শুক্রবার, ৩০ অক্টোবর, ২০১৫, ০২:২৭:১৯

এরপরও কি জাতির ঘুম ভাঙবে না?

এরপরও কি জাতির ঘুম ভাঙবে না?

ড. সরদার এম. আনিছুর রহমান : সম্প্রতি আমাদের দেশের শীর্ষ পর্যায়ের দুইজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি রাজনীতি সম্পর্কে বক্তব্য দিয়ে আলোচনায় এসেছেন।তাদের বক্তব্য পত্রপত্রিকায় এবং টেলিভিশনের পর্দায় সংবাদ শিরোনাম হয়েছে।অবশ্য খবরটি শিরোনাম হবার মতই গুরুত্বপূর্ণ ছিল।আমার বিশ্বাস অন্তত: এ খবরটি কারো চোখ এড়ায়নি।এরপরও বিবেকের তাড়না থেকে বিষয়টি নিয়ে আজকে দু'কলম লিখতে বসলাম। প্রথমেই জেনে নেয়া যাক, তাঁরা বক্তব্যে কি বলেছেন? গেল ১২ অক্টোবর কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রামে এক নাগরিক সমাবেশে বক্তব্য রাখতে গিয়ে রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ বলেন, ‘দেশের রাজনীতি চলে গেছে ব্যবসায়ীদের পকেটে।আর তা আমাদের দেশের জন্য কলঙ্কজনক অধ্যায়।’ ‘আমার রাজনীতি মানুষের কল্যাণে।অবৈধভাবে সরকারি কাজ থেকে একটি লাল পয়সাও পকেটে নেইনি।আর বর্তমানে ব্যবসায়ীদের দখলে রাজনীতি।এ কারণে রাজনীতি আজ তাদের জন্য কলুষিত।যেকোনো ভাবেই হোক এই কলঙ্ক থেকে দেশকে মুক্ত করতে হবে।’(প্রথম আলো, ১২ অক্টোবর ২০১৫)। অন্যদিকে গেল ৩ অক্টোবর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ভবনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেন, ‘আমেরিকায় ৯০ ভাগ কংগ্রেস সদস্য আইনের ছাত্র। এমনকি কংগ্রেসের ডেমোক্রেটিক পার্টির যে লিডারও বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক।সেখান থেকে পদত্যাগ করে তিনি কংগ্রেসে প্রতিনিধিত্ব করছেন। ইউরোপের দেশ ইংল্যান্ডে গিয়ে দেখেন, ৮০ভাগ সংসদ সদস্য আইনের ছাত্র, আইনের শিক্ষক বা আইনজীবী।কিন্তু আমার বাংলাদেশের আইনপ্রণেতাদের ৮০ শতাংশই হচ্ছে ব্যবসায়ী-এই অবস্থায় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।’(এনটিভি ৩ অক্টোবর, ২০১৫) প্রধান বিচারপতি শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে এও বলেন, ‘সময় চলে আসছে, আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম আইনের শাসন এবং গণতন্ত্রকে যদি রক্ষা করতে হয়, তোমরা আইনের ছাত্ররা এগিয়ে আসবে, তোমরা সংসদ সদস্য হবে, পার্লামেন্টে কথা বলবে, রুল অব ল তোমরা তুলে ধরবে। তোমরা ছাড়া ব্যবসায়ীদের দিয়ে এটা হবে না, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হবে না।’ দেশের বর্তমান বাস্তবতায় এই দুই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির উপরোল্লেখিত সহজ সরল বক্তব্য থেকেই আমাদের রাজনীতি, রাষ্ট্র, সরকার ও নাগরিক অধিকারের করণ পরিণতির দিকগুলো ফুটে উঠেছে।যা বাস্তব পরিসংখ্যান থেকেও প্রমাণিত। তবে আজকের রাজনীতির এই করুণ পরিণতির জন্য এককভাবে কোনো ব্যক্তি বা দলকে দায়ী করা যাবে না।কিংবা ব্যবসায়িদের একপেশে দোষারোপ করার সুযোগ নেই।এক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান থেকে জিয়াউর রহমান, এরশাদ, খালেদা ও হাসিনাসহ কাউকে ‘দুধে ধোয়া তুলসি পাতা’ বলা যাবে না।কেননা, সবাই কমবেশি রাজনীতিকে দুষিত করেছেন। তবে এটা সত্য যে বর্তমান পরিস্থিতি খুবই উদ্বেগজনক, যা রাষ্ট্র-সমাজ তথা নাগরিকের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।দিন দিন রাজনীতিতে এই দুর্বৃত্তায়ন বাড়ায় সর্বমহলে এ নিয়ে উদ্বেগ বেড়েছে। আমরা যদি একটু পেছনে ফিরে তাকাই তবে দেখতে পাই- দেশ স্বাধীনের আগে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে সংসদে মাত্র ৪শতাংশ সদস্য ছিলেন ব্যবসায়িক।