নিউজ ডেস্ক : ক্রেতাদের গুঞ্জন আর সেঁকা গরম রুটির গন্ধে গমগম করছে হলি আর্টিজান বেকারি। ঢাকার অভিজাত এলাকায় অবস্থিত এই ক্যাফেটিতে ঠিক এক বছর আগে যে নৃশংস দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিল, তা ভুলে থাকা এখন বেশ সহজ।
তবে, এক বছর পর আজও সেই প্রাণঘাতী জিম্মিদশার আঁচ টের পাওয়া যায়। এ নিয়ে বার্তাসংস্থা এএফপি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়, বন্দুক ও ছুরিসমেত ৫ তরুণ ১লা জুলাই এই ক্যাফেতে তাণ্ডব চালায়। কয়েক ডজন লোককে জিম্মি বানিয়ে ২২ জনকে তারা হত্যা করে।
বেশিরভাগ ভিকটিম ছিলেন বিদেশি। এদের অনেককেই বেশ নিষ্ঠুরভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। বেকারিটি পরে নতুন একটি স্থানে আবার খোলা হয়। কিন্তু এক বছর পর এখনো ক্যাফের বিখ্যাত রুটি, কুকি ও পেস্ট্রির জন্য অতিথিরা সেখানে গমগম করছে।
বাংলাদেশে পাঁচ বছর ধরে বসবাস করছেন মার্কিন নাগরিক লরা জেনকিন্স। মাত্র সেঁকা ক্রয়স্যান্ট হাতে নিতে নিতে বললেন, ‘এই জায়গা ফিরে পাওয়াটা দারুণ একটা ব্যাপার। এই ক্যাফে ফের খোলা আসলে সাহসিকতার নিদর্শন।’
ক্যাফের মালিক সাদাত মেহেদি বলেন, ক্যাফেটি ফের খোলার ব্যাপারে তার সিদ্ধান্ত সার্থক। নিয়মিত অতিথিরা আগের মতোই আসছেন দল বেঁধে। মূলত, অভিবাসী ও কূটনৈতিক পাড়ায় বসবাসরত ধনী বাংলাদেশিরাই ক্যাফের নিয়মিত অতিথি। তিনি আরো বলেন, ‘তাদের সাড়া আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা।’
সেদিন জিম্মিদশায় আটকা পড়া অনেকেই ছিলেন বিদেশি যারা দেশের গার্মেন্ট শিল্পে কাজ করতেন। ৩০০০ কোটি ডলারের এই শিল্প দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। হামলাটি ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ জঙ্গি হামলা।
হামলার দায় স্বীকার করেছিল জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস)। কিন্তু বাংলাদেশ জোর দিয়ে বলেছে, এটি স্থানীয় একটি চরমপন্থি গোষ্ঠীর কাজ, যারা আগের ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী। এই হামলার আগে বাংলাদেশে বিদেশি ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নৃশংস ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ড চালানো হয়। এর ফলে অনেকেই ব্যাংককে পালিয়ে যান।
কিন্তু ব্যবসায়িকভাবে আকর্ষণীয় গার্মেন্ট শিল্পে এই হামলার প্রভাব নিয়ে আতঙ্ক বাড়ায় সরকারি বাহিনীগুলো ইসলাম-মতবাদী চরমপন্থি গোষ্ঠীগুলোর ওপর নজিরবিহীন অভিযান শুরু করে। গত এক বছরে তাদের হাতে নিহত হয়েছে প্রায় ৭০ জন সন্দেহভাজন চরমপন্থি। এদের একজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান নাগরিক। অভিযোগ রয়েছে, সেই ব্যক্তিই ক্যাফে হামলার মূল হোতা। এছাড়া গ্রেপ্তারও করা হয়েছে আরো অনেককে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এএফপিকে বলেন, বাংলাদেশের মানুষ ‘জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান’ নিয়েছে। তার ভাষ্য, ‘তাদের আর অত শক্তি নেই। ধীরে ধীরে আমরা তাদের শক্তি শেষ করে দিতে সক্ষম হয়েছি।’ কিন্তু সবাই এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত নয়। সমালোচকদের অভিযোগ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ধর্মনিরপেক্ষ সরকার এই হামলাগুলো ব্যবহার করে ঘরোয়া বিরোধী দলগুলোর ওপর নিপীড়ন চালিয়েছে।
নিরাপত্তা ও সন্ত্রাসবাদ বিশেষজ্ঞ শাহাব এনাম খান বলেন, ‘যেকোনো টেকসই সন্ত্রাসবাদ-বিরোধী প্রচেষ্টায় গণতান্ত্রিক সাড়া প্রয়োজন। সেটি হলো মূলত এই প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ। অন্যথায় দেশে দীর্ঘদিন ধরে বিরাজমান রাজনৈতিক বিবাদকে সবসময় পুঁজি করবে চরমপন্থিরা।’
হামলার পর দেশ ছেড়ে যাওয়া বেশিরভাগ বিদেশিই আবার ফিরেছেন। নিরাপত্তা পরিস্থিতির অগ্রগতি ও রাস্তাঘাটে সরকারি বাহিনীর দৃশ্যমান উপস্থিতি বৃদ্ধিতে তারা আশ্বস্ত হয়েছেন। অনেক বিলাসবহুল রেস্তরাঁ ও ক্লাবে এখন সশস্ত্র রক্ষী ও প্রবেশপথে বালুর বাঁধ রাখা হয়েছে। অভিবাসীরা বলছেন, এসব পদক্ষেপ কিছুটা স্বস্তি নিয়ে এসেছে। তবে এর জন্য কিছুটা মূল্যও চুকাতে হয়েছে।
বৃটিশ নাগরিক অ্যান্ডি ফ্রড বলেন, ‘একটা বাংকারের পেছনে একটা লোক অটোমেটিক রাইফেল হাতে দাঁড়িয়ে আছে। সকালের চা খাওয়ার সময় এটা সেরা দৃশ্য নয়। কিন্তু আমি অন্তত জানি যে, সে আমার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করছে।’
হলি আর্টিজান ক্যাফের বাইরে ব্যাপক সশস্ত্র পুলিশের টহল বারবার ১লা জুলাইয়ের রাতের কথা মনে করিয়ে দেয়। সেদিনকার হামলায় বেঁচে যাওয়া ক্যাফের বিক্রয় ব্যবস্থাপক শাহরিয়ার আহমেদ বলেন, সেই রাতের স্মৃতি এখনো তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়।
তার ভাষ্য, ‘প্রায়ই দুঃস্বপ্ন হয়ে এটি ফিরে আসে। কিন্তু আমি এটা ভুলে যেতে চাই। এসব ভয়াবহ স্মৃতি অতিক্রম করতে আমরা একে অপরকে সাহায্য করছি। সাধারণ জীবনযাপন করতে আমরা আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।’ এমজমিন
জুন, ২০১৭/এমটিনিউজ২৪ডটকম/এসবি