বৃহস্পতিবার, ২৯ অক্টোবর, ২০১৫, ০৮:০৩:২৫

‘পরিস্থিতি উদ্বেগজনক, জাতীয় সংলাপ জরুরি’

‘পরিস্থিতি উদ্বেগজনক, জাতীয় সংলাপ জরুরি’

ড. সরদার এম. আনিছুর রহমান : একের পর এক নৃশংসভাবে খুন হচ্ছে দেশি-বিদেশি নাগরিক।এসব খুনের ঘটনা আড়াল করতে খুনীরা উগ্র জঙ্গী সংগঠনের নাম ব্যবহার করে থাকছে ধরা-ছুঁয়ার বাইরে।আর এসব ঘটনায় খুনীদের ফাঁদে পড়ে নিজেরা পরস্পরকে দোষারোপ করে নতুন করে রাজনৈতিক হানাহানিতে লিপ্ত হচ্ছি। ফলে এসব বিষয়ে দেশের অভ্যন্তরে যেমন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়ছে, তেমনি আন্তর্জাতিক মহলেও বেড়েছে উদ্বেগ।কিন্তু কোনো প্রতিকার পাওয়া যাচ্ছে না।ফলে সরকার ও সরকারি বাহিনী যাই দাবি করুক না কেন, পরিস্থিতি যে ক্রমেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে এতে কারো কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়। গেল সাত বছরে দেশে অজ্ঞাত সন্ত্রাসী কর্তৃক সংঘটিত কোনো একটি ঘটনায় আইন শৃঙ্খলা বাহিনী সঠিকভাবে রহস্য উদ্ঘাটন কিংবা জড়িতদের চিহ্নিত করে নজীর স্থাপন করতে পেরেছে বলে আমার জানা নেই।অন্যান্য হত্যাকাণ্ডের ন্যায় এবারও আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশ প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা একইভাষায় কথা বলেছেন। ঘটনার ঘটার পরপরই তদন্ত ছাড়া তারা রাজনৈতিক ভাষায় বিরোধীদের দোষারোপ করার কারণে তাদের কোনো বক্তব্যই এখন আর দেশবাসীর কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হচ্ছে না।এখন তারা তদন্তের নামে যা করছেন বা বলছেন সবই পক্ষপাত দোষেদুষ্ট বলেই দেশবাসীর কাছে প্রতীয়মান হবে। ফলে সহজেই অনুমেয় সামনের পরিস্থিতি কোন দিকে ধাবিত হচ্ছে। আমার সাথে সবাই একমত না হলেও একেবারে অস্বীকার করার উপায় নেই- বর্তমানে দেশে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তা দেশ স্বাধীনের ৪৪ বছরের যে কোনো সময়ের তুলনায় উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে।এটা আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য এক বিরাট অশনিসংকেত।এসব হত্যাকাণ্ডই প্রমাণ করে যে আমাদের রাষ্ট্র কাঠামো আজ কতটা দুর্বল ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আছে। আর দেশে জঙ্গি আছে কি নেই তাও স্পষ্ট করতে পারছে না সরকার। সরকারের আগে-পরের বক্তব্যের সাথেও মিল খোঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।সরকারের ভেতরকার লোকজনের বক্তব্যের মধ্যেও কোনো মিল নেই।অন্যদিকে বিরোধী দল অভিযোগ করছে যে, এতদিন সরকার বিরোধীদের সাইজ করে রাজনৈতিক ফায়দা নিতে ‘বাংলাদেশে জঙ্গি রয়েছে বলে বহির্বিশ্বের কাছে তুলে ধরেছে, এবার তারা অস্বীকার করছে।’ অন্যদিকে সরকার বলছে, দেশকে অস্থিতিশীল করা আর সরকারকে বেকায়দায় ফেলতেই বিরোধীরা এ ধরনের কর্মকান্ডে জড়িত। এসব প্রেক্ষিতে সহজেই বলা যায় পরিস্থিতি ক্রমেই আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। কিন্তু এরপরও আমাদের বোধোদয় হচ্ছে না। ফলে এই রাজনীতির হানাহানিতে এসব অপরাধ কমে সহসাই পরিস্থিতির উন্নতির কোনো লক্ষণও দেখছি না।এরপরও নিজের চোখের সামনে জাতি অধ:পতনের দিকে যাচ্ছে আর আমরা সবাই নিরবে অবলোকন করবো তা কী করে হয়!ফলে বিবেকের তাড়না থেকেই আজকের আমার এই নিবন্ধ লেখা। নিজে কোনো অপরাধ দমনে বিশেষজ্ঞ নই, ক্রিমিনালজিতে্ও লেখাপড়া করেনি।