আমার দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ার সঙ্গে বাজারে গিয়েছিলাম তার নাতি-নাতনীদের জন্য খেলনা কিনতে। দোকানে গিয়ে তিনি তার নাতনির জন্য হাড়ি-পাতিল, পুতুল ইত্যাদি আর নাতীদের জন্য কিনলেন নানা ধরনের গাড়ি, বন্দুক, বল। তিনি তার নাতনীর জন্য এসব কিনলেন না কেন এমন প্রশ্ন করায় শুধু হাসলেন। আমার এই আত্মীয়া খুব সুন্দর করে স্ত্রী লিঙ্গ নিমার্ণ করলেন।
সচেতন বা অসচেতনভাবে প্রতিনিয়ত ছোট-খাটো নানা কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে স্ত্রী লিঙ্গের নির্মাণ করা হয়। সিমোন দ্য বোভোয়া যেমনটি বলেছিলেন যে নারী হয়ে কেউ জন্মায় না, কেউ কেউ নারী হয়ে ওঠে।
সত্যিই কোনো নারী নারী হয়ে জন্মায় না। সমাজ, পরিবেশ বারংবার চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দেয় যে সে নারী। আর যেহেতু সে নারী তাই সমাজের সবক্ষেত্রে তার অবাধ প্রবেশ নিষিদ্ধ। সমাজই ঠিক করে দেয় একজন কন্যা শিশু কি নিয়ে খেলবে বা খেলবে না, কি পরিধান করবে বা করবে না। যেমনটা গাড়ি, কিংবা বল নিয়ে খেলা মেয়েদের জন্য নয়। আমার আত্মীয়া মোটামুটি লেখাপড়া জানা এবং আধুনিক মনমানসিকতার তাই তার এরুপ আচরণে আমি বেশ অবাক হয়েছিলাম।
তবে আরও অবাক হয়েছিলাম যখন সেই কন্যা শিশুটির প্রতি তার উচ্চশিক্ষিত বাবার আচরণের কথা শুনি এবং নিজ চোখে দেখি। কন্যার বাবা যথেষ্ট শিক্ষিত এবং তরুণ হওয়া সত্ত্বেও তার চিন্তাধারা অনেকটা সেকেলে। বিশেষ করে এইক্ষেত্রে। এই কন্যার জন্ম নিয়ে নানা ঝামেলা। খুশি হতে পারে নি কন্যার বাবা। শুধু বাবা কেন পরিবারের অন্য সদস্যরাও নয়। প্রথম সন্তান কেনো ছেলে হলো না? এবার কথার বাণে জর্জরিত হতে থাকলেন মেয়ের মা। যেন মা ইচ্ছে করেই কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। সবার চিন্তা হলো প্রথম সন্তান কন্যা হয়েছে তাকে পড়াশোনা শেখাতে হবে, বিয়ে দিতে হবে অনেক টাকা খরচ হবে। যদিও তাদের যথেষ্ট টাকা পয়সা রয়েছে। প্রথম সন্তান ছেলে হলে বড় হয়ে উপাজর্ন করতো। কিন্তু মেয়ে তো! পড়াশোনা শেষ করে বিয়ে দিতে হবে।
অথচ তারা ভাবতেই পারছেন না যে, এই মেয়ে বড় হয়ে ভবিষ্যতে কিছু করতে পারে, বাবা মায়ের ভরসা হতে পারে। মেয়েকে মানুষের মত মানুষ করে গড়ে তোলা তো দূরের কথা। সেই কন্যাকে তারা বাবা খুব একটা আদর করে না শুনেছি। তবে বিশ্বাস করতে মন চাইতো না। কারণ উচ্চশিক্ষিত, এবং এ যুগের ছেলে হয়ে এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে এরকম আচরণ করবে এটা ভাবতে পারতাম না সহজে।
