নিউজ ডেস্ক: মা-বাবা নেই হাবিবার। ছয় বছর বয়স থেকে সরকারি শিশু পরিবারে বড় হয়েছেন। এটাই তাঁর পরিবার। এই পরিবারের সদস্যরাই তাঁর আপনজন। অষ্টাদশী হাবিবা আক্তারের বিয়ের অনুষ্ঠানও তাঁদের নিয়েই। শুধু তা-ই নয়, হাবিবার বিয়েতে থাকছেন অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি। আজ বৃহস্পতিবার তাঁর গায়েহলুদ। কাল শুক্রবার বিয়ে। বিয়েটা মহা ধুমধামেই হচ্ছে।
শিশু পরিবারের উপতত্ত্বাবধায়ক রওশন আরার তত্ত্বাবধানে মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের সহায়তায় হাবিবার জাঁকজমক বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে। গায়েহলুদ পর্বে থাকছে স্থানীয় শিল্পীদের সংগীত পরিবেশনা।
হাবিবার বিয়ে উপলক্ষে কনের গলার হার, কানের দুল ও হাতের চুড়ি দেবেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। বর-কনের আবাসনের নিশ্চয়তা দিয়েছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সদরের সাংসদ র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী। বরের জামাকাপড়, কনের সোনার চেইন ও টেলিভিশন দিচ্ছেন জেলা প্রশাসক। পুলিশে কনস্টেবল পদে বরের চাকরির ব্যবস্থা, বিয়ের সাজসজ্জা ও অতিথিদের খাবারের আয়োজন করেছেন পুলিশ সুপার। আর কনে সাজানোর দায়িত্ব পুলিশ সুপারের স্ত্রীর। এভাবেই জাঁকজমকপূর্ণভাবে প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে হাবিবার গায়েহলুদ ও বিয়ের আনুষ্ঠানিকতার।
সরেজমিনে দেখা গেছে, গায়েহলুদ ও বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য সরকারি শিশু পরিবারের মাঠে বিশাল প্যান্ডেল সাজানো হয়েছে। প্রধান ফটকে নির্মাণ করা হয়েছে বিয়ের তোরণ। জেলা পুলিশের কর্মকর্তারা এসব তদারকি করছেন।
আয়োজক সূত্রে জানা গেছে, আজ সন্ধ্যায় সরকারি শিশু পরিবারে হাবিবার গায়েহলুদ হবে। একই স্থানে কাল দুপুর সাড়ে ১২টায় হাবিবার বিয়ের অনুষ্ঠান হবে। সন্ধ্যায় পুলিশ সুপারের বাসভবন থেকে বর-কনেকে বিদায় দেওয়া হবে। হাবিবার বিয়েতে উপস্থিত থাকবেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাংসদ উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী, জেলা প্রশাসক রেজওয়ানুর রহমান, পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান, পৌর মেয়র নায়ার কবির, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আল-মামুন সরকারসহ অনেকেই।
জন্মের আগেই হাবিবার বাবা নুরু মিয়া মারা যান। চার বছর বয়সে মা খোদেজা বেগমও চলে যান না-ফেরার দেশে। ছয় বছর বয়সে মামা মোশারফ হোসেন ও মামি লুৎফা বেগম তাঁকে সরকারি শিশু পরিবারে রেখে আসেন। সেখানেই দীর্ঘ এক যুগ কাটিয়েছেন হাবিবা। হাবিবা সেলাই, বুটিক ও কম্পিউটারের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।
