নিউজ ডেস্ক : ১লা জুলাই ২০১৬। রাত প্রায় পৌনে ৯টা। হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে সন্ত্রাসী হামলার পর বিদ্যুৎবেগে এ খবর ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। শুরুতে ঘটনার ভয়াবহতা আঁচ করতে পারেননি অনেকে।
গণমাধ্যম কর্মীদেরও ধারণায় ছিল না জঙ্গিদের এমন বীভৎসতার বিষয়। তবে সময় যত বাড়ে তত পরিষ্কার হতে থাকে নজিরবিহীন হামলার বিভীষিকাময় চিত্র। জঙ্গিরা ‘আল্লাহু আকবার’ স্লোগান দিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি ও বোমাবর্ষণ করছিল। আতঙ্কে লোকজন দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করছে।
সন্ত্রাসীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে গ্রেনেড নিক্ষেপ ও গুলিবর্ষণ করছে। পাল্টা গুলি করছে র্যাব-পুলিশ। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, সেখানে তখন যুদ্ধ চলছিল। পুলিশের সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়। ততক্ষণে জঙ্গিদের গুলিতে আহত হন গুলশান থানার এসআই ফারুক হোসেনসহ কয়েকজন পুলিশ সদস্য। আহত পুলিশ সদস্যকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
৭৯ নম্বর সড়কে তখন মানুষের ভিড়। তারা প্রায় সবাই হলি আর্টিজানে আটকে পড়াদের স্বজন। আশপাশের বাসা ছেড়ে বাইরে বের হয়েছেন নারী-শিশুরা। তারা এলাকা ছেড়ে যাচ্ছেন। সবার মধ্যে উদ্বেগ। চোখে-মুখে আতঙ্কের ছাপ। কান্না করছেন অনেকে। কী হচ্ছে ভেতরে, তাদের স্বজনের কোনো সন্ধান পাওয়া গেছে কিনা- এরকম তথ্য জানতে চাচ্ছেন উপস্থিত নারী-পুরুষরা।
দ্রুত ঘটনাস্থলে ছুটে যান ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া, র্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদসহ দুই বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। পুলিশ ও জঙ্গিদের মধ্যে বেশ কিছুক্ষণ গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে। পুলিশ ও র্যাব সদস্যরা গুলশান লেকের পাশের হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টটি ঘেরাও করে অভিযানের প্রস্তুতি নেন।
তবে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সতর্ক দৃষ্টি। ভেতরে জিম্মি দেশি-বিদেশি নাগরিকদের উদ্ধারে তৎপর তারা। কর্মকর্তাদের নির্দেশে জিম্মিদের উদ্ধারের জন্য প্রাণপণ চেষ্টার কমতি নেই। এগিয়ে যান র্যাব-পুলিশ সদস্যরা। এরই মধ্যে হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টের মূল গেটে প্রবেশের চেষ্টা করে পুলিশ। বিকট শব্দে তখন কেঁপে উঠে চারপাশ।
মুহুর্মুহু গুলি-গ্রেনেড বিস্ফোরণের শব্দ। এরমধ্যেই জঙ্গি হামলায় মাটিতে লুটিয়ে পড়েন মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সহকারী কমিশনার রবিউল ইসলাম ও বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সালাহউদ্দিন খান। আবছা অন্ধকারে ধোঁয়ার মধ্যে রেস্টুরেন্টের পাশের রাস্তায় পড়েছিল সালাহউদ্দিনের নিথর দেহ। কয়েক মিনিটের মধ্যে গুলশান থানা পুলিশ তাকে উদ্ধার করে।
ওসি সালাহউদ্দিনকে ইউনাইটেড হাসপাতালে নিয়ে গেলে রাত ১১টা ২০ মিনিটে তাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা। এর কিছুক্ষণ পর একই হাসপাতালে মারা যান ডিবি’র সহকারী কমিশনার রবিউল ইসলাম। জঙ্গিদের শক্তিশালী অবস্থান ও জিম্মিদের জীবিত উদ্ধারের স্বার্থে কৌশলী অবস্থান নেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
মধ্যরাতে আশপাশের রাস্তা থেকে সাধারণ মানুষ ও সাংবাদিকদের সরিয়ে দেয়া হয়। তখন ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছিল। এরমধ্যে কখনো কখনো মাটি কাঁপিয়ে গুলি ও বিস্ফোরণের শব্দ। শেষ রাতটা আরো ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। একটানা কিছুক্ষণ গুলির শব্দে আতঙ্ক বেড়ে যায় ভেতরে জিম্মি থাকা ব্যক্তিদের স্বজনদের মধ্যে।
পরদিন সকালে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয় সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডো দল। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে সিলেটের জালালাবাদ ক্যান্টনমেন্ট থেকে ঢাকায় আনা হয় তাদের। সকাল পৌনে ৮টার দিকে জিম্মিদের উদ্ধারের জন্য অভিযান শুরু করে সেনাবাহিনীর এই কমান্ডো দল। সাঁজোয়া যান নিয়ে দেয়াল গুঁড়িয়ে রেস্টুরেন্টের সামনে চলে যায় সেনা কমান্ডোরা।
এভাবেই শুরু হয় ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’। গুলি-বিস্ফোরণ। অল্প সময়ের মধ্যেই নির্মূল করা হয় জঙ্গিদের। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয় সেনাবাহিনী। অভিযান শেষে হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে জঙ্গি হামলায় নিহত দেশি-বিদেশি ২০ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়।
এছাড়াও উদ্ধার করা হয় পাঁচ জঙ্গিসহ ছয়জনের লাশ। দেশি-বিদেশি ১৩ জনকে জীবিত উদ্ধার করেন সেনাবাহিনীর কমান্ডো দল। তার আগে রাতে রেস্টুরেন্টের আশপাশ থেকে দুই বিদেশিসহ ১৯ জনকে উদ্ধার করে পুলিশ। মোট ৩২ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়।
উদ্ধার হওয়াদের বর্ণনায় জানা যায় রেস্টুরেন্টের ভেতরের ভয়াবহ পরিস্থিতি। সাংবাদিকদের কাছে সেই রাতের বর্ণনা দিয়েছেন রেস্টুরেন্টের বাবুর্চি শিশির সরকার। মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া থানার খুললাবাদ গ্রামের শিশির জানান, রাত পৌনে ৯টার দিকে রেস্টুরেন্ট চিৎকার ও গুলির শব্দ শুনতে পান তিনি। তখন যে যেভাবে পারেন কোল্ডরুম, বাথরুমে আশ্রয় নেন।
শব্দ শুনে তাৎক্ষণিকভাবে ভেতর থেকে একটু সামনে যেতেই অস্ত্রধারীদের দেখতে পান শিশির। দ্রুত কোল্ডরুমে ঢুকে পড়েন তিনি। দরজা টেনে ধরে থাকেন তারা, যাতে সেখানে কেউ ঢুকতে না পারে। শিশির ভয়ে কাঁপছিলেন। তবে পরিস্থিতি এতটা ভয়াবহ হবে তা ভাবেননি। তার কাছে মনে হয়েছিল সন্ত্রাসীরা হামলা করেছে। এরমধ্যেই গুলির শব্দ শুনতে পান। সেই সঙ্গে ‘আল্লাহু আকবর’ শব্দ।
কিন্তু রাত ১২টার দিকে জঙ্গিরা কোল্ডরুমের দরজা খোলার চেষ্টা করে। তারপর নিচে নিয়ে যায় তাদের। নিচে তখন লাশ আর রক্ত। রক্তে ভেসে গেছে মেজে। জঙ্গিরা লাশের ছবি তোলে, রেস্টুরেন্টের ইন্টারনেট ব্যবহার করে। ফোনে বাইরে কোথাও কথা বলে। রাত ২টার দিকে শিশিরকে দিয়ে রান্না করায় জঙ্গিরা। রান্না করা খাবার দিয়ে সাহরি করতে বলে সবাইকে।
রেস্টুরেন্টের উদ্ধার হওয়া কর্মচারীরা জানান, ওরা বিদেশিদের বেছে নিয়ে হত্যা করে। জঙ্গিরা তাদের বলেছিল, ‘ইউরোপিয়ানরা বাংলাদেশে এসে কালচার নষ্ট করছে। তাই বিদেশিদের হত্যা করা হয়েছে।’ তবে সকালে জঙ্গিরা তাদের বলেছিল, ‘আমরা এখন বের হয়ে যাবো। বলেই তারা বললো- বিদায়। জান্নাতে দেখা হবে।’
উল্লেখ্য, গত বছরের ১লা জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলা চালায় জঙ্গিরা। এতে নিহত হয় তিন বাংলাদেশি নাগরিকসহ ২০ জন। অন্যদের মধ্যে নয় জন ইতালির, সাতজন জাপানের এবং একজন ভারতীয়।
এছাড়া অভিযান চালাতে গিয়ে জঙ্গিদের হামলায় নিহত হন এসি রবিউল ইসলাম ও ওসি সালাহউদ্দিন। এ ঘটনায় গত বছরের ৪ঠা জুলাই পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করেছে। বাদী হয়েছেন গুলশান থানার উপ-পরিদর্শক রিপন কুমার দাস। মামলাটি তদন্ত করছে কাউন্টার টেররিজম এন্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট। এমজমিন
জুলাই, ২০১৭/এমটিনিউজ২৪ডটকম/এসবি