কিন্তু যখন কোনো একদিন তাদের বাড়িতে যাই এবং নিজের চোখে দেখি তখন বিস্মিত হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না আমার। আরোও বিস্মিত হয়েছিলাম যখন দেখলাম বাড়ির অন্য ছেলে বাচ্চারা (যাদের বয়স ৪-৬ হবে) সেই মেয়ে শিশুটাকে পদে পদে মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, সে মেয়ে। এবং তাকে বল বা গাড়ি দিয়ে খেলতে দিচ্ছে না। বরং বলছে, যাও তুমি হাড়ি পাতিল নিয়ে খেল। বড় হয়ে তারা কে কি হবে তা জিজ্ঞেস করলে কেউ ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হবে আমাকে বলে। সাথে সাথে এও বললো যে, সেই কন্যা শিশুটি ডাক্তার হতে পারবে না। কারণ ও অনেক ভীতু।
মেয়েরা সবকিছুতে ভয় পায়। ছেলেরা ভয় পায় না। অবাক হয়েছিলাম ৪-৫ বছরের বাচ্চারা এ ধরনের কথা কিভাবে বলতে পারে? পরে ভেবে দেখলাম অস্বাভাবিক কিছ নয়। যে বাড়িতে কন্যা সন্তানের জন্ম নিয়ে এত সমস্যা ওরা তো সেই বাড়িরই সন্তান! পিতৃতান্ত্রিক বা পুরুষতান্ত্রিক চিন্তাভাবনার বীজ তাদের মধ্যে এখন থেকেই বপন করা হচ্ছে। আর এই বীজগুলোই একদিন চারা, চারা থেকে মহীরুহে পরিণত হবে।
আমি যতবারই আমার এই আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়েছি কখনোই ওই বাবাকে তার মেয়েকে ভালো করে কোলে বা আদর করতে দেখিনি। যেটুকু করতে দেখেছি, মনে হয়েছে বাধ্য হয়ে করছেন। আমার আত্মীয়া অর্থাৎ মেয়ের দাদীর লিঙ্গবৈষম্য করা খুব একটা অবাক করার মত বিষয় নয়। যদিও আমি অবাক হয়েছিলাম। কারণ তারা ছোটবেলা থেকে এসব দেখে আসছেন। খুব বেশি লেখাপড়া করেননি। পিতৃতান্ত্রিক গন্ডির মধ্যে বড় হয়েছেন। দীর্ঘদিনের চর্চার ফলে এক ধরনের অভ্যস্ততা তৈরি হয়েছে তাদের মধ্যে। কিন্তু মেয়ের বাবা! যে কিনা উচ্চশিক্ষিত তার কাছ থেকে এরুপ আচরণ সত্যিই হতাশাজনক।
এবার আরেকজন বাবার কথায় আসি। যিনি ওই কন্যা সন্তানের বাবার মত অত উচ্চশিক্ষিত এবং এ যুগের নন। অথচ তিন কন্যা সন্তানের জনক হওয়ার পরও তার কোনো আফসোস নেই। পুত্র সন্তানের জন্য হাহাকারও নেই। তবে হ্যাঁ পাড়াপড়শীর অবশ্য বেশ চিন্তা ছিল। এবারও মেয়ে! বাবা কিন্তু মহাখুশি। এবং তিনি দিব্যি তিন কন্যাকে মানুষ করার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। তার বড় মেয়ে ক্লাস ফোর কিংবা ফাইভে পড়ে। যথেষ্ট মেধাবী। তার তুলনায় মেজ মেয়ে একটু কম মেধাবী হওয়ায় তাদের চিন্তার শেষ নেই। মেয়ে কি করবে বড় হয়ে? আদৌ মানুষ হবে কি না! বলতেই হচ্ছে ওই বাবার থেকে এই বাবা ঢেড় বেশি ভালো। ছেলে হলে কি লাভ আর মেয়ে হলেকি ক্ষতি এই হিসেব তিনি করছেন না।
