শনিবার, ৩১ অক্টোবর, ২০১৫, ০২:৩৯:৩২

জঙ্গি হামলার গোয়েন্দা তথ্য ছিল যে পাঁচ দেশের কাছে

জঙ্গি হামলার গোয়েন্দা তথ্য ছিল যে পাঁচ দেশের কাছে

নিউজ ডেস্ক : জঙ্গিরা বাংলাদেশে বিদেশীদের ওপর হামলার পরিকল্পনা করছে গত মাসে এমন তথ্য পেয়েছিল পাঁচ দেশের গোয়েন্দা বাহিনী। ‘ফাইভ আইজ’ জোটের দেশগুলো হলো- অস্ট্রেলিয়া, বৃটেন, কানাডা, নিউজিল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্র। এ তথ্যের ওপর ভিত্তি করে বৃটেন ও যুক্তরাষ্ট্র তাদের নাগরিকদের উদ্দেশ্যে সতর্ক বার্তা দেয়। বাংলাদেশে সফর সতর্কতা হালনাগাদ করে অস্ট্রেলিয়া। সম্ভাব্য হামলার বিষয়ে মার্কিন কর্মকর্তারা সতর্ক করলেও তা গুরুত্বের সঙ্গে নেয়নি বাংলাদেশ। নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়। ‘বাংলাদেশ পুশেস ব্যাক অ্যাজ ওয়ার্নিংস অব আইসিস এক্সপ্যানসন গ্যাদার স্টিম’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাংলাদেশ ও বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মধ্যে সংযোগহীনতায় বিভ্রান্ত বাংলাদেশী ও বিদেশীরা। আর এটা দক্ষিণ এশিয়ায় আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর বিস্তার প্রতিহত করার প্রচেষ্টাকে জটিল করে তুলতে পারে। আর বাংলাদেশে তাদের আবির্ভাব হতে পারে ভয়াবহ। ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে অর্থনৈতিক অগ্রগতি। মার্কিন কর্মকর্তারা গত মাসে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিল যে, ইসলামিক স্টেটের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সন্ত্রাসীরা বাংলাদেশের ভূখণ্ডে তৎপরতা বৃদ্ধি করার প্রস্তুতি নিচ্ছে- এমন তথ্য তাদের কাছে আছে। এর কয়েক দিন পর সিরিজ হামলার ঘটনা ঘটে। এতে ওই সতর্ক বার্তা যথার্থ ছিল বলে প্রতীয়মান হয়। রাজধানীর কূটনৈতিক এলাকায় গুলি করে হত্যা করা হয় ইতালির এক নাগরিককে। আর এক জাপানিকে গুলি করা হয় দেশের উত্তরাঞ্চলে। গত শনিবার শিয়া মুসলিমদের একটি বিশাল জমায়েতে পুলিশ কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা বেষ্টনী গলে ঢুকে পড়ে বোমা হামলাকারীরা। ওই হামলায় এক তরুণ নিহত হয়। আহত হয় অনেকে। প্রতিটি হামলার পর দায় স্বীকার করে আইএস। তাদের দায় স্বীকার যেসব সামাজিক মাধ্যম অ্যাকাউন্টে এসেছে সেগুলো উগ্রপন্থি দলটি ব্যবহার করে বলে ধারণা করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব ঘটনাপ্রবাহের প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন সন্দেহ আর স্পষ্ট সংশয় নিয়ে। বিদেশী দূতাবাসগুলো তাদের নাগরিকদের সতর্কতা জানালেও বাংলাদেশী কর্মকর্তারা জোর দিয়ে বলেছেন, আইএসের অস্তিত্ব বাংলাদেশে নেই। তারা স্পষ্টতই বিবেচনায় নিয়েছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র অতীতেও ত্রুটিপূর্ণ গোয়েন্দা তথ্য প্রচার করেছে। যেমনটা হয়েছিল ইরাক অভিযানের সময়। শেখ হাসিনা বরং এসব ঘটনাকে তার সরকারের সুনাম ক্ষুণ্ন করতে স্থানীয় বিরোধী নেতাদের ষড়যন্ত্র বলে আখ্যা দিয়েছেন। বাংলাদেশ ও বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মধ্যে সংযোগহীনতায় বাংলাদেশী ও বিদেশীরা বিভ্রান্ত। এটা দক্ষিণ এশিয়ায় জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর বিস্তার প্রতিহত করার প্রচেষ্টাকে জটিল করে তুলতে পারে। এখানে তাদের আবির্ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে অর্থনীতি। আর বিস্তার ছড়িয়ে যেতে পারে ভারত ও পাকিস্তানে। কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশ স্থানীয় জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর নেটওয়ার্কের সঙ্গে লড়েছে। রাজনৈতিক বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে এদের কয়েকটির