তবে রাষ্ট্র-সমাজ নিয়ে অধ্যয়ন করে যতসামান্য জ্ঞান অর্জন করেছি, তাতে জাতির বর্তমান এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় জরুরী ভিত্তিতে সরকারের যা করণীয় সে সম্পর্কে আমার কিছু বিক্ষিপ্ত ভাবনা এখানে তুলে ধরলাম। এক. বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারের পক্ষ থেকে যাই দাবি করা হোক না কেন, দুই বিদেশী নাগরিক হত্যা আর তাজিয়া মিছিলে বোমা হামলার ঘটনায় সবাই উদ্বিগ্ন। এ সব ঘটনায় আন্তর্জাতিক মহলকে আমাদের সম্পর্কে যে বার্তা দিয়েছে তাতে বিদেশী নাগরিকদের মনে এক ধরনের আতঙ্কের জন্ম দিয়েছে।এতে এদেশে আসতে বিদেশীরা ক্রমেই অনাগ্রী হয়ে পড়েছেন।আর এটা অব্যাহত থাকলে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ, অর্থনীতি, শিক্ষা ও ক্রিড়াঙ্গনসহ সার্বিক বিষয়ের উপর যে একটা বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে এতে কোনো সন্দেহ নেই।আর সেটা হলে পাকিস্তান-আফগানিস্তানের চাইতে কম নেতিবাচক হবে না।ইতোমধ্যেই এর কিছুটা লক্ষণ শুরু হয়ে গেছে।ফলে এটা শুধু কোনো বিশেষ দল কিংবা গোষ্ঠীর বিষয় নয়, গোটা জাতিকে এই বিশাল ক্ষতি থেকে রক্ষায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। তাই সরকারের উচিত জরুরি ভিত্তিতে একটা জাতীয় সংলাপের আয়োজন করা।সেখানে বিষয়টি উত্থাপন করে সবার মতামতের ভিত্তিতে কার্যকর জরুরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা। দুই.জাতীয় সংলাপের পরামর্শের আলোকে প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞ নাগরিকদের নিয়ে জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ গঠন করা যেতে পারে।যারা দলমতের উর্ধ্বে থেকে জাতীয় নিরাপত্তাকে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করবেন।যার নজীর উন্নত-অনুন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রয়েছে। তিন. আমাদের পুলিশ প্রশাসন যেহেতু অদক্ষতা ও ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে, সেহেতু এই সংস্থা জনগণের কাছে বিশ্বাস যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছে।ফলে জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের অধীনে কিংবা বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটির অধীনে বিগত কয়েক বছরের হত্যাকাণ্ডগুলোর তদন্ত হতে পারে। কেননা, এই হত্যাকাণ্ড শুধুই হত্যা নয়, আমাদের দেশে যে অগণতান্ত্রিক চর্চা চলে আসছে সেটারই ধারবাহিতা। হত্যাকাণ্ডের পর কোনো ধরনের তদন্ত ছাড়াই ঢালাওভাবে কোনো একটি পক্ষকে দায়ি করা হয়।সরকারের পক্ষ থেকে তদন্ত ছাড়া কারো উপর দায় চাপানো মানে মামলার তদন্তকে প্রভাবিত করা তথা প্রকৃত জড়িতদের আড়াল করা। এতে প্রকৃত অপরাধীরা ঘটনা ঘটিয়ে বরাবরই অনেকটা নিরাপদে থেকে যাচ্ছে। ফলে এই হত্যাকাণ্ড শুধু বিদেশী নাগরিকদের জন্যই নয়, আমাদের সবার জন্যই হুমকি স্বরূপ। এর বিচার না হলে আরও যে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। চার. এসব হত্যাকাণ্ডের পর সবাই এক বাক্যে স্বীকার করেছেন যে- আমাদের সমাজে বিচারহীনতার সংস্কৃতিই সবচেয়ে বড় দায়ী।সমাজে আইনের শাসনের অনুপস্থিতিই আমাদেরকে ধংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।ফলে আমাদেরকে এ সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে।এ সংস্কৃতি আমাদেরকে থামাতেই হবে-অন্যথায় নিরাপত্তাহীনতার জালে আরো বেশি আচ্ছাদিত হবে দেশের মানুষ, আইন-শৃঙ্খলার প্রতি মানুষের শ্রদ্ধার জায়গাটি ক্রমেই শিথিল হয়ে পড়বে, সমাজে এই নৈরাজ্যের থাবা আরও বিস্তার লাভ করবে।আর এতে আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রকাঠামো ভেঙ্গে পড়তে পারে।ফলে সর্বপ্রথম আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা জরুরি। পাঁচ. রাজনীতিতে অগণতান্ত্রিক চর্চা, ক্ষমতায় যাওয়া আর টিকে থাকার লড়াই আর ভিন্ন কায়দায় প্রতিপক্ষ তথা ভিন্নমতের লোকদের অবদমিত করার প্রয়াস যখন আমরা দেখছি, ঠিক তখনই একের পর এক খুনের মহোৎসব চলছে খুনীদের।ফলে এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় আমাদের রাজনীতিবিদদের মনোভাব পরিবর্তন করে গণতান্ত্রিক চর্চা করতে হবে। শাসক-শোষকের ভুমিকা থেকে বের হয়ে জনসেবার মনোভাব পোষণ করতে হবে।সেই সাথে কর্তৃত্ববাদি রাষ্ট্র থেকে জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রে পরিণত করতে হবে।তবেই আশা করা যায় অপরাধের মাত্রা কমে আসবে। ছয়.জনগণের ট্যাক্সের বিশাল অর্থে পরিচালিত রাষ্ট্রের এই সংস্থাগুলো আসলেই কি অপরাধী চিহ্নিত করতে সক্ষম, না তাদের দুর্বলতার কারণেই এসব হত্যাকাণ্ড ঘটছে!বিশিষ্ট সাংবাদিক মিজানুর রহমান খানের মতে, ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অধিকতর রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের ফলে সংস্থাগুলো তাদের পেশাদারিত্বের সক্রিয়তা হারাচ্ছে। ফলে এ ধরনের অপরাধ প্রতিরোধে তাদের যে ধরনের গবেষণা সেল ও সক্ষমতা থাকা দরকার তা নেই।ফলে ঘটনা ঘটেই চলেছে।’ আমাদের দেশে যখনই যে যারা ক্ষমতাসীন হয়েছে তারা রাষ্ট্রীয় এই সংস্থাগুলোকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছে। ফলে আইনশৃংখলাবহিনী কর্তৃক গুম, নির্যাতন ও বিচারবহির্ভুত ঘটনার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত হয়ে পড়েছে এই বাহিনীগুলো।এরপরও তাদের বিচার থেকে দায়মুক্তি দেয়া হচ্ছে। ফলে রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো যেখানে গুরুতর অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে সেখানে সমাজে অপরাধ প্রবণতা বেড়েই চলেছে। ফলে এই সংস্কৃতি থেকেও রাষ্ট্রকে বের হতে হবে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে পেশাদারিত্ব সংস্থা হিসেবে গড়ে তুলতে কার্যকর পদক্ষেপ জরুরি। সাত. চরম অন্ধ দলবাজি বন্ধ করে রাষ্ট্রের বৃহত্তর স্বার্থে দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে রাজনীতিবিদদের ভুমিকা পালন করতে হবে।অপরাধীদের রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়া বন্ধ করতে হবে। সবশেষে বলবো, জাতীয় ঐক্য, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিবেশ, ন্যায় বিচার ও সুশাসন ছাড়া কোনোভাবেই এই পরিস্থিতি মোকাবেলা সম্ভব নয়।তাই আমাদেরকে সামাজিক এই অধ:পতন থেকে মুক্তি পেতে হলে সেদিকেই হাঁটতে হবে।আর এটা করতে না পারলে দেশ বড় ধরনের ক্ষতি সম্মুখীন হলে শাসকগোষ্ঠীকেই এর পুরো দায় নিতে হবে। আর সেটার জন্য তাদরকে যে অপরিমেয় মাসুল দিতে হবে এতে্ও কোনো সন্দেহ নেই।তাই সময় থাকতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য ক্ষমতাসীনদের প্রতি আহবান জানাচ্ছি। লেখক: শিক্ষা ও সমাজ বিষয়ক গবেষক ও কলাম লেখক।ই-মেইল: [email protected] (লেখকের একান্তই নিজস্ব মতামত, এমটিনিউজের সম্পাদকীয় নীতির আওতাভুক্ত নয়) ২৯ অক্টোবর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এসএম/ডিআরএ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে