শনিবার, ০১ জুলাই, ২০১৭, ০৫:৫২:৩৬

সেই রাতে কি ঘটেছিল? পুলিশকে যা বলেন হাসনাত করিম

সেই রাতে কি ঘটেছিল? পুলিশকে যা বলেন হাসনাত করিম

নুরুজ্জামান লাবু : হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার পর সবচেয়ে আলোচিত ব্যক্তি হাসনাত রেজা করিম। মেয়ের জন্মদিন উপলক্ষে সেই রাতে খাবার খেতে সপরিবারে হলি আর্টিজানে গিয়েছিলেন তারা। সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী শারমিনা করিম, দুই সন্তান শেফা করিম ও রায়হান।

জঙ্গি হামলার পর অন্যদের মতো হাসনাত ও তার পরিবারের সদস্যরাও রাতভর জিম্মি ছিলেন। উদ্ধার পান সকালে। বিদেশি এক ব্যক্তির ভিডিও ফুটেজ ও ছাদে এক জঙ্গির সঙ্গে ছবি প্রকাশের পর শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা। হামলাকারীদের সঙ্গে হাসনাতের যোগসূত্র রয়েছে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ করতে থাকে অনেকেই।

হামলার পর হাসনাত করিমকে দীর্ঘ সময় ধরে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসির) ইউনিটের সদস্যরা জিজ্ঞাসাবাদ করে। একমাস পর ২০১৬ সালের ৩ আগস্ট তাকে প্রথমে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করা হয়। পরবর্তীতে ৮ দিনের রিমান্ড শেষে ১৩ আগস্ট হাসনাতকে মূল মামলায় গ্রফতার দেখানো হয়। বর্তমানে তিনি কারাগারে আছেন।

সিটিটিসির প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘হাসনাতের বিষয়টি এখনও স্পষ্ট হয়নি। তদন্ত শেষ হলে তার বিষয়ে পরিষ্কার বলা যাবে। এই মামলার তদন্ত চলছে। ফলে হাসনাত এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিল কিনা তা নিয়ে আগেই মন্তব্য করা সমীচীন হবে না।’

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে সেই রাতের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেনে হাসনাত করিম। তিনি বলেছিলেন, ‘আমার মেয়ের জন্মদিন ছিল ১ জুলাই। রোজার কারণে আমার স্ত্রী বাসায় অতিথিদের দাওয়াত দিতে চাননি। তাই রেস্তোরাঁয় জন্মদিন উদযাপন করতে যাই। এ কারণে আমি হলি আর্টিজান বেছে নিই। রেস্টুরেন্টটি বাসার কাছে ছিল আর খাবারের মান খুবই ভালো।

সাড়ে ৮টার পর আমরা বাসা থেকে বের হই। রাত ছিল এবং পার্কিং করতে সঙ্গে ড্রাইভারও নিয়ে যাই। রেস্তোরাঁয় পৌঁছানোর তারা আমাদেরকে আমাদের টেবিলে নিয়ে যায়। হামলাকারীরা যখন সেখানে পৌঁছায় তখন আমরা খাবারের মেন্যু দেখছিলাম। তখন  আনুমানিক সময় রাত ৮টা ৪৫ মিনিট।

তিনি বলেন, ‘প্রথমে আমি আমার পেছনের টেবিলে কিছু শব্দ শুনতে পাই। কী হচ্ছিল তা নিশ্চিত ছিলাম না, তাই পেছনে ফিরে তাকাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সেই মুহূর্তে কিছু ব্যক্তি অস্ত্র হাতে রেস্তোরাঁয় প্রবেশ করে সামনের দরজা দিয়ে। তার আল্লাহু আকবর বলে চিৎকার করছিল। এসময় তারা কিছু মানুষকে গুলি করে আর ধারালো অস্ত্র দিয়েও আঘাত করে। হামলাকারীদের একজন আমাদের টেবিলে এসে থামে এবং বলে, তারা আমাদের কিছু করবে না কিন্তু আমাদের দূরের টেবিলে গিয়ে বসা উচিত। আমাদের টেবিলে ছিলাম আমি, আমার স্ত্রী, আমার ছেলে এবং আমার মেয়ে।’

জঙ্গিদের নির্দেশনা অনুযায়ী, হাসনাত পরিবারের সদস্যদের নিয়ে দূরের একটি টেবিলে বসেন। প্রথমে তারা হলি আর্টিজানের হলরুমের ভেতরে দিকের একটি টেবিলে বসেছিলেন। পরে তারা মূল ফটকের কাছাকাছি একটি টেবিলে গিয়ে বসেন।

জিজ্ঞাসাবাদে হাসনাত বলছিলেন, কিছু সময় পর তারা অনেক মানুষ হত্যা করে। এরপর তারা আরও কিছু মানুষকে আমাদের টেবিলে নিয়ে আসে। এর মধ্যে ছিল তাহমিদ হাসিব খান, ফাইরুজ মালিহা এবং তাহানা (ফাইরুজের বন্ধু)। এরপর আরেক ভদ্রলোকও (ড. সাত প্রকাশ) আমাদের টেবিলে আসেন। সেই মুহূর্তে এক হামলাকারী (পরে যাকে নিবরাস হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে) টেবিলে এসে আমাদের সঙ্গে কথা বলে। সে আমাদের নানা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে।

যেমন, আমরা মুসলিম কি না, আমরা নামাজ পড়ি কি না, ভোট দেই কি না ইত্যাদি। আমি তাকে বললাম যে আমি নামাজ পড়ি আর ভোট দেই না। সে আমাকে সুরা আল ফাতিহা তিলাওয়াত করতেও বলে, আমি তা করি। সে সুরার অর্থও আমাকে জিজ্ঞাসা করে কিন্তু আমি তা ঠিকভাবে বলতে পারিনি। ওই সময় তারা আর বেশি কিছু করেনি বিধায় আমি স্বস্তি বোধ করছিলাম।

জঙ্গি হামলা ও জিম্মি পরিস্থিতি ততক্ষণে মিডিয়ার কল্যাণে সারাদেশের মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে। হলি আর্টিজানের ভেতরে থাকা জিম্মিদের স্বজনরা তাদের ফোন করছিলেন। ফোন বাজছিল নিহতদেরও। হাসনাতসহ অন্য জিম্মিদের হত্যা করা হবে না বলা হলেও ওই পরিস্থিতিতে কোনও কিছুতেই তাদের আশ্বস্ত হওয়ার উপায় ছিল না।

হাসনাত করিম বলছিলেন, ‘তারা (জঙ্গিরা) এটাও জিজ্ঞাসা করেছিল যে কেউ জিম্মি পরিস্থিতির বিষয়টি বাইরে (পুলিশ বা মিডিয়া) জানাতে পারবে কিনা। ওই মুহূর্তে আমার ফোনে অনেকে ফোন করছিল আর অন্যদের ফোনেও কল আসছিল। কাজেই আমি আমার চাচাকে (আনওয়ার-উল-করিম) পরিস্থিতি জানাই। আর তাকে বলি অন্যদের জিম্মি দশার কথা জানাতে।

আর আমরা যে তখনও জীবিত, সেই কথাও জানাতে বলি। টেবিলের অন্যরাও যেমন, ফাইরুজ ও তাহানাও তাদের ফোনে অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে। এক পর্যায়ে জঙ্গিরা আমাদের টেবিলে এসে জিজ্ঞাসা করে কারও ফোনে ইন্টারনেট আছে কিনা? প্রথমবার আমি কিছু বলিনি কিন্তু দ্বিতীয়বার আমাকে স্বীকার করতে হয়েছে যে আমার ফোনে ইন্টারনেট আছে।

একজন হামলাকারী, নিবরাস, আমাকে বলে প্লে স্টোরে ঢুকতে এবং উইকার খুঁজতে। আমি এটা সিলেক্ট করি এবং এরপর তারা আমার কাছ থেকে ফোন নিয়ে যায়। তারা ফাইরুজ ও তাহানার ফোনও নিয়ে যায়। আমি ভয় পেয়ে যাই যে, আমার কাছে ইন্টারনেট আছে, তা অস্বীকার করলে পরে যদি তারা আমার ফোনে ইন্টারনেট থাকার বিষয়টি জানতে পারে, তাহলে ওরা হয়তো আমাকে মেরে ফেলবে।’

জিম্মিদের সবাইকে টেবিলে মাথা নিচু করে বসিয়ে রাখে জঙ্গিরা। কিছু সময় পরে হাসনাতকে একটি তালা দিয়ে দরজা বন্ধ করতে বলা হয়। অস্ত্রের মুখে হাসনাত তাই করেন। এ বিষয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘পরের কয়েক ঘণ্টা আমরা আমাদের টেবিলে মুখ নিচু করে অবস্থান করি। মাঝে মাঝে শুধু টয়লেটে যেতে পারছিলাম। কিছু সময় পরে তাদের একজন আমাদের টেবিলে এসে জিজ্ঞাসা করলো, কার কার পরিবার আছে?

আমার স্ত্রী-সন্তানেরা যেহেতু টেবিলে ছিল আমি বললাম যে আমার পরিবার আছে। এই হামলাকারীর নাম ছিল রোহান (সম্ভবত তাদের নেতা)। সে আমাকে বাইরের একটা দরজা, যেটা খোলা ছিল, সেটা লক করতে বললো আর একটা বাইসাইকেল তালা (খোলা) দিলো। আমি বাইরে গেলাম, আর দরজায় তালা লাগিয়ে টেবিলে ফিরে এলাম দ্রুত।  

কিন্তু ফেরার পথে সে বন্দুকের মুখে আমাকে ভবনটির পাশের দিকে হাঁটতে বাধ্য করল। আমাকে কালো একটি ফোন তুলতে বললো। আামি সেটা তুলে বাইরের একটি টেবিলের ওপর রাখলাম। কিছু সময় পর তারা আমাদের টেবিলে কিছু কেক এবং পানি দেয়। আমাদের কেউই কেক খেতে পারেনি। কিন্তু সবাই পানি খেয়েছিল। আরও কিছু সময় পর আমাদের ক্ষুধা লেগে যায় এবং আমরা কিছু কেক আর পানি খাই।’

হাসনাত করিম তার বর্ণনায় বলছিলেন, ‘এক পর্যায়ে তারা সব মেয়েকে এক পাশে বসায় আর অপর দিকে বসায় পুরুষদের। ছেলেদের দিকে প্রতিবার একেকজন টয়লেটে যাওয়ার পর আমাদের তিনজনের অবস্থান পাল্টাচ্ছিল। আমি লক্ষ্য করলাম যে, তারা বিভিন্ন ফোন ব্যবহার করে যোগাযোগ করছিল, প্রধানত টেক্সটিংয়ের মাধ্যমে। এক পর্যায়ে এক হামলাকারী আরেকজনকে নির্দেশনা দিলো যে ওপর থেকে কনফার্ম করার হুকুম এসেছে। টেবিলের ওপর আমাদের মুখ নিচে থাকায় কে কাকে বলছিল তা দেখতে পাইনি।

আমার ধারণা, তারা কনফার্ম করতে চেয়েছিল যে সবাই আসলে মারা গেছে। তাই তারা ধারালো অস্ত্র দিয়ে মৃত ব্যক্তিদের আঘাত করতে লাগল। তবে, কেউ কেউ তখনও জীবিত ছিল আর আমরা তাদের চিৎকার শুনতে পাচ্ছিলাম যখন ধারালো ছুরি দিয়ে তাদের বারবার আঘাত করা হচ্ছিল। প্রথম পর্যায়ে যাদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে তাদের বেশিরভাগ বিদেশি হলেও, চিৎকারের শব্দ থেকে মনে হচ্ছিল ওই নারীরা ছিল বাংলাদেশি। তখন সময় ছিল রাত ১টা থেকে আড়াইটা।’

শিশির নামে এক কুককে দিয়ে জঙ্গিরা কিছু খাবার রান্না করিয়েছিল। রোজা রাখার জন্য জিম্মিদের সেহরি খেতে দেয়। অস্ত্রের মুখে ভয়ে কেউ কেউ একটু-আধটু খেয়েছেন। সেসময় একজন জঙ্গি ইসলামিক স্টেটের কর্মকাণ্ডের পক্ষে কথা বলে। এক সময় হাসনাতের কাছ থেকে তার ড্রাইভিং লাইসেন্সটি নিয়ে নেয়।