পরে দেশ স্বাধীনের পর প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৯৭৩ সালে এ সংখ্যা বেড়ে হয় ১৩ শতাংশ। এতে বলা যায়, রাজনীতিতে ব্যবসায়িদের আসার প্রথম সুযোগটি করে দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই।এরপর একই পথে হাঁটেন মেজর জিয়াউর রহমান ও স্বৈরশাসক হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদ।এতে জিয়ার আমলে ১৯৭৯ সালে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় জাতীয় সংবাদ নির্বাচনে ব্যবসায়ি সংসদ সদস্যদের ওই সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৪ শতাংশে। এরপর স্বৈরশাসক হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদের আমলে তো এর কোনো হিসাব-নিকাশই ছিল না।দেশকে বিরাজনীতিকরণের মাধ্যমে এরশাদ বিপুল সংখ্যক ব্যবসায়িককে রাজনীতিতে ডেকে এনে রাতারাতি মন্ত্রী-এমপি বানান। এতে রাজনীতিতে যেমন কালো টাকার দৌরাত্ম বেড়েছে তেমনি দেশের ব্যবসা সেক্টরকেও কূলষিত করা হয়েছে।রাজনীতির প্রভাবে রাতারাতি ব্যবসায়ি বনে ‘হঠাৎ আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ' তথা বিশাল কালো টাকার মালিক হয়েছেন অনেকে।আর সেটার প্রভাবই পরবর্তীতে আরো বেশি করে পড়তে থাকে। আমরা কি দেখলাম, ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে সংসদ সদস্যদের মধ্যে শতকরা ৪৮ শতাংশ নির্বাচিত হন ব্যবসায়িকরা। আর ২০০১ সালে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৫১ আর ২০০৮ নির্বাচনে তা ৬৩ শতাংশে উন্নীত হয়।এরপর তো কোনো কথাই নেই।২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনে ১৫৩ জন সদস্যই বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। যদিও সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি, এরপরও যতদূর জানা যায় তাতে, বর্তমান সংসদ সদস্যদের বেশিরভাগই কোনো না কোনোভাবে ব্যবসার সাথে জড়িত।(টিআইবির দেয়া তথ্য মতে বর্তমান সংসদে শতকরা ৫৭ শতাংশ সদস্য ব্যবসায়ি। এর ফলে যা হবার তাই হয়েছে।কালো টাকার বন্ধনে যুগে যুগে পরিবর্তনের ধারাবাহিতায় সুস্থ রাজনীতি এখন রাজনীতিবিদদের হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। তাই আদর্শ রাজনীতিবিদগণ ক্রমান্বয়ে রাজনীতির মাঠ থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন।বর্তমানে আদর্শবানদের মূল্যায়ন করা হয়না। মূল্যায়ন হয় কালো টাকার মালিক এবং ত্রাসে প্রভাবশালীদের।দলীয় মনোনয়ন বিক্রি করা হয় বিশাল অর্থের বিনিময়ে।এ কাজে সব দলই পটু।এইত বিগত দুইটি নির্বাচনে এমন সব ব্যক্তিদের রাতারাতি রাজনীতিবিদ, সংসদ সদস্য কিংবা মন্ত্রী হতে দেখেছি যারা এর আগে জীবনে কোনো দিন রাজনীতি করেননি।তাদের মন্ত্রী-এমপি হবার পেছনে একমাত্র সম্বল ছিল টাকার পাহাড়।জানি না কতটা সত্য তবে ব্যাপক জনশ্রুতিতে শুনেছি, দেশের নয়, বিদেশের মাটিতে (লন্ডন-আমেরিকায়) কোটি কোটি টাকা লেনদেন করে তারা রাতারাতি মনোনয়ন পেয়েছেন।হয়েছন এমপি-মন্ত্রী।ফলে এদের কাছ থেকে জাতি কী প্রত্যাশা করতে পারে! অবশ্য সম্প্রতি আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ও বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদও এমন বাস্তবতাকে স্বীকার করে বলেছেন, “রাজনীতি বলতে যা বুঝায় বাংলাদেশের রাজনীতিতে তা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত।আজকে রাজনীতির প্রধান ডিসিশন ম্যাকার হয়ে গেছে আমলা আর কালো টাকার মালিকরা।এখন রাজনীতিক হওয়া অনেক সহজ।প্রকৃত রাজনীতিবিদদের এখন মূল্যায়ন নেই।” ফলে বর্তমান বাস্তবতায় যে যেভাবেই মূল্যায়ন করুক না কেন, আমাদের রাজনীতি যে মুমূর্ষু অবস্থায় আইসিওতে পৌঁছে গেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।রাজনীতিতে ব্যবসায়িদের অধিক পরিমাণ প্রাধান্যে যেমন কালো টাকার দৌরাত্ম বেড়েছে তেমনি সমাজে সন্ত্রাস-নৈরাজ্য বেড়েছে। আজকে দেশে যে ধরনের অগণতান্ত্রিক চর্চা, অসহিঞ্চু রাজনীতি, ভিন্ন দমন, নাগরিক অধিকার লঙঘন, জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাস-হানাহানি সহিংসতা বাড়ছে এগুলোও বিচ্ছিন্ন কোনো বিষয় নয়।কালো টাকা সর্বত্র বিষ বাষ্প ছড়িয়েছে।কেননা, কয়েক বছর আগেও রাজনীতিতে যে ধরনের পারস্পারিক সহাবস্থান, শ্রদ্ধাবোধ দেখা যেত, তা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।ফলে বর্তমান রাজনীতি আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় উদ্বেগজনক। তাইতো রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ পদে থেকেও “country's politics has gone in the pockets of businessmen.We have to get rid of it.” এবং প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা “80 percent of the lawmakers in Bangladesh are businessmen.we have to get rid of this politics.”এ কথা বলতে বাধ্য হয়েছেন। গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকেও তাঁরা দু’জন এই বর্তমান বাস্তবতায় চরম সত্যের স্বীকারোক্তি দেয়ায় আমরা তাদেরকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাই। তবে এক্ষেত্রে তাদেরও গুরু দায়িত্ব রয়েছে, একথা ভুলে গেলে চলবে না। কেননা, আমাদের বর্তমান রাষ্ট্রপতি কয়েকদফা জাতীয় সংসদে স্পিকার-ডেপুটি স্পিকারের দায়িত্ব পালন করেছেন।ফলে এই কূলষিত রাজনীতির সবকিছুই জানেন এবং এর প্রত্যক্ষ স্বাক্ষীও বটে।তাই শুধু আহবান জানালেই হবে না। আমরা আশা করবো, তিনি এ বিষয়ে কার্যকর উদ্যোগও নেবেন।রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে দেশ-জাতি ও জনগণকে এই কালোটাকার ছোবল থেকে রক্ষার দায়িত্বও তাঁর উপর বর্তায়। ফলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ক্লীন ইমেজের অধিকারী ও একজন দক্ষ প্রবীণ রাজনীতিবিদ হিসেবে রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ এই কুলষিত রাজনীতিকে ব্যবসায়ি তথা কালোটাকার দৌরাত্ম থেকে মুক্ত করে আমাদের দেশের রাজনীতিকে সঠিকধারায় প্রবাহিত হতে উদ্যোগী হবেন।যা ভবিষ্যতের জন্য এক বিরল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।এক্ষেত্রে বর্তমান পরিস্থিতিতে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় প্রধান বিচারপতিরও সাহসী ভুমিকা রেখে রাজনীতিকে কূলষমুক্ত করার যথেষ্ঠ সুযোগ রয়েছে।আশা করবো, তাঁরা এসব বিষয়ে উদ্যোগী হয়ে দুর্বৃত্তায়ন থেকে জাতিকে রক্ষা করবেন।অন্যথা, সামনের দিনে জাতির যে কোনো অধ:পতন কিংবা নাজুক পরিস্থিতির দায় তারা কোনোভাবেই এড়াতে পারবেন না। সবশেষে বলবো, রাজনীতিতে এতো দোষণ, অন্যায়-অবিচার, দুর্নীতি-সন্ত্রাস, কালোটাকার দৌরাত্মের তথ্য-প্রমাণ সত্ত্বেও কি আমাদের দেশের জনগণের বিবেক জেগে উঠবে না? এরপরও কি জাতির ঘুম ভাঙবে না?যাতে তারা দুর্নীতি-সন্ত্রাস, অসহিষ্ণতা-ভিন্নদমন আর কালো টাকাকে না বলবে, অন্যায়-অবিচারকে ঘৃনা করবে।আর সৎ যোগ্য ও দেশপ্রেমিককে নির্বাচত করে জাতিকে এই অপরাজনীতি থেকে মুক্ত করবে।এক্ষেত্রে সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিবেশী দেশের কবি, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের প্রতিবাদ আমাদের দেশের বিবেকবান নাগরিকদের জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হতে পারে। লেখক: শিক্ষা ও সমাজ বিষয়ক গবেষক এবং কলাম লেখক।ই-মেইল: [email protected] ৩০ অক্টোবর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এসএম/ডিআরএ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে