের কাছে এক নয়।
আল্লাহ নামটি জগতের সবাই শ্রদ্ধাভরে উচ্চারণ করে না। ২০০১ সালে আমেরিকায় মুসলিম সন্ত্রাসীদের হামলার পর বিশেষ করে। ক্রিশ্চান- ইহুদি-হিন্দু মৌলবাদি আর মুসলিম -বিদ্বেষী চরম ডানপন্থীরা আল্লাহকে গালাগালি করে ভাসিয়ে ফেলে। জিহাদি সন্ত্রাসীরা 'আল্লাহু আকবর' বলতে বলতে চাপাতি চালিয়ে নিরীহ মানুষকে খুন করে।
কোথাও 'আল্লাহু আকবর' চিৎকার শুনলে মানুষ আজকাল ভয়ে উল্টোদিকে দৌড়োয়। মীর কিন্তু আল্লাহ নামটি কাউকে হত্যা করতে করতে, ঘৃণা করতে করতে, কাউকে অবজ্ঞা-অপমান করতে করতে উচ্চারণ করেননি। মীর তাঁর বাবাকে ভালোবেসে 'আল্লাহ' নামে ডেকেছেন। মীরকে অপরাধী বলা মানে ভালোবাসাকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা।
আল্লাহর সঙ্গে নিজের বাবার তুলনা করে মীর শির্ক করেছেন! কিন্তু শির্ক তো আমরা প্রতিদিন করছি। যখন মুরব্বিদের কদমবুসি করি, যখন তাদের সামনে মাথা নোয়াই, তখনই তো শির্ক করি। ইসলাম বলেছে, আল্লাহ ছাড়া আর কারও সামনে মাথা নত না করতে। এই মাথা নোয়ানো আমাদের সংস্কৃতির অংশ। আমাদের শ্রদ্ধাভাজনদের আমরা এভাবেই শ্রদ্ধা প্রদর্শন করি।
আবহমানকাল ধরে বাংলায় এই সংস্কৃতিরই চর্চা করেছে বাঙালিরা। ধর্মান্তরিত হলেই তো সংস্কৃতি বদলে যায় না। আমাদের পোশাক আশাক, আমাদের গান বাজনা, খাবার দাবার, আমাদের আদব কায়দা -- সবই মূলত বাংলার, ইসলামের জন্মভূমির নয়। যে কাজকে আরবের লোকেরা শির্ক বলে, বাংলার মাটিতে আমরা সে কাজকে শির্ক বলি না।
বাঙালি মুসলমানদের জীবন যাপন দেখলে আরবের মুসলমানরা সম্ভবত বলবে, এরা মুসলমানই না। বাঙালি মুসলমানও হয়তো নাইজেরিয়ার মুসলমানদের দেখে বলবে এরা সহি মুসলমান নয়। এতে কার কী এলো গেলো! ধর্মটা নিজের মতো করেই সবার পালন করা উচিত। কে কতটা আল্লাহকে ভালবাসলো, কিছুটা কম বাসলো কি না, কীভাবে ভালোবাসলো, কী পদ্ধতিতে বাসলো, তা নিয়ে নাক না গলালেই, তা নিয়ে চেঁচামেচি খুনোখুনি না করলেই কিন্তু শান্তি বজায় থাকে।
মুশকিল হলো মুসলমানরা বিধর্মীদের ধর্মান্তরিত করতে পারলে আখেরাতে পুরস্কৃত হবে বলে বিশ্বাস করে। বিশ্বাস করে কাউকে বিপথ থেকে আল্লাহর পথে আনতে পারলে নেকি কামানো হবে। এই পুরস্কারের জন্য, নেকি কামানোর জন্য, ঘরে ঘরে ধর্মান্ধরা ইসলামি দাওয়াত নিয়ে ঢুকছে। ভিন্ন মত ধারণ করার কোনও অধিকার আর কারওর নেই। এভাবে কি ধর্ম বেঁচে থাকে?
মানবাধিকারকে পায়ে মাড়িয়ে, সভ্যতাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে, বাকস্বাধীনতাকে বিলোপ করে যে ধর্ম বেঁচে থাকে, সে ধর্ম চলে যায় জিহাদিদের হাতে, অসভ্য অশিক্ষিত, মোল্লা, মূর্খদের হাতে। প্রগতিশীলরা ধীরে ধীরে খুন হয়ে যেতে থাকে, নির্বাসনে চলে যেতে থাকে। সভ্য দুনিয়ায় চলতে হলে মানবিক হওয়া ছাড়া ইসলামের আর কোনও পথ নেই।
লেখক : বাংলাদেশের প্রখ্যাত নির্বাচিত লেখিকা।
জুন, ২০১৭/এমটিনিউজ২৪ডটকম/এসএস