বুধবার, ১২ জুলাই, ২০১৭, ০১:২১:৩৪

যেসব কারণে কমছে রপ্তানি আয়

 যেসব কারণে কমছে রপ্তানি আয়

নিউজ ডেস্ক: বিদায়ী অর্থবছরে বাংলাদেশ রপ্তানি বাণিজ্যে প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে মাত্র ১ দশমিক ৬৯ শতাংশ, যা গত ১৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। রপ্তানিকারক ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বৈশ্বিক বাজারে পণ্যের দাম ও চাহিদা কম, ডলারে বিপরীতে টাকা শক্তিশালী, গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটে উৎপাদন ব্যাহত ও সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলার নেতিবাচক প্রভাবে রপ্তানি আয় কমেছে।

তাদের মতে, রপ্তানি প্রবৃদ্ধিকে ইতিবাচক ধারায় ফেরাতে রপ্তানিকারক, ইপিবি ও বাণিজ্যমন্ত্রনালয়সহ সংশ্লিষ্ট সবার উদ্যোগ নেয়া জরুরি। এছাড়া সরকারের নীতি সহায়তা বাড়ানোর পাশাপাশি তৈরি পোশাক খাতের বিকল্প পথের সন্ধানে এখনই নামতে হবে বলেও মনে করেন তারা।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো ইপিবির প্রকাশিত ২০১৬-১৭ অর্থবছরের রপ্তানির হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিভিন্ন পণ্য থেকে রপ্তানি আয় এসেছে তিন হাজার ৪৮৩ কোটি ৫০ লাখ (৩৪.৮৩ বিলিয়ন) ডলার। যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ১ দশমিক ৬৯ শতাংশ বেশি হলেও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ৬ শতাংশ কম। আলোচ্য অর্থবছরে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৩ হাজার ৭০০ কোটি (৩৭ বিলিয়ন) ডলার।

সর্বশেষ রপ্তানি আয় কম হয়েছিল ২০০১-০২ অর্থবছরে। তখন তার আগের বছরের তুলানায় রপ্তানি আয় কমে গিয়েছিল ৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ। এরপর প্রবৃদ্ধির অংকে হেরফের হলেও তা সব সময়ই ১ দশমিক ৬৯ শতাংশের বেশি ছিল। বাংলাদেশ রপ্তানিতে রেকর্ড করেছিল ২০১০-১১ অর্থবছরে। সেসময় প্রবৃদ্ধি হয়ছিল ৪১ দশমিক ৪৯ শতাংশ।

ইপিবির প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাকের প্রবৃদ্ধি কম হওয়ায় সার্বিক রপ্তানি আয় কমেছে। এ খাত থেকে মোট আয়ের ৮১ শতাংশ আসলেও প্রবৃদ্ধি হয়েছে নাম মাত্র দশমিক ২ শতাংশ। এর মধ্যে নিট খাতে ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও উভেনে কমেছে ২ দশমিক ৩৫ শতাংশ।
এফবিসিসিআইর সহসভাপতি মুনতাকিম আশরাফ

পোশাকের বাইরে হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানি থেকে আয় কমেছে দশমিক ৫৬ শতাংশ, চামড়ায় কমেছে ১৬ দশমিক ৩ শতাংশ আর কৃষিপণ্যে কমেছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ।

রপ্তানি আয়ে তৈরি পোশাকের প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার ধাক্কা লেগেছে বলে জানান শিল্প ও বণিক সমিতিগুলোর শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সহসভাপতি মুনতাকিম আশরাফ। চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন, পোশাকের ওপর ভর করেই সার্বিক রপ্তানি বাড়ে। কিন্তু বৈশ্বিকভাবে পণ্যটির দাম কমে যাওয়া, শ্রমিক অধিকার নিয়ে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) চাপে ছোট ছোট অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়াসহ নানা কারণে এ খাতে রপ্তানি কমেছে; যার ধাক্কা লেগেছে মোট রপ্তানিতে।

‘তাই সবার উচিত তৈরি পোশাকের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে ওষুধ, লাইটেনিং, পাট ও চামড়াজাতীয় পণ্য, হিমায়িত খাদ্য, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য পণ্যসহ অন্যান্য পণ্যের রপ্তানি বাড়ানো।’

‘এক্ষেত্রে সরকারের কী পদক্ষেপ নেয়া উচিত বলে মনে করে এফবিসিসিআই’- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সরকারের উদ্যোগে একশ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের কাজ অনেক এগিয়েছে। প্রায় ২০টি অঞ্চলে বিনিয়োগ শুরু হয়েছে। বিদেশিদের এসব অঞ্চলে অন্তর্ভুক্ত করা গেলে বিনিয়োগ বাড়বে। প্রচলিত পণ্যসহ অপ্রচলিত পণ্যের বাজার প্রসারিত হবে।’

তবে বিদেশি বিনিয়োগকে আকর্ষণ করার জন্য ব্যবসায়িক পরিবেশ উন্নত ও কর আদায়ের ব্যবস্থা সহজ করা দরকার। বিনিয়োগে তাদের আগ্রহী করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে বিনিয়োগ বাড়ার পাশাপাশি রপ্তানি চাকাও সচল হবে বলে করেন এই ব্যবসায়ী নেতা।
 
তৈরি পোশাক উৎপাদন ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি মোহাম্মদ নাছির চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, প্রতিযোগী দেশগুলোতে ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রার মান কমলেও বাংলাদেশে হচ্ছে উল্টো চিত্র। এখানে ডলারের বিপরীতে টাকা শক্তিশালী হচ্ছে। এছাড়া সেসব দেশের সরকার ব্যবসাবান্ধব নীতিসহায়তা ও প্রণোদনা দিচ্ছে। ফলে বিশ্বব্যাপী পোশাকের দর কমলেও তারা পুষিয়ে নিতে পারছে।

অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন, ব্রেক্সিট ও সাম্প্রতিক হলি আর্টিজানের জঙ্গি হামলা তৈরি পোশাকের বাজারে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

‘এছাড়া বাংলাদেশের বন্দরগুলোর অবস্থা খুবই বাজে। সেখানে পণ্য বোঝাই জাহাজগুলোর দিনের পর দিন পড়ে থাকে পণ্য খালাস ও বোঝাই কোনোটিই করতে পারছে না সময়মত। ফলে লিডটাইমে ক্রেতাদের পণ্য সরবরাহে বিঘ্ন ঘটছে। শুধু এখানেই শেষ নয়, কারখানাগুলোতে গ্যাস সংকট, স্থানান্তরিত ও নতুন কারখানায় বিদ্যুতের সংযোগ না দেয়াসহ বিভিন্ন কারণে ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন। এসব কারণে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি কমে গেছে।’

মোহাম্মদ নাছির বলেন, রপ্তানি বাড়াতে বাজেটে আগামী দুই বছরের জন্য তৈরি পোশাক খাতে নগদ প্রণোদনা দেয়ার অনুরোধ করা হলেও তা করা হয়নি। যে খাত থেকে সিংহভাগ রপ্তানি আয় আসে; সেখানে সঠিক নীতিগত সহায়তা না দিলে ভবিষ্যতে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি আরো বড় ধরনের হোঁচট খেতে পারে।
 
সারাবিশ্বেই রপ্তানী মন্দা বলে জানান বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, শুধু বাংলাদেশে নয়, বৈশ্বিভাবেই রপ্তানি চিত্র খারাপ্। যেমন ২০১৬ সালে ভারতে রপ্তানি আয় কমেছে ২ শতাংশ। আর চীনে সাড়ে ৭ ও শ্রীলঙ্কায় ১ শতাংশ কমেছে। এর কারণ হচ্ছে বৈশ্বিক চাহিদা কমে যাওয়া। ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে চাহিদা কমেছে এক দশমিক পাঁচ শতাংশ। এর আগেও ২০১৪ সালের তুলনায় ১৫ সালে চাহিদা কমেছিল ৮ শতাংশ।

তবে প্রতিযোগী কিছু দেশে রপ্তানি বেড়েছে। যেমন ভিয়েতনামে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি বেড়েছে ১৫ শতাংশ। এছাড়া কম্বোডিয়ায়ও বেড়েছে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে বৈশ্বিক মন্দায় আমরা রপ্তানিতে পেছালেও প্রতিযোগী দেশগুলো কিভাবে প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে তা খতিয়ে দেখা দরকার। কোন কোন পণ্য রপ্তানি করে তারা প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রেখেছে; তা খুঁজে বের করতে হবে। এই জন্য রপ্তানিকারক, ইপিবি ও বাণিজ্যমন্ত্রনালয়সহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে উদ্যোগ নিতে হবে বলে মনে করেন এই গবেষক।

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, পোশাকের ওপর থেকে নির্ভরতা কমিয়ে অন্যান্য খাতের রপ্তানি বাড়াতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ জরুরী। সেজন্য কোন দেশে কোন পণ্যের চাহিদা বেশি কিন্তু উৎপাদন কম, কোথায় পণ্যের উৎপাদন খরচ বেশি, কোথায় দাম বেশি-এসব খুঁজে বের করতে হবে।
১২ জুলাই ২০১৭/এমটিনিউজ২৪.কম/হাবিব/এইচআর

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে