শুভ্র দেব : সড়কের দু’পাশে শুধু হাসপাতাল আর হাসপাতাল। আধা কিলোমিটার রাস্তায় সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ৪০টি হাসপাতাল। শ’ শ’ রোগী আর দালালে গিজগিজ করে ওই এলাকা। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকা শেরেবাংলানগরে এমন চিত্র।
এখানেই জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল (পঙ্গু হাসপাতাল), ঢাকা শিশু হাসপাতাল, জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স, শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল এবং জাতীয় বাতজ্বর ও হৃদরোগ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রসহ আরো বেশকিছু হাসপাতাল।
এসব সরকারি হাসপাতালে সেবা নিতে আসা রোগীদের দিকে দৃষ্টি থাকে ওই এলাকার বেসরকারি হাসপাতালগুলোর। এজন্য নিয়োগ করা হয়েছে দালাল। রোগী ধরার ফাঁদ পেতে বসে থাকে দালালরা।
গত কয়েকদিন সরজমিন মোহাম্মদপুর, শ্যামলীসহ আশপাশের এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বৈধ-অবৈধ প্রাইভেট হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ছড়াছড়ি। বিশেষ করে বাবর রোড, ও খিলজি রোড ঘিরে গড়ে উঠেছে হাসপাতাল বাণিজ্য। অর্ধ কিলোমিটারের কম জায়গায় ৪০টির মতো হাসপাতাল।
মুন ডায়াগনস্টিক, বেবি কেয়ার হসপিটাল এন্ড ডায়াগনস্টিক, ট্রমা সেন্টার এন্ড ডায়াগনস্টিক, অ্যানালাইসিস ফিজিওথেরাপি হাসপাতাল, আশিক মাল্টি স্পেশালাইজড, সিগমা মেডিকেল, মনমিতা মানসিক হাসপাতাল, শেফা হাসপাতাল, লাইফ কেয়ার নার্সিং হোম, জনসেবা নার্সিং হোম, এলিট ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনস্টিক, চেস্ট কেয়ার, শিশু নিরাময়, মক্কা মদিনা জেনারেল হাসপাতাল এন্ড ডায়াগনস্টিক, প্লাজমা মেডিকেল সার্ভিস এন্ড ক্লিনিক, আল মারকাজুল ইসলামী হাসপাতাল, নিউ ওয়েল কেয়ার হাসপাতাল, জয়ীতা মেডি ল্যাব, ইবাদ মেডিকেল ল্যাব, রয়্যাল মাল্টি স্পেশালিস্ট হাসপাতাল, ফেয়ার ল্যাব, হিস্টো বায়া জোন এন্ড ডায়াগনস্টিক, ইসলামিক মানসিক হসপিটাল, সেবিকা জেনারেল হাসপাতাল, মেডিল্যাব, প্রাইম, ভিক্টোরিয়া, শাহজালাল, ঢাকা জেনারেল, সন্ধি ডায়াগনস্টিক কেয়ারসহ হাসপাতালের ছড়াছড়ি।
ওই এলাকার বেসরকারি কিছু হাসপাতালের নিজস্ব মার্কেটিং প্রতিনিধি আছে। যারা বেতন হিসাবে আবার কমিশন হিসাবে কাজ করেন। তারাই মূলত রোগী সংগ্রহের কাজ করেন। এবং তাদের মার্কেটিংয়ের জন্য প্রসিদ্ধ জায়গা হচ্ছে শেরেবাংলা নগরে গড়ে উঠা বিভিন্ন সরকারি হাসপাতাল। মার্কেটিং প্রতিনিধিরা সকাল থেকেই সরকারি হাসপাতালে শুরু করেন জটলা। চলে গভীর রাত পর্যন্ত। এক দুই জন নয়। অন্তত কয়েকশ’ প্রতিনিধি। তারা সবাই রোগী ভাগানোর প্রতিনিধি নামে পরিচিত। রীতিমত প্রতিযোগিতা শুরু করেন তারা।
লোভনীয় অফার আর হয়রানি। চলে টানা হেঁচড়াও। অসহায় রোগী আর তাদের অভিভাবকরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাদের ফাঁদে আটকা পড়েন। হাসপাতালে ভর্তি করার পর শুরু হয় অন্যরকম হালচাল। টাকা আদায়ের যত কলা-কৌশল। চিকিৎসার বালাই নাই। উল্টো আদায় করা হয় বিভিন্ন অজুহাতে বড় অঙ্কের টাকা। আর এই চিকিৎসা সেবার ভার বহন করতে গিয়ে অনেকেই হারিয়েছেন মূল্যবান অনেক কিছু। এসব অবৈধ হাসপাতাল-ক্লিনিকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা অভিযান চালালেও তাদের অসাধু কার্যক্রম বন্ধ করা যাচ্ছে না। ফলে স্থানীয় প্রভাবশালীর এসব সিন্ডিকেটের অবৈধ চিকিৎসা বাণিজ্য চলছেই।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সরকারি এসব হাসপাতালের রোগীদের নিয়ে বাণিজ্য করে কিছু দালাল কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। রোগী ভাগিয়ে নিয়ে তাদের হাসপাতালে ভর্তি করে নানা কলা কৌশলে টাকা আদায় করেন। নামমাত্র সেবা প্রদান করে হাতিয়ে নেয়া হয় বড় অঙ্কের টাকা। অযথা বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার নামে এবং ভর্তি থেকে শুরু করে রোগী রিলিজের দিন পর্যন্ত একাধিক বিষয়ের উপর বিল তৈরি করা হয়। কেউ কেউ যদি টাকা পরিশোধ করতে না পারেন তবে রোগী আটকে রেখে হয়রানি করা হয়।
জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক প্রফেসর ডা. আফজালুর রহমান বলেন, আমাদের মুখ খোলার মতো কোনো সুযোগ নাই। কারণ রোগী ভাগানোর প্রতিনিধিরা প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় কাজ করে। আগারগাঁও এলাকায় এতো সরকারি হাসপাতাল থাকা সত্ত্বেও আশপাশে ব্যাঙের ছাতার মতো অসংখ্য বেসরকারি হাসপাতাল ক্লিনিক গড়ে উঠেছে। এদের প্রত্যেকটি প্রভাবশালী মহলের। তাদের প্রতিনিধিরা রোগী গেইটের ভেতরে ঢোকার আগেই ছলে বলে কৌশলে নিয়ে যায়। আমাদের নিরাপত্তাকর্মীরা আছে। কিন্তু সেই প্রতিনিধিরা সাধারণ বেশে আসে। দেখে বোঝার কোনো উপায় নাই।
তিনি আরো বলেন, এই অবস্থা থেকে রেহাই পাবার জন্য এসব অবৈধ হাসপাতাল ক্লিনিক মালিকদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে। পাশাপাশি রোগী এবং তাদের অভিভাবকদের আরো সচেতন হতে হবে। চোখ কান খোলা রেখে চলতে হবে। কে দালাল কে প্রতারক তাদের কথা বার্তা শুনে বুঝে নিতে হবে। আর প্রতিটি সরকারি হাসপাতালে সকাল ৮টা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত বহির্বিভাগে সেবা দেয়া হয়। রোগীরা চাইলে সেখান থেকে সেবা নিতে পারবে। এবং জরুরি বিভাগে রাত দিন ২৪ ঘণ্টা সেবার ব্যবস্থা আছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. কাজী জাহাঙ্গীর হোসেন জানিয়েছেন, এই মুহূর্তে হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোর কোনো ডাটাবেজ নেই। একটা ডাটাবেজ তৈরির পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে ম্যাজিস্ট্রেটের সহায়তায় অভিযান কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। -মানবজমিন
এমটিনিউজ/এসবি