সরকারি শিশু পরিবার সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালের শেষের দিকে হাবিবার বয়স ১৮ বছর পূর্ণ হয়েছে। নীতিমালা অনুযায়ী, বয়স ১৮ হলে তাঁকে শিশু পরিবার ছাড়তে হবে। এ কারণে মামা-মামিকে ডেকে তাঁদের হাতে তুলে দেওয়া হয় হাবিবাকে। কিন্তু হাবিবার মায়া মায়া দৃষ্টি শিশু পরিবারের উপতত্ত্বাবধায়ক রওশন আরাকে ভাবিয়ে তোলে। তিনি হাবিবার পুনর্বাসনের সিদ্ধান্ত নেন। এ কারণে পরিচালনা কমিটির সঙ্গে আলোচনা করে দুই মাস পরে আবারও হাবিবাকে শিশু পরিবারে নিয়ে আসেন তিনি।
সরকারি শিশু পরিবার জানায়, পুনর্বাসন ও কর্মসংস্থানের ভাবনা থেকে হাবিবার বিয়ে দেওয়ার চিন্তা করেন রওশন আরা। বিষয়টি নিয়ে তিনি এসপি মিজানুর রহমানের সঙ্গে কথা বলেন। বর হিসেবে কোনো ভালো ছেলের খোঁজ পাওয়া গেলে তাঁকে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিতে সম্মত হন এসপি। বিষয়টি জানাজানি হওয়ায় এগিয়ে আসেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, আইনমন্ত্রী, স্থানীয় সংসদ সদস্য এবং সমাজসেবা অধিদপ্তর ও সরকারি শিশু পরিবারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
জানা গেছে, কসবার খাড়েরার সোনারগাঁও গ্রামের ফরিদ মিয়ার ছেলে জাকারিয়া আলমের সঙ্গে হাবিবার বিয়ের দিন পাকা করা হয়। গত বছর পুলিশের কনস্টেবল পদে নিয়োগের লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন জাকারিয়া। এসপির সহায়তায় ছয় মাসের প্রশিক্ষণ শেষে বর্তমানে তিনি কুমিল্লায় কর্মরত আছেন।
সরকারি শিশু পরিবারের উপতত্ত্বাবধায়ক রওশন আরা বলেন, ‘মেয়েটির জন্য কিছু করার আমার এই ছোট ইচ্ছার বিষয়টি পরিপূর্ণতা পাওয়ায় মানসিক তৃপ্তি পাচ্ছি।’
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. ইকবাল হোসাইন বলেন, ‘বিয়ের সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। সুন্দর ও ব্যতিক্রমী একটি বিয়ে হবে।’
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আল-মামুন সরকার বলেন, ‘সমাজের সবাই এভাবে পাশে দাঁড়ালে এতিম শিশুদের মুখে হাসি ফুটবে।’
হাবিবা আবেগাপ্লুত হয়ে বলেন, ‘আজ মা-বাবার কথা খুব মনে পড়ছে। তাঁরা বেঁচে থাকলে হয়তো কোথাও আমাকে বিয়ে দিতেন। কিন্তু এমনভাবে হতো না। আমি এতিম ছিলাম। সৌভাগ্যক্রমে শিশু পরিবারে রওশন আরা ম্যাডাম, এসপি স্যার, ডিসি স্যার, মন্ত্রী স্যার, এমপি স্যার, আল মামুন স্যারসহ সবার কাছে চির কৃতজ্ঞ। বাবার অভাব এভাবে পূরণ হবে ভাবিনি।’ সবার কাছে দোয়া চেয়ে শিশু পরিবারের অন্যদের বেলায়ও সমাজের সবাইকে এভাবে এগিয়ে আসার অনুরোধ জানান তিনি।
পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান বলেন, ‘এই জেলার জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে সুশীল শ্রেণির সবাই বিয়েতে হাবিবার পাশে দাঁড়িয়েছে। হাবিবা আমাদের জন্য একটি উদাহরণ। আমরা চাইলেই একটি সাধারণ বিষয়কে অসাধারণ রূপ দিতে পারি। শুধু আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন দরকার। তাহলেই সবার পাশে আমরা দাঁড়াতে পারব।-প্রথম আলো
এমটি নিউজ২৪ডটকম/আ শি/এএস