যোগসূত্র ছিল। কিছু সময় সুপ্তাবস্থায় থাকার পর এ বছর আবার তারা পুনর্গঠিত হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। মৌলবাদী ইসলামের বিরুদ্ধে কথা বলা চার জন বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করেছে তারা। এদিকে, বিদেশী নিরাপত্তা সংস্থাগুলো লন্ডন ও অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন ও অন্যান্য শহরগুলোতে বসবাসরত বাংলাদেশী অভিবাসীদের খুঁজে বের করেছেন যারা আইএসে নিয়োগকারী এবং যোদ্ধা হিসেবে সক্রিয়। এসব গ্রুপের মধ্যে ‘কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল’ যোগসূত্র বাংলাদেশের জন্য নতুন বিপদ ডেকে আনবে। ঢাকাস্থ একজন সিনিয়র কূটনীতিক পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বলেন, ‘আমরা আইএসের দাবি খুবই গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছি। সারা বিশ্বে আমরা তাদের বিস্তার দেখছি।’ এখন পর্যন্ত ওই যোগসূত্রের তথ্যপ্রমাণ খুবই সামান্য। বাংলাদেশের পুলিশ ৩০ জনেরও বেশি আইএসের সমর্থককে গ্রেপ্তার করেছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের জয়েন্ট কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, এদের বেশির ভাগ অবস্থাসম্পন্ন পরিবারের এবং ছাত্র। তারা সিরিয়া বা আফগানিস্তানে লড়াই করতে যাওয়ার পরিকল্পনা করছিল। লন্ডনভিত্তিক এক ব্যক্তিকেও তারা গ্রেপ্তার করেছে বলে জানান মি. ইসলাম যে রিক্রুট করতে বাংলাদেশ এসেছিল। ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিবিষয়ক বিশেষজ্ঞ আলী রীয়াজ বলেন, তিনি বাংলাদেশে বড় জিহাদি গ্রুপগুলোর ‘সাংগঠনিক অবস্থান’ নিয়ে ‘অত্যন্ত সন্দিহান’। তিনি বলেন, স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা জঙ্গি সংগঠনগুলো যোগসূত্র স্থাপনে আগ্রহী। আলী রীয়াজ বলেন, ‘সুযোগ আসলে আর রাস্তা পেলে স্থানীয় এসব গ্রুপগুলো অচিরেই আইএসের ফ্রাঞ্চাইজ হয়ে উঠবে।’ গত মাসের সতর্ক বার্তাগুলো বাংলাদেশ ও বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মধ্যে গভীরে প্রোথিত পারস্পরিক অবিশ্বাসের দিকে মনোযোগ আকর্ষণ করে। যদিও তারা সন্ত্রাসবিরোধী পদক্ষেপে সহযোগিতা গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন। মাসখানেক আগে ‘ফাইভ আইজ’ কথিত জোটরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বাংলাদেশে বিদেশীদের ওপর সম্ভাব্য সন্ত্রাসী হামলার তথ্য পেয়েছিল। ২৫শে সেপ্টেম্বর অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশ সফরে তাদের সতর্কতা হালনাগাদ করে। এতে বলা হয়, ‘অস্ট্রেলিয়ানদের ওপর সম্ভাব্য জঙ্গি হামলার বিশ্বাসযোগ্য তথ্য তাদের কাছে রয়েছে।’ ধারণা করা হয়েছিল হামলার টার্গেট ছিল বিদেশীদের কাছে জনপ্রিয় একটি বার্ষিক কস্টিউম পার্টি গ্লিটার বল। এই একই তথ্যের ভিত্তিতে সতর্কতা দেয় বৃটেন ও যুক্তরাষ্ট্র। ২৭শে সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অস্ট্রেলিয়ার জঙ্গি হামলার শঙ্কাকে ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দেন। মার্কিন কর্মকর্তারা তাদের তরফ থেকে জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে নিউ ইয়র্ক সফররত শেখ হাসিনার সফরসঙ্গী কর্মকর্তাদেরকে হুমকির বিস্তারিত অবহিত করেন। ওই সফরে শেখ হাসিনার একজন সফরসঙ্গী গওহর রিজভী বলেন, এসব সতর্কতা হতাশাজনক এবং সুনির্দিষ্ট নয় বলে মনে করেছেন প্রধানমন্ত্রী। রিজভী বলেন, যুক্তরাষ্ট্র কার্যকর কোন গোয়েন্দা তথ্য শেয়ার করে নি। আর তারা এও জানায় নি যে তথ্য কোথা থেকে এসেছে। এক সাক্ষাৎকারে রিজভী বলেন, গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদানে আমাদের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। তবে এ দফায় কেন আপনি একতরফা পদক্ষেপ নিচ্ছেন আর তথ্য শেয়ার করছেন না? তিনি আরও বলেন, ‘অতীতে ইরাকে ‘উইপন্স অব মাস ডেস্ট্রাকশন’ আছে বলে যুক্তরাষ্ট্র যে ত্রুটিপূর্ণ গোয়েন্দা তথ্য দিয়েছিল তাতে বিশ্বের বিশ্বাসপ্রবণতার পরীক্ষা হয়েছে।’ জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর তৎপরতা নজরদারি করে থাকে এমন একটি প্রতিষ্ঠান সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপের তথ্য অনুযায়ী, ইতালিয়ান সিজার তাভেলা হত্যার কয়েক ঘণ্টা পর আইএসের তরফ থেকে হামলার দায় স্বীকারের বার্তা আসে মোবাইল মেসেজিং অ্যাপ টেলিগ্রামে আইএসের একটি সন্দেহভাজন অ্যাকাউন্টে। এছাড়াও বার্তা আসে আইএস ব্যবহার করে ধারণা করা হয় এমন দুটি টুইটার অ্যাকাউন্টে। বাংলাদেশ সরকার এমন দাবি প্রত্যাখ্যান করে। নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্র নিয়ে অবিশ্বাস অনেক গভীরে প্রোথিত। আর এতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত কিছু বিষয় রয়েছে। দীর্ঘদিনের একটি সন্দেহ রয়েছে যে, ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র হাত ছিল। আর সাম্প্রতিক সময়ে ২০১৪ সালে তার দলের বিতর্কিত নির্বাচন বিজয়ে ওয়াশিংটনের ঠাণ্ডা প্রতিক্রিয়া আর দেশের তৈরী পোশাক শিল্পের বাণিজ্য সুবিধা প্রত্যাহার করে নেয়ায় তিনি হতাশ হয়েছিলেন। কিছু দেশ তার সংশয়ে সমর্থন দিয়েছে। ঢাকায় নিযুক্ত রাশিয়ান রাষ্ট্রদূত আলেক্সান্ডার এ. নিকোলায়েভ বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা হুমকিকে অতিরঞ্জিত করছে। দুটি হত্যাকাণ্ডের পর তিনি মন্তব্য করেছিলেন, দু ফোঁটা পানিকে বৃষ্টি বলে না। এক মাসের ব্যবধানে বিদেশীদের মধ্যে শঙ্কা কমে এসেছে। তারা আবারও ঢাকার মার্কেটে, হোটেলে যাতায়াত শুরু করেছেন। তবে এখন তারা রাস্তাঘাটে হাঁটেন না বা বাইসাইকেল, রিকশায় চড়েন না। দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি তৈরী পোশাক শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পশ্চিমা ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের কিছু বায়ার তাদের বার্ষিক সফর বাতিল করেছেন। কূটনীতিকরা বলছেন হুমকি এখনও গুরুতর। সিনিয়র এক পশ্চিমা কূটনীতিক পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বলেন, হুমকি বৃদ্ধির বিষয়টি পুরো পরিস্থিতিকেই পাল্টে দিয়েছে যা বিদেশীদের জন্য নিরাপত্তা পরিস্থিতির ওপর স্থায়ীভাবে প্রভাব ফেলবে। তিনি বলেন, এটা হুট করে পাল্টে যাবে না। আর জঙ্গি কর্মকাণ্ড নিয়ে উদ্বিগ্ন বাংলাদেশীদের মধ্যে পরস্পরবিরোধী বার্তায় উদ্বেগ বেড়েছে। প্রথম আলোর এক সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান বলেন, সরকার যেভাবে আইএসের অস্তিত্ব অস্বীকার করছে তা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। গত মাসে চীনের উইঘুর ইসলামিক সন্ত্রাসী গ্রুপ নিয়ে লেখার কারণে ফোনের মেসেজে হুমকি পেয়েছিলেন তিনি। দু’সপ্তাহ পর অপরিচিত এক ব্যক্তি মিজানুর রহমান খানের রিকশা আটকে বন্দুক দিয়ে হুমকি দেয়। পুলিশকে অবহিত করলে তাকে রিকশা চড়া থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেয় এক কর্মকর্তা। এরপর থেকে তার সম্পাদকের পরামর্শে টিভি প্রোগ্রামে যোগ দেয়া বন্ধ করে দিয়েছেন তিনি। কাজে যান বিভিন্ন রাস্তা ব্যবহার করে। তিনি বলেন, সত্যিকারের বিপদ অনুধাবনের ক্ষেত্রে আমরা খুবই কঠিন একটি অবস্থানে রয়েছি। এ হুমকি কি ছিল, সরকারের প্রতিক্রিয়া কি ছিল আর কেন তারা সহযোগিতা করছেন না এ নিয়ে আমরা সরকার বা যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে কোন কিছু শুনছি না। -মানবজমিন ৩১ অক্টোবর,২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এসবি/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে