সাজেদুল হক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মৃত্যুর পর বহুদিন হলো। শেরেবাংলা নগরের অপারেশন থিয়েটারেই জন্ম হয়েছিল এ ব্যবস্থার। মৃত্যুও এখানে। যদিও বলা হয়, সুপ্রিম কোর্টের রায়ের কারণেই এটা করা হয়েছে।
বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক যখন ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলার রায় ঘোষণা করেছিলেন তখন দুই মেয়াদে এ ব্যবস্থাকে ‘হালাল’ বলা হয়েছিল। কিন্তু অবসরে যাওয়ার পর তিনি যে রায় লেখেন, সেখানে আর বিষয়টি উল্লেখ করেননি। অনেক আইনবিদই এর কঠোর সমালোচনা করেছেন। কেউ বলেছেন, এটা প্রতারণা।
সে যাই হোক, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার দাবি বিএনপিও এখন আর তোলে না। নতুন দাবি হিসেবে সামনে এসেছে ‘সহায়ক সরকারের’ কথা। যদিও ওই সরকার দেখতে কেমন, তার আকার-আকৃতি কী সে ফর্মুলা এখনো বিএনপি হাজির করেনি। দলটির প্রধান বেগম খালেদা জিয়া এখন লন্ডনে অবস্থান করছেন। যেখানে দীর্ঘদিন থেকেই বাস করছেন তার বড় ছেলে এবং দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
বলাবলি আছে, লন্ডন সফর শেষে দেশে ফিরে খালেদা জিয়া তার সহায়ক সরকারের ফর্মুলা হাজির করবেন। তবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এরইমধ্যে তার ভাষায় লন্ডন মার্কা সহায়ক সরকার বাংলাদেশের জনগণ মানবে না বলে ঘোষণা দিয়েছেন।
বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে সমঝোতার নজির একেবারেই কম। হয়তোবা এ অঞ্চলের মানুষ সমঝোতা পছন্দ করেন না। অতীতে খুব কম রাজনৈতিক সংকটেরই আলোচনার টেবিলে সমাধান হয়েছে। এমনকি বিদেশি অতিথিদের মধ্যস্থতায়ও কোনো কাজ হয়নি।
সর্বশেষ ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের আগে দুই দলকে এক টেবিলে বসিয়েছিলেন তারানকো। কিন্তু বসাতেই সার। ওই সংলাপেও কোনো সমাধান হয়নি। এরআগে আবদুল মান্নান ভূঁইয়া আর আবদুল জলিলের ব্যর্থ সংলাপের বিখ্যাত নজির তো রয়েছেই। এখন অবশ্য পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেছে ‘সংলাপ চাহিয়া লজ্জা দিবেন না’ এমন কথাও লেখা হয়।
বিএনপি সহায়ক সরকারের ফর্মুলা আনুষ্ঠানিকভাবে হাজির না করলেও এ ব্যবস্থা নিয়ে রাজনীতিতে গেল কিছুদিন ধরেই বাত কি বাত চলছে। নানা ফতোয়া হাজির করছেন রাজনীতির মুফতিরা। অনেকেই স্মরণ করেছেন, ২০১৩ সালের শেষ দিকের কথা। যখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলোকে নিয়ে সর্বদলীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। বিএনপিকেও সে সরকারে যোগদানের আহ্বান জানানো হয়েছিল।
আলোচনার জন্য খালেদা জিয়াকে গণভবনে আমন্ত্রণও জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু বিএনপি সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। পরে জাপা থেকে ছয় মন্ত্রী নিয়ে ২০১৩ সালের ১৯শে নভেম্বর ৩০ সদস্যের সর্বদলীয় সরকার গঠন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বর্তমান মন্ত্রিসভাতেও বিভিন্ন দলের প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। মন্ত্রিসভায় আওয়ামী লীগের বাইরে জাতীয় পার্টির তিন, জাসদ, ওয়ার্কাস পার্টি ও জেপির একজন করে সদস্য রয়েছেন।
আওয়ামী লীগ নেতারা এরইমধ্যে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, দলটি সংবিধানের বাইরে যাবে না। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারই হবে সহায়ক সরকার। তাদের বক্তব্য, সারা দুনিয়াতে যেভাবে হয়, বাংলাদেশেও সেভাবেই হবে। অন্য কিছু না। শেখ হাসিনার সরকারই নির্বাচনের ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনকে সহযোগিতা করবে। অন্যদিকে, বিএনপি বলছে, প্রয়োজনে সংবিধান সংশোধন করতে হবে।
তাদের মুখেও পুরনো বক্তব্য, সংবিধানের জন্য মানুষ নয়। মানুষের জন্যই সংবিধান। এক্ষেত্রে কোনো কোনো পর্যবেক্ষক বলছেন, সংবিধানের ভেতরে থেকেও সমাধান সম্ভব। তবে তা কঠিন। কারণ ২০১৩ সালের অক্টোবর-নভেম্বর আর বর্তমানের পরিস্থিতি এক নয়। বর্তমানে সংসদে বিএনপির কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই। এক্ষেত্রে টেকনোক্রেট কোটায় বিএনপির প্রতিনিধি হয়তো মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান জিএম কাদের গণমাধ্যমকে বলেছেন, বর্তমান মন্ত্রিসভায় সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী পাঁচটি দলের প্রতিনিধি রয়েছেন। বিদ্যমান মন্ত্রিসভার আকার কিছুটা কমিয়ে বিএনপি থেকে কয়েকজনকে যুক্ত করে একটি নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা সম্ভব। সংবিধান মেনেই সেটা করা সম্ভব।
বিএনপির অন্যতম পরামর্শক হিসেবে পরিচিত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক এমাজ উদ্দীন আহমদও মনে করেন বর্তমান সংবিধানের অধীনে সমাধান সম্ভব। কোনো কোনো পর্যবেক্ষক বলছেন, টেকনোক্রেট কোটা ছাড়াও যদি রাজনৈতিক সমঝোতা হয় সেক্ষেত্রে উপ-নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি দলীয় কাউকে পাস করিয়ে সংসদে নিয়ে এসে সরকারে অন্তর্ভুক্তি সম্ভব।
তারানকোর সঙ্গে ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের আগে যখন দুটি প্রধান দলের সংলাপ হয় তখন নানা ফর্মুলা আলোচনায় ছিল। নির্বাচনের সময় প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী ক্ষমতা কমানোর বিষয়টিও সে সময় আলোচনায় ছিল। তবে সে আলোচনা বেশিদূর এগোয়নি। মাঝপথেই আলোচনা থামিয়ে দেয়া হয়।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, বাংলাদেশে ১০টি সাধারণ নির্বাচনের মধ্যে ছয়টি দলীয় সরকারের অধীনে হয়েছে। সবসময়ই ক্ষমতাসীনরা নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন। এ বিষয়টি সরকার এবং বিরোধী উভয় পক্ষের মনেই কাজ করে। যে কারণে আলোচনার টেবিলে যেকোনো সংকটের সমাধানই কঠিন হয়ে পড়ে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সবদিক থেকেই বর্তমান সরকার শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। সরকারের ওপর দেশি-বিদেশি কোনো চাপ নেই। এক্ষেত্রে বিরোধীদের সঙ্গে কোনো ধরনের সমঝোতায় পৌঁছাতে বা আলোচনার টেবিলে বসতে ক্ষমতাসীনরা ভবিষ্যতে বড় কোনো চাপের মুখে পড়বে এমন কোনো সম্ভাবনাও আপাতত নেই। রাজনীতিতে হঠাৎ করে তেমন কিছু হয় না। ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে প্রেক্ষাপট।
বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, রোজার ঈদের পরই দলটি সহায়ক সরকারের ফর্মুলা হাজির করবে। এখন দেখা যাচ্ছে, কোরবানির ঈদের পরও তা উপস্থাপন করা হয় কিনা- তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। উপস্থাপনে বিএনপি সময় নিলেও এবং বিরোধীপক্ষ ইতিহাসের দুর্বলতম অবস্থানে থাকলেও কোনো কোনো পর্যবেক্ষক বলেন, সামনের দিনগুলোতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি সহায়ক সরকার ফর্মুলাকে ঘিরেই জটিল হবে। এমজমিন
এমটিনিউজ/এসবি