আমি দিন-মজুর, খেটে খাওয়া অনেক বাবাকে দেখেছি যাদের ঘরে কন্যা সন্তান রয়েছে এবং কষ্ট করে হলেও তাদের পড়াশোনা শেখাচ্ছেন। মাঝে মাঝেই আমি রিকশায় উঠে চালকের সঙ্গে গল্প জুড়ে দেই। যদি শুনি কারো মেয়ে আছে তাহলে আগ্রহের সাথে নানা প্রশ্ন করতে থাকি। এবং কন্যাদের সম্পর্কে তাদের চিন্তা এবং মানসিকতাকে বোঝার চেষ্টা করি। অনেকেই খুব আগ্রহের সাথে, গর্বের সাথে বলে থাকেন তারা তাদের মেয়েকে লেখাপড়া শেখাচ্ছেন। এও বলে থাকেন যে, ছেলে হোক বা মেয়ে সন্তান তো সন্তানই।
এর থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট হয় এই যে, লিঙ্গভেদ বা স্ত্রী লিঙ্গ নির্মাণ যেটাই বলি না কেন তা উচ্চশিক্ষিত, শিক্ষিত , অল্প শিক্ষিত বা নিরেট মূর্খ এসবের ওপর নির্ভর করে না। শিক্ষিত, তরুণ কিংবা আধুনিক হলেই যে তার চিন্তা বা দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা হবে এই ভুল ধারণাটি আমার ভেঙেছে। আমার ওই আত্মীয় বাবার তুলনায় এইসব মূর্খ বা অল্প শিক্ষিত বাবাদের চিন্তা ঢেড় বেশি আধুনিক। এই বাবারা কন্যাকে শুধু কন্যা হিসেবে নয় বরং মানুষ হিসেবে দেখে যা আমার ওই আত্মীয়ার পরিবার পাড়ে নি বা পারছে না।
এখান থেকে পরিষ্কার যে লিঙ্গ ভেদাভেদ শিক্ষিত, কম শিক্ষত , উচ্চশিক্ষিত এগুলো দিয়ে পরিমাপ করা যায় না।
একটা সময় ধারণা করা হতো দরিদ্র কৃষিভিত্তিক সমাজে ছেলে সন্তান উপার্জনকারী আর মেয়েরা সংসারের বোঝা। দরিদ্র কৃষিভিত্তিক সমাজেই নয় একবিংশ শতাব্দীতে এসেও অনেক বাবা-মায়ের পুত্র সন্তানের জন্য হাহাকার বিদ্যমান। এবং নির্ভরতার জায়গা শুধু পুত্র সন্তানের মাঝেই দেখতে পান বাবা-মায়েরা। কন্যারা এখন শুধু রন্ধনশিল্পেই নয় সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্ব কত তাও পরিমাপ করছে। কিন্তু তারপরও কোথাও যেন পুত্র সন্তান লাভের আকাঙ্খা, সুপ্ত বাসনা বাবা-মায়ের মধ্যে, পরিবারগুলোতে থেকে যায়।
এখনও অনেক পরিবারে কন্যা সন্তানের জন্মকে সানন্দ্যের সাথে গ্রহণ করতে পারে না। আমরা এখনো মেয়েদের মানুষ হিসেবে ভাবতে ব্যর্থ হচ্ছি। আমরা ব্যর্থ হচ্ছি হাজার বছরের পিতৃতান্ত্রিক চিন্তা-ভাবনার প্রভাবমুক্ত হতে। নারী অধিকারের পক্ষে প্রথম সোচ্চার হন রাজারামমোহণ রায়। এটা আমি মানি। আর এটাও বিশ্বাস করি যে, আজকে সমাজ থেকে লিঙ্গবৈষম্য, লিঙ্গভেদ, স্ত্রলিঙ্গ নির্মাণ বন্ধ করতে হলে নারী-পুরুষ উভয়কেই একসঙ্গে কাজ করতে হবে। তাহলেই আর কোনো কন্যা শিশু বঞ্চিত হবে না বাবার আদর থেকে!
লেখক: রাইসা জান্নাত
শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
০৩ জুলাই ২০১৭/এমটিনিউজ২৪ডটকম/আ শি/এএস