তিনি বলছিলেন, ‘রাত সোয়া ৩টার দিকে তারা আমাদের উঠে বসতে বললো। কেননা তারা আমাদের সেহরি দিতে চেয়েছিল। আর বললো আমাদের রোজা রাখা উচিত। কাজেই, আমার কিছু মাছ খেলাম। পানি পান করলাম। এরপর আবারও আমাদের টেবিলে মাথা নিচু করে থাকলাম। আনুমানিক ভোর সাড়ে ৪টার দিকে আমি টয়লেটের দিকে হেঁটে যাচ্ছিলাম। একজন হামলাকারী (সম্ভবত রোহান, ওদের নেতা) আমাকে থামিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, আমার সঙ্গে বৈধ কোনও পরিচয়পত্র আছে কিনা?

আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, সে আমার ন্যাশনাল আইডি কার্ড দেখতে চায় কিনা? সে বলল না, যে কোনও আইডি হলেই হবে। এরপর আমি তাকে আমার ড্রাইভিং লাইসেন্স দেখালাম। সে বললো সে সেটা রেখে দেবে। কাজেই আমি টয়লেট সেরে টেবিলে ফেরত গেলাম। তার কাছেও বন্দুক ছিল। এ কারণে আমি তাকে বেশি কিছু জিজ্ঞাসা করিনি।  এক পর্যায়ে তারা তাদের নেতা বা প্রচারকের অডিও রেকর্ডিং বাজায়।

এতে ইসলামিক স্টেটের প্রতি তাদের আনুগত্য এবং তাদের বিশ্বাসের ব্যাখ্যা দেওয়া হয় যার মধ্যে গণতন্ত্র নিয়ে ঘৃণা প্রকাশ করা হয়। তারা বলছিল যে, সিআইএ মুসলিম দেশগুলোতে অনধিকার চর্চা করছে এবং ক্ষমতায় বসাচ্ছে মধ্যপন্থী (মডারেট) সরকারকে। পক্ষান্তরে তারা সব মুসলিম দেশগুলোয় ইসলামিক ব্যবস্থা চায়। (খুব সম্ভবত এই ছেলেটা মোবাশ্বের)। এর মধ্যে এই ছেলেটা মোবাশ্বের (কালো এবং দাঁড়ি আছে), আমাকে জিজ্ঞাসা করে ওই রাতের বিশেষত্ব কী ছিল।

যদিও আমার মতে ওই রাত শব-ই-কদর ছিল না, আমার মনে হয়েছিল সে চায় আমি বলি এটা শব-ই-কদরের রাত ছিল। আর তাই আমি বললাম, এটা শব-ই-কদর। আমার কপাল ভালো, সে মেনে নিল। এরপর সে আমাকে জিজ্ঞাসা করলো ওই বিশেষ রাতে ভালো কর্মের জন্য কী বিশেষ পুরস্কার পাওয়া যায়? আমি বললাম সাধারণ রাতের চেয়ে এক হাজার গুণ বেশি সওয়াব পাওয়া যায়। সে একমত পোষণ করল।’

সকালের দিকে হাসনাত ও তাহমিদকে নিয়ে ছাদে ঘুরে বেড়ায় এক জঙ্গি। যে বিষয়টি নিয়ে হাসনাত করিম ও তাহমিদ সবচেয়ে বেশি বিতর্কে পড়েন। ছাদে যাওয়ার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বর্ণনা করে হাসনাত বলেছেন, ‘আবারও আমারা আমাদের টেবিলে পরবর্তী এক ঘণ্টা বা তারও বেশি সময় বসেছিলাম। বাইরে যেহেতু আলো দেখা যাচ্ছিল কাজেই নিশ্চিত পৌনে ৫টা থেকে ৬টা বেজেছিল। এমন সময়ে রোহান ছেলেটা আমাদের টেবিলে এলো। আমার কাঁধে টোকা দিয়ে উঠে দাঁড়াতে বললো। এরপর সে তাহমিদ হাসিব খানকেও উঠে দাঁড়াতে বললো।

সে আমাকে ওপরের তলায় উঠতে বললো আর তাহমিদকে একটা পিস্তল দেওয়ার চেষ্টা করলো। তাহমিদ এটা নিতে চাইছিল না। কিন্তু কিছু সময় পর সে আবার এলো এবং তাহমিদ পিস্তল নিলো। ওই মুহূর্তে আমি নিশ্চিত ছিলাম যে তারা আমাকে মেরে ফেলার জন্য ওপর তলায় নিয়ে যাচ্ছে। রোহান আমাকে ছাদে উঠতে বললো। আমি সিঁড়ির ওপরে পৌছানোর পর সে আমাকে দরজা খুলে বাইরে যেতে বললো। বন্দুকের মুখে আমাকে যা বলা হচ্ছিল আমি তাই করছিলাম।

রোহান আমাকে সামনে হেঁটে যেতে বললো, তাহমিদকে আমার পেছনে হাঁটতে বললো। আর সে ছিল আমাদের দুজনের পেছনে। ছাদে, রোহান আমাকে বললো ডান দিকে হেঁটে গিয়ে আবার ফিরে আসতে। আমি পাশের ভবনের দিকে তাকালাম আর ভাবছিলাম পুলিশ বা অন্য কেউ আমাদের দেখতে পারছে কিনা। আরও ভাবছিলাম কখন আর কিভাবে এই জিম্মি সংকটের ইতি ঘটবে। কেননা এরই মধ্যে কয়েক ঘণ্টা ধরে এই দশা চলছিল আর তারা আমাদের কাছে প্রকাশ করেনি তারা কী করার পরিকল্পনা করছে, বিশেষ করে জিম্মিদের নিয়ে।

আমার মনে হলো, তার সঙ্গে কথা বলে সংকট শেষ করতে এটা ছিল আমাদের একমাত্র সুযোগ। যেহেতু তাকে ওদের নেতা মনে হচ্ছিল। ওই মুহূর্তে আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম সে আমাকে মেরে ফেলবে কিনা? আমি এটা জিজ্ঞাসা করলাম কারণ আমি ভীতসন্ত্রস্ত ছিলাম এবং আমার মনে হয়েছিল তার সঙ্গে কথা বলে আমাকে ও আমাদেরকে বাঁচাতে পারবো। এরপর সে আমাকে বলল লেকের সাইডে হেঁটে যেতে এবং সে লেকের দিকে হাত নাড়লো যেন সেখানে তার জন্য কেউ অপেক্ষা করছিল।

সে বলল, এক পাশে মানুষজন অপেক্ষা করছে আর অন্যদিকে পুলিশ অপেক্ষা করছে স্নাইপার নিয়ে। সে আমাকেও হাত নাড়তে বললো কিন্তু এর কোনও অর্থ বুঝলাম না। এরপর সে আমাদের সামনের দিকে লেকভিউ ক্লিনিকের মুখোমুখি নিয়ে গেল। সে ক্লিনিকের পাশের ভবনের দিকে নির্দেশ করে বললো ওই ভবনের ছাদে পুলিশ সদস্যরা আছে। কী করবো বা বলবো বুঝতে পারছিলাম না। শুধু মনে করছিলাম তার উচিত আমাদের যেতে দেওয়া। আমি এ কারণেও ভীত ছিলাম যে, যে কোনও মুহূর্তে হয় রোহানের বা পুলিশের গুলি খেতে পারি। আমাকে হামলাকারী ভেবে হয়তো পুলিশ গুলি করতে পারে।

যদিও আমি ভেতরে ফিরে যেতে চাইছিলাম কেননা তার সঙ্গে কথা বলাটা ছিল বিপজ্জনক। কিন্তু আমাদের ছেড়ে দেওয়ার জন্য তাকে রাজি করানো এবং জিম্মি সংকট শেষ করার সেটাই ছিল আমাদের একমাত্র সুযোগ। রোহান আমাদের এটাও জিজ্ঞাসা করলো কিভাবে এই সংকট শেষ হওয়া উচিত বা শেষ হবে বলে আমরা মনে করি কিনা। জবাবে আমরা শুধু আমাদের ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করলাম। কিন্তু সে ইতিবাচক বা নেতিবাচক কিছু বললো না। আমি তাকে বলেছিলাম অন্তত নারী আর শিশুদের ছেড়ে দিতে কিন্তু সে সম্মত হলো বলে মনে হলো না।’

ছাদ থেকে হাসনাত ও তাহমিদকে ফের ভেতরে পাঠানোর পর এক পর্যায়ে একটি মুহূর্ত আসে যখন সব জিম্মি সদস্যদের ছেড়ে দেয় জঙ্গিরা। সবার মোবাইল ফোন ফেরত দেয়। হাসনাতকে বলে গেট খুলে দিতে। তারপর সবাইকে হলি আর্টিজান বেকারি থেকে বের হওয়ার নির্দেশ দেয়। হাসনাত করিম বলছিলেন, ‘এক পর্যায়ে সে আমাদের (ছাদ থেকে) ভেতরে যেতে বললো। আমরা ভেতরে গেলাম। আমাদের টেবিলে গিয়ে মাথা নিচু করে বসে থাকলাম। এরপর সেখানে আরও ঘণ্টা খানেকের মতো অপেক্ষা করলাম।

কিছুক্ষণ পর একজন হামলাকারী আমাদের টেবিলে এসে আমার সামনে দুটো চাবি রাখলো। কয়েক মিনিট পর সে আমাকে উঠে দাঁড়াতে বললো এবং আরও বললো আমার বাইরে গিয়ে দরজা খুলে দেওয়া উচিত। তারা বললো যে, এই চাবিতে কোন তালা খুলবে (বড় দরজা বা ছোট দরজা) তারা নিশ্চিত না। কিন্তু আমাকে বলা হলো আমার দুটো দরজাতেই চেষ্টা করে দেখতে হবে আর এই চাবিতে যেই দরজা খুলবে সেটা খুলে রেখে আসতে হবে। ওই মুহূর্তে আমি আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠলাম যে, সে আমাদের যেতে দেবে।

এরপর আমি বাইরে গিয়ে ছোট দরজার তালা খুললাম। কেননা ওই চাবি দিয়ে বড় দরজার বাইসাইকেল লক খোলেনি। এরপর আমি ভেতরে ফিরে এসে সামনের দরজার কাছে অপেক্ষা করতে থাকলাম। এরপর আমি দেখলাম নিবরাস ওপরতলা থেকে অনেকগুলো ফোন নিয়ে নেমে আসছে। সে বললো আমরা আমাদের ফোন ফেরত নিতে পারি। ওই সময় তাহমিদ নিবরাসকে জিজ্ঞাসা করলো যে সে তার বাবার সঙ্গে কথা বলতে পারবে কি না। নিবরাস তখন তাহমিদকে একটা ফোন দিলো। ভালোভাবে দেখে বুঝলাম ওটা ছিল আমার ফোন।

তাহমিদ এরপর তার বাবার সঙ্গে কথা বললো। এরপর আমি আমার ফোনটা ফেরত নিলাম। রোহান এরপর আমাদের সবাইকে দাঁড়াতে বলল। আমরা যেতে পারি বলে জানালো। সবার আগে আমি আমার মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে হেঁটে বের হলাম। পেছনে ছিল আমার স্ত্রী ও ছেলে। এরপর এনএসইউর দুই মেয়ে (ফাইরুজ ও তাহানা), তারপর তাহমিদ ও সাত প্রকাশ। আমরা বাইরের দিকে হেঁটে গেলাম, আমি যেই দরজাটা খুলেছিলাম সেটা দিয়ে, রেস্তোরাঁ প্রাঙ্গণ ছেড়ে বের হলাম। এরপর আমরা বিজিএমসি ভবনের দিকে হেঁটে গেলাম যেখান থেকে পরবর্তী সময়ে পুলিশ আমাদের নিয়ে যায়।’ বাংলা ট্রিবিউন
জুলাই, ২০১৭/এমটিনিউজ২৪ডটকম/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে